অস্তিত্ব সঙ্কটে এক সময়ের প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র

image_89274এক সময়ের প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র নদ এখন পানিহীন, স্রোতহীন ও গভীরতাহীন। শেরপুর ও জামালপুর জেলার সীমারেখা বরাবর বয়ে চলা এ নদটি এখন নব্যতা সঙ্কটেই নয়, পড়েছে অস্তিত্ব সঙ্কটেও।
 নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ। বিপর্যয়ের কারণে বিপন্নদশার এ নদী অববাহিকায় পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। আবহমান কালের কৃষি সেচ ব্যবস্থায় এখন ব্রহ্মপুত্র সহায়কই নয়। পানির সঙ্কটে বিপন্ন ব্রহ্মপুত্র নদ বর্ষাকাল ছাড়া বাকি সব মৌসুমে থাকে পানিশূন্য মরুময়। ব্রহ্মপুত্রে নেই দু’কূল ভাঙা উত্তাল স্রোতের রাশি। শুধু আছে ধূ-ধূ মরুভূমি। যে নদের বুক চিড়ে চলতো পাল তুলা নৌকো, সেখানে এখন চলে চাষের ট্রাক্টর ও শিশু-কিশোরের দূরন্তপনা।

 নদ-নদী মানে নিরবধি বয়ে চলা পানির উত্তাল স্রোত। কিন্তু হায় ব্রহ্মপুত্র! দু’কূল ছাপিয়ে আর বয়ে চলে না ব্রহ্মপুত্র। এখন ব্রহ্মপুত্র দেখলে নদীর সংজ্ঞা নিয়েই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। পানিহীন নদের বুকজুড়ে ধূ-ধূ বালুচরের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে সবুজ দূর্বাঘাসের গালিচা এবং স্থানীয় কৃষকদের সবজিসহ নানা ফসল ফলানোর মাঠ। এক সময় ব্রহ্মপুত্রের ছিল নৌ পরিবহন ব্যবসা। এখন তা বিলুপ্ত হয়েছে। চৈত্র-বৈশাখে ব্রহ্মপুত্র নদ পানিশূন্য। নদীর তলদেশ এখন বিস্তীর্ণ মাঠ।

download (2)

শেরপুর সদর উপজেলার চর পক্ষীমারী ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদে জেগে উঠা চর ডাকপাড়া গ্রামের কৃষকরা জানান, নদ শুকিয়ে এখন ফসলি জমি। এক সময় এর উপর দিয়ে পাল তোলা নৌকা আর পণ্যবাহী বিশালাকার পানসে নৌকা চলাচলের দৃশ্যটি এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়।
 গ্রামের আব্দুল আলী জানান, এই তো সেদিনের কথা, আমরা তখন (আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে )ওইখানে বাস করতাম। নদী থেকে আমাদের ঘর ছিল প্রায় হাজার ফুট দূরত্বে। প্রতিদিন ঘুম ভাঙতো নদীর কলতান শুনে। যেদিন কলতানের শব্দ বেশি শুনতে পেতাম সেদিন ভাবতাম নদী আমাদের তাড়া করতে আরো কাছে চলে এসেছে। সেদিন থেকেই আমরা ঘর-বাড়ি ভাঙতে শুরু করতাম অন্যত্র চলে যেতে।

 গ্রামের প্রবীন আফছার আলী (৯০) আলী জানান, নদী আমাদের অনেক দৌড়াইছে। আমার বাবা তিন বার আর আমি ঘর ভাঙছি ৭ বার। এখন নদী নিজেই ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই অনেক কিছু হারানোর বেদনা নিয়ে এই চরেই হারানো স্মৃতির মাটি কামড়ে পরে আছি। তিনি আরো জানান, স্বাধীনতার পরও দেখছি বর্ষা মওসুমে আমরা যখন নদীতে মাছ ধরতে গেছি, তখন আমার বাবা প্রায় ২০ কেজি ওজনের বোয়াল মাছ ধরেছিল একবার। এখানে শুধু বর্ষার সময়ই নয়, চৈত্র-বৈশাখে যখন কোথাও কোমর এবং কোথাও হাটু পানি ছিল সে সময়ও ওই পানিতেই আমরা অনেক মাছ ধরতাম। শেরপুর ও জামালপুর শহরের লোকজন প্রতিদিন ভোরে নদীর পারে এসে ভিড় করতো বড় বড় মাছসহ বিভিন্ন দেশীয় ছোট মাছ কিনতে। কিন্তু সেদিনের কথা এখন কেবলই স্বপ্নের মতো মনে হয়।

download (1)

 ডাকপাড়া গ্রামের পঞ্চায়েত সভাপতি ও সাবেক মেম্বার হুরমুজ আলী (৯৫)  জানান, এই নদী শুধু মানুষের ঘর-বাড়ি আর ফসলের ক্ষেতই নষ্ট করেনি। আমাদের অনেকের পেশাও বদল করতে হয়েছে নদীর কারণে। যেসব জেলে এ নদীতে এক সময় মাছ ধরতো এবং সেসব মাঝি-মাল্লারা বর্ষায় মানুষকে পারাপারে কাজে নিয়োজিত ছিল তারা এখন জীবন বাঁচাতে দিন মজুরের কাজ করছে। কেউ বা সবকিছু হারিয়ে দেশান্তর (দেশের অন্য স্থানে) হয়ে গেছে। ধূ-ধূ এই চরে এখন সামান্য পরিমাণ ধান এবং শীতের সময় সবজি চাষ করা হলেও পানি সংকটের কারণে পোষায় না। এক সময় রাতে ঘুম হতো না নদী ভাঙার শব্দ শুনে। আর এখন ঘুম হয়না পেটের ভেতর ক্ষুধার জ্বালায়।

download

জলবায়ু পরিবর্তন আর উজানের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেয়ার কারণে নদের এই করুণ দশা। হিমালয়ের মানস সরবর থেকে এ ব্রহ্মপুত্র নদটির উৎপত্তি। চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটান হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে নদটি যমুনা নাম ধারণ করে এর প্রধান অংশ জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে চলে যায়। জামালপুরের ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ হয়ে বাকি অংশ শেরপুর-জামালপুর সীমারেখা বরাবর বহমান এ নদ ময়মনসিংহ হয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করে।
 ২ হাজার ৮শ ৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পথে ভারত ও চীনে অসংখ্য বাঁধ থাকার কারণে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে চর জেগে উঠায় নদটি আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তবে সময় মতো এ নদের ড্রেজিং করা হলে বর্তমানের এ হাল হতো না বলে পরিবেশবাদীরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
আন্তর্জাতিকভাবে উজানের দেশগুলোর সঙ্গে পানি বন্টনসহ নদীর গতিপথ ও নাব্যতা ঠিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এ নদের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব বলে নদী বিষেজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend