সাব্বাশ! আমাদের আর ভয় কী?

লোককথা

download (6)

ফরহাদ মজহার

 এক.

প্রথম আলো বলছে, আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে সাংবাদিকেরা ‘অব্যাহতি’ পেয়েছেন (১৩ মার্চ ২০১৪)। প্রথম আলোও কি পেল? কিভাবে তাঁরা অব্যাহতি পেলেন রায় দেখে এই বিষয়টা নিয়ে আরো আলোচনার প্রয়োজন। শুনানির সময় আদালত বলেছে, এর আগেও মিজানুর রহমান খান আদালত অবমাননাকর নিবন্ধ লিখেছেন। সেই নিবন্ধগুলো বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে। যে নিবন্ধ নিয়ে আদালত আপত্তি তুলছেন তার ক্ষেত্রে আদালতের মনে হয়েছে, এটা সুনির্দিষ্ট কোন একটি বেঞ্চ সম্পর্কে লেখা হয়েছে। তা-ই যদি হয় তাহলে আসলেই এটা আদালত অবমাননা। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এটা গুরুতর অভিযোগ। যার প্রমাণ আদালতের কাছে আছে। যদি তা-ই হয় তাহলে দৈনিক প্রথম আলো অব্যাহতি পায় কিভাবে?
দ্বিতীয়ত, ‘মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে’ লেখাটি নাগরিক ও মানবিক-বিরোধী। ‘গণজামিন’ মানে কী? জামিন পাওয়া যেকোন নাগরিকেরই অধিকার, এবং জামিন দেবার অধিকার অবশ্যই আদালতের এখতিয়ার। বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চলছে, জামিন নিচ্ছেন মতাসীনদের বিরোধীরাই, প্রধানত। তাহলে প্রথম আলোর এই নিবন্ধ মূলত নির্লজ্জ ভাবে মতাসীনদের চাটুকারিতা ছাড়া কিছুই না। রাষ্ট্রকে আরো সন্ত্রাসী ও কট্টর হবার উপদেশ। শেখ হাসিনাকে খুশি করবার জন্য আদালতকে অপমান করা, আদালত অবমাননা করা। এই পরিস্থিতিতে প্রথম আলো অব্যাহতি পায় কিভাবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
আমরা এর আগে বলেছি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ চিন্তা ও বিবেকের পূর্ণ স্বাধীনতার পে দাঁড়ানো আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য জরুরি মনে করি। এখানে প্রকাশের ধরন নিয়ে অনেক সময় তর্ক আছে। কারো চিন্তা, বিবেক বা লেখালিখির দ্বারা অন্য কোন নাগরিকের মর্যাদা ুণœ করা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি আছে। আমাদের অবস্থান হচ্ছে, এইগুলো নিয়ে আলোচনা ও একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে হলে খুবই প্রয়োজন। রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই মীমাংসা করতে হবে। এটা আদালতের কাজ নয়।
অধিক তর্কে না গিয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট ভাবে ‘আদালত অবমাননা’ সম্পর্কে বলতে পারি, আদালত অবমাননা মতপ্রকাশ কিম্বা চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার সঙ্গে ওইখানেই যুক্ত যখন তা সরাসরি ও সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন-না-কোন বিচার বা বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রথম আলোর ক্ষেত্রে আদালত বলছেন যে, পত্রিকাটি এই কুকর্মই করেছে। কিন্তু এই অভিযোগ একতরফা তোলাও আদালতের এখতিয়ারের হতে পারে না। বিশেষত যখন আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত আইন অনুপস্থিত। সাধারণ ভাবে বললে আদালত আইনপ্রণেতা নন; আইন প্রণয়নের ভূমিকা তার নেবার কথা নয়, তবু অবস্থা-বিশেষে আদালত তা নিতেও পারেন। কিন্তু সেই েেত্রও সংবিধানের কোন ধারা বা কোন আইন ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে, সরাসরি নয়।
তার পরও কথা থাকে। বাংলাদেশে যদি ‘আদালত অবমাননা’-সংক্রান্ত কোন আইন না থাকে, তাহলে সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদকে আইন জ্ঞান করে তার ভিত্তিতে আদালত কি বিচার করতে পারেন? আদালত সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের উদাহরণ দিয়ে আদালতের ‘সহজাত মতা’র একটি ধারণা প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন। এটা তর্কসাপে। পুরা রায় হাতে পেলে আমরা এ নিয়ে আলোচনার আশা রাখি।
আদালত অবমাননা কথাটাও বিমূর্ত কোন ধারণা নয়, যা আদালত যেমন খুশি প্রয়োগ করতে পারেন। যদি করেও তার পরও আদালতকে প্রমাণ করতে হবে আদালতে কোন একটা বিচার চলছিল এবং সে বিচারকে কোন সংবাদ বা লেখা সরাসরি বাধাগ্রস্ত করেছে। বৈচারিক প্রক্রিয়াকে সেই লেখা বাধাগ্রস্ত করেছে এটাই আদালত অবমাননার মূল কথা হতে পারে। আদালত ঢালাও ভাবে কোন লেখা, মন্তব্য বা বক্তব্যকে ‘আদালত অবমাননা’ বলতে পারেন না। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আদালত যদি চিন্তা, বিবেক কিম্বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চান, তাহলে সেই নিষেধ ‘যুক্তিসঙ্গত’ হতে হবে। অযৌক্তিক ভাবে কোন লেখাকে বিচারকেরা তাঁদের ব্যক্তিগত মানদণ্ড ব্যবহার করে ‘আদালত অবমাননা’ বলে ঘোষণা দিতে পারেন কি? এই এখতিয়ার আদালতের আছে বলে আমরা মনে করি না। যদি থাকে তাহলে সেটা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। আদালত যদি এই ভূমিকা গ্রহণ করেন তবে তা অগণতান্ত্রিক এবং নাগরিকেরা তা মানতে বাধ্য নয়।
আমরা এর আগের একটি লেখায় বলেছি, ‘আদালত অবমাননা’ নামক কোন আইন বাংলাদেশে নাই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে আদালত নাগরিকদের লেখালিখির বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণ করছেন? একটি আইন সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে জারি হয়েছিল, কিন্তু আদালতই তা বাতিল করেছেন। তাহলে সেই রায় নিয়ে আলোচনাও আমাদের দরকার। বাতিলের পে আদালতের রায় ‘যুক্তিসঙ্গত’ কি না নাগরিক ও মানবিক অধিকারের আলোয় সেটা বিবেচনার দরকার আছে। সময় ও সুযোগমতো আমরা তা অবশ্যই করব।
বর্তমানে আদালত অবমাননার বিষয়ে কোনো আইন নেই। তাই আদালত অবমাননার অভিযোগে শাস্তি দেয়ার বিধান নেই। আদালত অবমাননা আইন-২০১৩ বাতিল হয়ে গেছে। আর এই আইন আগের আইনকে বাতিল করেছে। অনেকে বলছেন, সংসদ এই আইন আবাব পুনরুজ্জীবিত না করলে আদালত অবমাননার পুরানা আইন পুনরায় বহাল হবে না। এর বিরুদ্ধে আদালতের অবস্থান হচ্ছে, “বাতিল হয়ে যাওয়া বা অবৈধ হয়ে যাওয়া কোনো আইন বৈধ কোনো আইনকে বাতিল করতে পারে না”।

উচ্চ আদালতের একটি রায়কে আদালত এই ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু তার ভিন্ন ব্যাখ্যাও সম্ভব। আর এই বিষয়টিও তর্কসাপে।

এখন মুশকিলটা অন্যত্র। যদি আদালত অবমাননার কোন আইন না থাকে তাহলে কী আইনে আদালত অবমাননার বিচার চলছে? আদালত বলতে পারেন, নতুন আইন বাতিল হয়ে যাবার কারণে পুরানা আইন আপনাআপনি বহাল হয়েছে। আইনশাস্ত্রে এটা ঘোরতর তর্কসাপে দাবি। এটা করা হলে তার মানে দাঁড়ায়, আদালত ১৯২৬ সালের ঔপনিবেশিক আমলের আইন আবার পুনর্বহাল করেছেন। আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ, তাহলে ঔপনিবেশিক আইন পুনর্বহাল হোক এটা চাইব কেন? একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের আদালত তা করবেনই বা কেন? এভাবে ঔপনিবেশিক আইন পুনর্বহাল করা ‘যুক্তিসঙ্গত’ কি? এটা রাজনৈতিক দিক থেকে অযৌক্তিক এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।
রাজনৈতিক প্রশ্ন ছাড়াও আইনশাস্ত্রের দিক থেকে গুরুতর তর্ক রয়েছে। একটি আইন যা পুরানা একটি আইনকে বাতিল করে নিজে আইন হয়েছে। কোন কারণে আদালত সেই নতুন আইন বাতিল করলে কি পুরানা আইন আপনাআপনি পুনর্বহাল হয়ে যায়? তা ছাড়া কে কিভাবে সেই আইন বাতিল করলেন সেই তর্ক তো আছেই। বৈচারিক স্বেচ্ছাচার যদি আমরা এড়াতে চাই তাহলে এ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যেমন দরকার ঠিক তেমনি দরকার আইনশাস্ত্রীয় মীমাংসা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার আদালতের নয়, সেটা জাতীয় সংসদের। আইনশাস্ত্রীয় মীমাংসাও আদালতের একার ব্যাপার নয়। সমাজে আইনজীবী, আইনশাস্ত্রবিদ, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা এই েেত্র স্বীকৃত। আমরা তা-ই মনে করি এবং আদালতকে তা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আদালতকে একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবার বিপদ থেকে রা করা নাগরিক হিসাবে সকলেরই কর্তব্য।
তাহলে দাঁড়াল এই যে, নতুন আদালত অবমাননা আইন বাতিল করায় পুরানা ঔপনিবেশিক আমলের আদালত অবমাননা আইন বহাল হয়েছে, এটা রাজনৈতিক কিম্বা আইনশাস্ত্রীয় কোন দিক থেকেই মেনে নেওয়া যায় না। এই েেত্র আদালতের হাতে একটি মাত্র পথ আছে, সেটা হোল, সংবিধানে ‘আদালত অবমাননা’-সংক্রান্ত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের যে কথা বলা আছে তা উল্লেখ করে জাতীয় সংসদকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া। আদালত সময় ও সীমাও প্রয়োজন বোধ করলে বেঁধে দিতে পারেন। এই আইনের অনুপস্থিতিতে আদালত যদি কোন নাগরিককে শাস্তি দেন সেটা অসাংবিধানিক ও আইনবহির্ভূত হবে কি না, আদালতকেই তা ভেবে দেখতে হবে।
আদালতের রায়টি হাতে পেলে এ বিষয়ে আরো কিছু কথা বলা যাবে।

দুই.
এটা আমাদের সকলের কাছেই পরিষ্কার থাকা উচিত যে ‘আদালত অবমাননা’র প্রশ্নটি বাংলাদেশে নিছকই আইনি বিষয় নয়। মূলত রাজনৈতিক বিষয়। অর্থাৎ চিন্তা, বিবেক কিম্বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর ‘যুক্তিসঙ্গত’ বাধানিষেধ বলতে আমরা কী বুঝব? কখন চিন্তা ও বিবেক দমন, কিম্বা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর রাষ্ট্রের হামলা যুক্তিসঙ্গত? কিভাবে তা স্থির করব আমরা? এটা কি আমরা রাজনৈতিক দলের ওপর ছেড়ে দিতে পারি? গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের দিক থেকে একে বিচারের পদ্ধতি কী হবে?
কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়, বিদ্যমান রাজনৈতিক মতা কিভাবে আইন-আদালতের মাধ্যমে প্রতিপকে দমন, নির্যাতন ও হয়রানি করে মতার সেই দুষ্ট চরিত্র জনগণের সামনে উন্মোচিত হওয়া দরকার। উন্মোচন না করলে আমরা বুঝব না কিভাবে প্রথম আলোর সম্পাদক ও অভিযুক্ত সাংবাদিক ‘অব্যাহতি’ পান, আর কেনই বা ‘আদালত অবমাননা’র অভিযোগে মাহমুদুর রহমানকে জেল খাটতে হয়। বিচারকেরা রাগ, বিদ্বেষ বা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছু করবেন না বলে শপথ নিয়ে থাকেন। কারো কারো ক্ষেত্রে বিদ্বেষ আর কারো কারো ক্ষেত্রে অনুরাগ আইনের শাসনের গোড়াতে ফুটা করে দেয়। ঝাঁঝরা করে ফেলে। বাংলাদেশের আদালত এই কাজ করছেন কি না, তা বিচার করে দেখা নাগরিকদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। সেই দিক থেকে দৈনিক প্রথম আলোর আদালত অবমাননা মামলা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, আদালত রায় দেবার সময় জনগণের কাছে তাঁদের জবাবদিহিতার দায় ভুলে যান নি। লিখিত রায়ে তার প্রতিফলন থাকবে বলেই আমরা আশা করি। আমরা মনোযোগের সঙ্গেই তাঁদের রায় পাঠ করব। এটা বিশাল দায়ও বটে, কারণ আজ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালত সম্পর্কে যে নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, নাগরিক হিসাবে তা আমাদের অপমানিত ও হেয় করে।
মাহমুদুর রহমানের েেত্র আদালত দাবি করেছেন, ‘ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’।

অর্থাৎ আদালত দাবি করেছেন, মাহমুদুর রহমান সত্য কথা লিখেছেন, এই কথা বলে তিনি পার পাবেন না। অথচ আদালতের কাজ হচ্ছে সাংবাদিকদের সত্য বলা ও প্রকাশ করার অধিকার সংরণ করা। আদালত সত্য প্রকাশের ধরন অর্থাৎ প্রকাশভঙ্গি নিয়ে আপত্তি তুলতে পারে, যদি তা কোন সুনির্দিষ্ট বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। কিন্তু আদালত ঘোষণা দিয়েছিল, মাহমুদুর রহমান সত্য বললেও সেটা তাঁর পে যুক্তি বলে আদালত গ্রহণ করবেন না। এই মন্তব্যের অর্থ হচ্ছে, আদালত সম্পর্কে বা আদালতের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা সত্য কথাও বলতে পারব নাÑ এটা তো হতে পারে না।
‘আইন’ থাকলেই তাকে ‘আইন’ বলে না। সেটা জাতীয় সংসদ বা আদালত বললেও আইন হবে না, যদি তা নাগরিক ও মানবিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সঙ্গে অসঙ্গত হয়। কোন ‘কালো আইন’ সংবিধানসম্মত হতে পারে। অর্থাৎ একটি দেশের সংবিধান এমন হতে পারে যার দ্বারা ‘কালো আইন’ প্রণয়ন করা সম্ভব, এবং আইনপ্রণেতারা হামেশাই তা করে থাকেন। কিভাবে বুঝব যে সংবিধান কালো আইনের কারখানা। বুঝব যদি সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধান একটি ভালো উদাহরণ। সংসদকে মৌলিক অধিকারেও হাত দেবার ও বদলাবার মতা দেয়। অথবা এমনই এক সংবিধান যেখানে আদালত আইনপ্রণেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, কিম্বা আইন বা শাস্তির বিধান না থাকলেও নাগরিকদের ধরে এনে শাস্তি দিতে পারে। নাগরিকদের কোন সাংবিধানিক রাকবচ থাকে না। আদালত কী পারে, আর কী পারে না, এই বিষয়ে আমাদের সমাজে অপরিচ্ছন্নতা প্রকট। মাহমুদুর রহমানকে আদালত অবমাননার দায়ে আদালত শাস্তি দিয়েছেন। বাংলাদেশের বিচারের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের দিক থেকে আদালত এই শাস্তি দিতে পারেন কি না, সেই তর্ককে আমরা উপো করতে পারি না।
‘আদালত অবমাননা’ রাজনৈতিক বিষয় হলেও এটা যে আইনের বাইরের ব্যাপার তা আমরা বলছি না। এটা তো ঠিক যে আমরা আইন-আদালত নিয়েই কথা বলছি, কিন্তু বলছি রাজনৈতিক জায়গা থেকে। আমরা বলতে চাইছি, আদালত কোন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে বিরাজমান আসমানি সংস্থা নয়। কোন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাংবিধানিক ও আইনি ইতিহাসের কারণে তাকে সাময়িক শূন্যে ঝুলে আছে মনে হতে পারে। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ সব কিছুকে মাটিতেই টেনে আনে। আমাদের সকলকেই মাটির ওপর দাঁড়াতে হবে। যত তাড়াতাড়ি আমরা তা করতে পারি ততই মঙ্গল।
আদালত অবমাননার আইনি দিক মানে বাংলাদেশের সংবিধান বা আইন মাত্র নয়। একালে দেশীয় আইন বলে কোন বিশুদ্ধ জাতীয় আইন নাই। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত নাগরিক ও মানবিক অধিকারের দিক থেকে আইন-আদালতের ভূমিকা বিচার করাই রেওয়াজ হয়ে উঠেছে।
এই মামলায় আমার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অন্যের চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী সাংবাদিক নামক একশ্রেণীর মাস্তান-ক্যাডারদের কারবার দেখা। তারা তাদের পেশাগত স্বার্থে রাষ্ট্রপরে উকিলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। মতাসীনদের অভ্যন্তরীণ মতার দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া গেল।
দ্বিতীয় আরেকটি উপভোগের দিক আছে। দৈনিক প্রথম আলো ও মিজানুর রহমান খান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের রাজনীতির েেত্র শেখ হাসিনার প।ে তারা সেকুলারিজম সমর্থন করেন, এবং ইসলামি সন্ত্রাস দমনে যারপরনাই নিবেদিতপ্রাণ। দ্বিতীয়ত, তারা বাংলাদেশে করপোরেট স্বার্থ রা করেন। এটাই তাদের রাজনীতি। বাংলাদেশে লিবারেল বা উদার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়বার েেত্র এই রাজনীতি ভুল ও তিকর। কিন্তু তার পরও আমি মনে করি না ‘আদালত অবমাননা’র খড়্গ তাদের ওপর নেমে আসুক।
শেষ প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, বিচারব্যবস্থা ভেঙেচুরে পড়ছে। গণহারে জামিন দেবার একটা নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। একে অনেকে জামিনবিরোধী অবস্থান বলছেন। প্রথম গণহারে জামিন ও হাইকোর্টের ওপর চাপের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারপর সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে এভাবে : “পুলিশি ভয়ের শাসনের প্রবর্তকেরাই এ নৈরাজ্যের জন্য দায়ী। কেবল বিচারব্যবস্থা নয়, সার্বিক ভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার যে পচন ধরেছে, সেটা স্বীকার না করলে এ থেকে বেরোনো যাবে না।”
কেবল বিচারব্যবস্থা নয়, সার্বিক ভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পচন ধরেছে।
সাব্বাশ! প্রথম আলো যদি এটা বোঝে তো আমাদের আর ভয় কী? কিন্তু শেখ হাসিনার ভয় আছে। হয়তো নিগৃহীত হবার এটাই রাজনৈতিক কারণ।
আমরা ‘আদালত অবমাননা’ রায়টি পড়বার জন্য অপোয় থাকব।

farhadmazhar@hotmail.com

(সূত্র: নয়া দিগন্ত)

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend