তালপট্টির থাকা না থাকা ‘রহস্য’ এবং মামলার রায় হতে কিছু তথ্য

tallpotti-storyভারতের সাথে বাংলাদেশের সমূদ্রসীমা নিয়ে মামলার রায় হয়েছে এবং যথারীতি এই রায়কেও সরকার ‘সমূদ্র বিজয়’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। আদালতের রায়ে একটি মিমাংসাকে ‘সমূদ্র বিজয়’ হিসেবে সরকারী সাফল্য প্রচার করার কারণেই এই রায়টি নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আসলেই বিজয় হয়েছে না কী কিছু পরাজয়ও আছে? এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে এর পেছনের প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন।

পৃথিবীর দশ ভাগের সাত ভাগ হচ্ছে সমূদ্র। অগাধ সম্পদের অধিকারী সমূদ্রে মাৎস সম্পদ আহরনের জন্য আন্ত:দেশীয় সমূদ্রসীমা বিরোধ থাকলেও তা নিয়ে আইন করার প্রয়োজন খুব তীব্র ছিলো না। বিগত শতকের শেষার্ধে বহুজাতিক পেট্রোলিয়াম কোম্পানীগুলো সমূদ্রে পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান শুরু করলে মূলত: আন্তর্জাতিক সমূদ্রে অর্থনৈতিক এলাকা নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ সমুদ্র কনভেনশন আইন (আনক্লস) প্রনীত হয়। ১৯৯৫ সালে ভারত এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে, মিয়ানমার স্বাক্ষর করে ১৯৯৬ সালে এবং বাংলাদেশ ২০০১ সালে।

এই আইন অনুযায়ী একটি দেশ তার বেজলাইন হতে ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) রাষ্ট্রীয় সমূদ্রসীমা এবং আরো ১৮৮ নটিক্যাল মাইলসহ মোট ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সমূদ্রসীমা হিসেবে ঘোষনা করতে পারবে। মহীসোপানের আরো ১৫০ নটিক্যাল মাইল যোগ করে (২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মহীসোপান) সম্প্রসারিত অর্থনৈতিক সমূদ্রসীমা সর্বোচ্য ৩৫০ নটিক্যাল মাইল এর বেশি হবে না। বাংলাদেশের মহীসোপান এলাকা অনেক দীর্ঘ হওয়ায় এই সুবিধাটি বাংলাদেশের পাবার কথা। কনভেনশনের নিয়ম অনুসারে স্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যে একটি দেশকে তার ঘোষিত সমূদ্রসীমার দাবী উত্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে আবেদন করে এই সময় আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি করার বিধানও রয়েছে। ভারত এবং মিয়ানমার ২০০৮ সালে তাদের সমূদ্রসীমা আনক্লসে উপস্থাপন করে।

ম্যাপ-১

বাংলাদেশের উচিত ছিলো প্রয়োজনীয় জরিপ শেষে নিজেদের সমূদ্রসীমা নির্ধারণ করে তা আনক্লসে উপস্থাপন করা। তা না করে পেট্রোবাংলা ২০০৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী সমুদ্র অঞ্চলকে ২৮টি ব্লকে (৮টি অগভীর ও ২০টি গভীর) ভাগ করে বাংলাদেশের অগভীর ও গভীর সমূদ্রে গ্যাস ব্লকের মানচিত্র প্রকাশ করে তৃতীয় দফা বিডিং এর সিদ্ধান্ত নেয় এবং তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করে। ভারত এবং মিয়ানমার এই ঘোষিত ব্লকগুলো তাদের অর্থনৈতিক সমূদ্রসীমা পড়েছে দাবী করলে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার আনক্লসের পরিশিষ্ট ৭ ধারা অনুসারে ভারত ও মিয়ানমার ঘোষিত সমূদ্রসীমার বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করে। ফলে দুইটি ভিন্ন আদালতে বাংলাদেশকে তার সমূদ্রসীমা নিয়ে মামলায় জড়াতে হয়।

গত ১৪ মার্চ ২০১২ তারিখে মিয়ানমারে সাথে মামলার রায় পাওয়া গেছে। সেই রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ তার অগভীর সমূদ্রের ১৮ নং ব্লকের অংশবিশেষসহ গভীর সমূদ্র ব্লকের পাঁচটি পূর্ণব্লক (১৮,২২, ২৩, ২৭, ২৮) এবং ছয়টি ব্লকের (১২, ১৩, ১৭, ২১, ২৫, ২৬) অংশবিশেষ মিলে মোট ২২,০৪৯.৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা হারিয়েছে। আনক্লসের নিয়ম অনুযায়ী দ্বীপের জন্য আলাদা ইকোনমিক জোন পাবার কথা থকলেও সেন্ট মার্টিনের জন্য বাংলাদেশ আলাদা ইকোনমিক জোন পায়নি। মিয়ানমার তার আবেদনে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিনস দ্বীপকে তার দেশের নাফ নদীর পলিপাতন অংশ বিবেচনা করে একে সীমানা নির্ধারনের জন্য বিবেচনা না করে পৃথকভাবে দেখার জন্য দাবী করে (অনুচ্ছেদ ১৩১ ও ১৩২)। অথচ সেন্ট মার্টিনস একটি প্রবাল দ্বীপ, যার সাথে নদী বা পলীপাতনের কোন সম্পর্কই নেই। বাংলাদেশ এই বিষয়টি যথাযথভাবে তুলে ধরতে না পারায় মিয়ানমারের দাবী মেনে নিয়ে ট্রাইবুনাল কর্তৃপক্ষ সমদূরত্ব নীতির শুরুর বিন্দু নাফ নদীর মুখে নির্ধারণ করে। ফলে বাংলাদেশের সমূদ্রসীমা এখন আগের চেয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তরে সরে টেকনাফে চলে এসেছে; হাতছাড়া হয়েছে মৎস শিকারের উর্বর একটি এলাকা।

ভারতের সাথে সমূদ্রসীমা মামলার রায় পাওয়া গেছে গত ৭ জুলাই ২০১৪ তারিখে। এই দুইটি মামলাতে দুই আদালতেই বাংলাদেশের দাবী ছিলো ‘ন্যায্য দূরত্বে’র ভিত্তিতে সার্বভৌম সমুদ্র সীমা নির্ধারণ করা। কিন্তু দুইটি মামলাতেই রায় দেয়া হয়েছে ‘সমান দূরত্বে’র ভিত্তিতে রেখা টেনে। যেহেতু বাংলাদেশের সমুদ্রতীর লম্বায় দুই দেশের চেয়ে খাটো ফলে বাংলাদেশের ভাগে সমূদ্র এলাকা পাওয়া গেছে ন্যায্য পাওনার চেয়ে পরিমানে কম। এখন প্রশ্ন হলো, যে পদ্ধতি অনুসরণ করলে ন্যায্য সীমানা হবে না বলে আমরা আদালতে আরজি করলাম, সেই পদ্ধতিতেই আদালতের দেয়া কম সমূদ্রসীমা প্রাপ্তি কী করে বিজয় হলো?

আদালতে নিজেদের সমূদ্রসীমা হিসেবে বাংলাদেশ আনক্লজের নিয়ম মেনে তার প্রাপ্য জায়গাটুকুই দাবী করেছিলো। অন্যদিকে ভারত আনক্লসের নিয়ম ভেঙ্গে অনেক বেশি পূর্বদিকে সরে এসে বাংলাদেশের ১০টি খনিজ ব্লক দাবী করেছিলো। বাংলাদেশের সমূদ্রসীমার সর্বদক্ষিণ প্রান্তে গভীর সমূদ্র এলাকায় গ্রে জোন নির্ধারণ করে আদালত ২৫ হাজার ৬শত ২ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ভাগ করে ১৯ হাজার ৪ শত ৬৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশকে এবং ৬ হাজার ১শত ৩৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতকে প্রদান করায় বাংলাদেশ কী করে সমূদ্র বিজয় করলো! বিষয়টি এমন যে, দবির তার ছোট ভাই সগিরের ২৫ বিঘা জমি জোর করে দখল করে নেয়ায় মামলা হবার পর আদালত দবিরকে ৬ বিঘা আর সগিরকে ১৯ বিঘা হিসেবে মিমাংসা করে দিলো। এখানে কিছু না পাবার চেয়ে ১৯ বিঘা পেয়ে সগির যেমন মামলায় বিজয়ী হয়েছে বলা যায় না, তেমনি নিজের সমূদ্রসীমা থেকে ভারতের ভাগে ৬ হাজার ১শত ৩৫ বর্গকিলোমিটার চলে যাবার পর বাংলাদেশও বিজয়ী হয়েছে বলা যায় না।

তালপট্টি আছে, তালপট্টি নেই!
ভারত-বাংলাদেশ সমূদ্রসীমা মামলার সবচেয়ে অদ্ভূত দিক ছিলো, ভারত তার প্রাথমিক সমূদ্রসীমা দাবী থেকে শুরু করে প্রতিটি রিজয়েন্ডারের মানচিত্রেই বাংলাদেশের সাথে তার সীমান্তবর্তী দক্ষিণ তালপট্টি (নিউমুর) দ্বীপটি উল্লেখ করেছে অথচ বাংলাদেশ তার দাবী উত্থাপন থেকে শুরু করে কোন যুক্তিতর্কেই তালপট্টি দ্বীপটির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেনি। অথচ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটির অস্তিত্ব ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী টপোমানচিত্র থেকে শুরু করে বর্তমান গুগল আর্থ স্যাটেলাইট ইমেজেও রয়েছে। এটি একটি আংশিক দ্বীপ। জোয়ারের সময় ডুবে যায় এবং ভাটার সময় সামান্য জেগে ওঠে।

ম্যাপ-২

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার অদূরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি জোয়ারের সময়ও জেগে থাকতে দেখা যায়। ১৯৭৪ সালের আমেরিকান স্যাটেলাইট ইমেজ অনুযায়ী এর আয়তন ছিলো আড়াই হাজার বর্গমিটার। ধীরে ধীরে দ্বীপটির আয়তন ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে এর আয়তন ১০ হাজার বর্গমিটারে দাঁড়ায়। রেডক্লিফের দেশভাগ অনুযায়ী হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোত দক্ষিন তালপট্টির পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় দ্বীপটির মালিকানা বাংলাদেশ দাবি করলেও ভারত ১৯৮১ সালে সেখানে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে তাদের পতাকা ওড়ায়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঐ দ্বীপ রক্ষায় রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের নেতৃত্বে তিনটি নৌ জাহাজ পাঠান। এই বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ২০ আগস্ট বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মরহুম রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানের উদৃতি দিয়ে “দক্ষিণ তালপট্টি আমাদের : এম এইচ খান” শিরোনামে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিলো।

বাংলাদেশের এনসাইক্লোপেডিয়াতেও দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের বিষয়ে এন্ট্রি রয়েছে, এবং এটির মানচিত্রও দেয়া আছে। এমন কী ভারতের সাথে বাংলাদেশেল সমূদ্রসীমা বিষয়ক মামলার রায়ের ৭৭ পৃষ্ঠাতে দেয়া মানচিত্রেও এই দ্বীপের ছবি দেয়া আছে। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে সরকার কেন বারবার এই দ্বীপটির অস্তিস্ত অস্বীকার করছে? আদালতে নিজেদের প্রাথমিক দাবীরেখা উপস্তাপনের সময় তো বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ঠিকই হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোত ধরে মিমাংসারেখা টানার জন্য মানচিত্র তৈরী করেছিলো। এমন কী আদালতের রায়ে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাদের দাবীরেখা উত্থাপনের জন্য যে ম্যাপটি ব্যবহার করেছিলো সেটি ছিলো ১৮৮০ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে জরিপের ভিত্তিতে তৈরী বৃটিশ এডমিরাল চার্ট। বাংলাদেশ একটি ভুল তথ্য দিয়েছিলো যে এইটি ১৯৩৩ সালে তৈরী। এই ভুল তথ্যের কারণে এবং ম্যাপটি ১৯৪৭ সালের অনেক আগে তৈরী হওয়ায় ট্রাইবুনাল এই ম্যাপটির বদলে ১৯৪৭ এর কাছাকাছি সময়ের কোন মানচিত্র বা এরিয়াল ফটোগ্রাফ চেয়েছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ একটু খোঁজ খবর করলেই বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী টপোমানচিত্র সরবরাহ করে নিজের দাবী প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো। এটা করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের সাথে ভারতের স্থল সীমা পূন:নির্ধারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার পূর্ব দিকে সরে এসেছে এবং বাংলাদেশ তার স্ট্রাটেজিক রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ন দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের ওপর অধিকার হারিয়েছে। রায়ে বর্নিত দুই পক্ষের যুক্তি বিশ্লেষন করে বোঝা যায় এই মামলার শুরু থেকেই বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টির ওপর থেখে তার দাবী প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো এবং সরকারী মিডিয়া ব্যবহার করে ২০১০ সাল থেকেই দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি ডুবে গেছে বলে প্রচারণা চালাচ্ছিলো।

ম্যাপ-৩

রায়ের আরেকটি খারাপ দিক হচ্ছে প্রারম্ভিক মিমাংসাবিন্দু থেকে দক্ষিণ দিকে মিমাংসা রেখা টানার সময় সেটা ১৮০ ডিগ্রির পরিবর্তে ১৭৭.৫ ডিগ্রি কোনে আঁকা হয়েছে। ফলে বিগত জোট সরকারের আমলে যে গ্যাসব্লকগুলো নির্ধারণ করা হয়েছিলো সেগুলোর মধ্যে গভীর সমূদ্রের পাঁচটি ব্লকের পশ্চিম প্রান্ত থেকে কিছু করে অংশ ভারতের ভাগে পরেছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমূদ্র সীমার শুরুর বিন্দু যে রেখায় অবস্থিত তা ১২ কিলোমিটার নিজস্ব সমূদ্রসীমারেখা অনুযায়ী ৯০ এজিমাউথে ডিগ্রিতে সরলরেখা এক্ষেত্রে বিভাজন রেখা ১৮০ ডিগ্রিতে না আনতে পারাটা একটা ব্যার্থতা।

মামলার রায়ের পর সরকারের এই ভুল তথ্যসম্বলিত প্রচারণার পাশাপাশি আরেকটা হাস্যকর প্রচারণা হচ্ছে, বিএনপিন কেন মামলা করে নাই? বাস্তবতা হচ্ছে, ২০০১ সালে জাতিসংঘ সমুদ্র কনভেনশন আইন (আনক্লস) এ স্বাক্ষর করার পর ২০০৪ সাল থেকেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা জরিপের জন্য বিশেষায়িত জাহাজ কিনে বিস্তারিত জরিপ ও চার্ট তৈরির কাজ শুরু করে। ২০০৯ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মিয়ানমার সরকার সমুদ্রসীমা বিষয়ক জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (আইটিএলওএস) আবেদন করে, ভারত করে ২০১০ সালে। এমন অবস্থায় মামলা পরিচালনার দায়িত্ব তো বর্তমান সরকারের কাঁধেই চাপে। বরং আগের সরকার জরিপের ব্যবস্থা করে যাওয়ায় তাদের জন্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়া সহজ হয়েছিলো। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী হলেও নিজেদের দেশের প্রখ্যাত আর্ন্জাতিক আইনজীবী এবং সমূদ্র বিশেষজ্ঞদের এই ক্ষেত্রে সরকার ব্যবহার করতে পারতো। তাহলে ফলাফল হয়তো ভালো হতেও পারতো, কারণ ভারতের আইনজীবী শ্রীনিবাস রায় দুইবার আদালতের প্রসিডিংস এর ওপর আপত্তি উত্থাপন করলেও বাংলাদেশের নিযুক্ত বিদেশী আইনজীবী কোন আপত্তি উত্থাপন করেন নাই। এক্ষেত্রে ১৯৯১ সালে তেল-গ্যাস কোম্পানী সিমিটারের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি বাতিলের পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে দায়ের করা মামলার কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। সেই মামলায় তৎকালীন বিএনপি সরকার বিরোধী আওয়অমী লীগের নেতা ও প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকে বাংলাদেশের আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিলো এবং মামলায় জয়লাভও করেছিলো।

সমূদ্রসীমা নিয়ে মামলা কিন্তু এখনো বাকী আছে। কন্টিনেন্টাল সেলফ এর মধ্যে বাংলাদেশের অধিকার এবং এলাকা নির্ধারণ নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে মামলা লড়তে হবে। বর্তমান মামলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেই মামলার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া দুই মামলার রায়ের পর যে পোকায় কাটা সমূদ্রসীমা পাওয়া গেছে সেটাকেও যথাযথভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন। সমূদ্র আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে না দিয়ে দেশী কোম্পানী বাপেক্সকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। আইটিএলওএস এর রায়ে বাংলাদেশের পলিপাতনকে চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রতিবছর আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিলিয়ন টন পলিকে তাহলে কেন আমরা অন্যের সমূদ্রসীমায় চলে যেতে দেব? মেঘনা মোহনায় পলি সংগ্রহ করে সমূদ্র হতে আমরা ভূমি পূনরুদ্ধার করার ব্যবস্থা নিতে পারি। এক্ষেত্রে নেদারল্যাণ্ডস আমাদের জন্য উদাহরন হতে পারে।

উল্লেখ্য যে, নেদারল্যাণ্ডসের মোট আয়তনের এক পঞ্চমাংশ (৭,০০০ বর্গ কিলোমিটার) সমূদ্র হতে উদ্ধার করা। সমূদ্রে মাৎস শিকারের জন্য সুষ্ঠু নীতিমালা এবং মাৎস শিকারের সাথে জড়িতদের জন্য উন্নত সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে পারলে এই খাতে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা আয় করা সম্ভব। সমূদ্রসীমা নিয়ে বিজয়ের রাজনীতি না করে এসব বিষয়ে মনযোগী হওয়াটাই দেশে ও দেশের জনগনের জন্য উত্তম।

তথ্যসূত্র:

১/ ভারতের সাথে মামলার রায়ের কপি
২/ মিয়ানমারের সাথে মামলার রায়ের কপি

৩/ পেট্রোবাংলা প্রণীত বাংলাদেশের পেট্রোলিয়াম ব্লকসমূহের মানচিত্র

৪/ জাতিসংঘ সমুদ্র কনভেনশন আইন

৫/ বাংলাপিডিয়ায় তালপট্টি

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend