যে আগুন ছড়িয়ে পড়ল সব খানে

8_march_2বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের জ্বালাময়ী ভাষণ ও ভাষণের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে-মাধ্যমে, জনে-জনে; বাংলাদেশে ও বহির্বিশ্বে। এই ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালী উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।
এই ভাষণের পর ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ বাঙালী প্রস্তুত হতে থাকে। ৮ই মার্চ দেশের পত্রিকাগুলোর প্রধান শিরোনাম হয়ে ওঠে, ৭ই মার্চের ভাষণ। এই দিন সকাল সাড়ে ৮টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ সম্প্রচারিত হয়। তৎকালীন প্রদেশের অন্যান্য বেতার কেন্দ্র থেকেও তা রিলে করা হয়।
দেশের সব শ্রেণীর মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে ৭ই মার্চের ভাষণ। শুধু দেশে নয়, বিদেশী পত্র-পত্রিকাগুলোতেও ৭ই মার্চের ঘটনাবলী গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হয়। বিদেশী মিডিয়াগুলোতে এ বিষয়ে নানা বিশ্লেষণও প্রকাশ পায়। ৭ই মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে মার্কিন সাপ্তাহিক টাইমস্ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল— ‘The Poet of Politics’।
শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত বক্তৃতা মানুষকে কী রকম সম্মোহিত করেছিল, কী রকমভাবে মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল ৮ই মার্চে দেশবাসীর জাগরণে তা ফুটে ওঠে। এবং সে জাগরণ কেবল দেশে নয়, যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে— এই দিন ব্রিটেনে প্রবাসী প্রায় ১০ হাজার বাঙালী লন্ডনের পাকিস্তানী হাই কমিশনের সামনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ৮ই মার্চ ১৯৭১ সম্পর্কে লিখেছেন—
“…এঁরা কেউ স্বাধীনতা-স্বাধিকার তর্কের দিকে গেলেন না। এঁরা লোকমুখে এবং রেডিওতে শোনা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত বক্তৃতা লোকজনকে কি রকম সম্মোহিত এবং উদ্বুদ্ধ করেছে— সে কথাই বলে গেলেন ।
আজ আশুরা। হোসেনী দালান থেকে মহররমের মিছিল বেরিয়ে এতক্ষণে আজিমপুর গোরস্থানের রাস্তায় গিয়ে উঠেছে মনে হয়।আজিমপুর কলোনির এক নম্বর বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে মহররমের মিছিল গোরস্থানে যায়, এই রাস্তার ওপরই মহররমের মেলা বসে। বাচ্চারা তাদের মনোমত খেলনা কেনে, আমরা বঁটি, দা, বেলুনপিঁড়ি ইত্যাদি গোরস্থানের জিনিস কিনি।
কিন্তু এ বছর ছেলেদেরও মিছিল মেলা বা মেলা দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা নেই, আমাদের তো নেই-ই। গত এক সপ্তাহ ধরে বাংলার ঘরে ঘরেই কারবালার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কত মা ফাতেমার বুকের মানিক, কত বিবি সখিনার নওজোয়ান স্বামী পথে-প্রান্তরে গুলি খেয়ে ঢলে পড়ছে— বাংলার ঘরে ঘরে এখন প্রতিদিনই আশুরার হাহাকার, মর্সিয়ার মাতম। কিন্তু কবি যে বলেছেন, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া, ক্রন্দন চাহি না’, তাই বুঝি বাংলার দুর্দান্ত দামাল ছেলেরা ‘ত্যাগ চাই’ বলে ঘরের নিশ্চিন্ত আরাম ছেড়ে পথে-প্রান্তরে বেরিয়ে পড়েছে। গত সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম থেকে এমন লম্বা মশাল মিছিল বেরিয়েছিল যে বলবার নয়। আমরা দেখি নি— রুমী, ফকির, শরীফ এরা তর্কের কচকচির মধ্যে রাত এগারোটা করে ফেলেছিল। খবরটা জানা গেল আমার বান্ধবী রোকেয়ার টেলিফোনে। ওদের বাড়ি ধানমণ্ডি আট নম্বর মেইন রোডের ওপর। ওদের বাড়ি সামনে মিরপুর রোড দিয়েই সব মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যায়। রোকেয়া বলল, ‘জানিস মশাল মিছিল দেখে আমারও রাস্তায় নেমে যেতে ইচ্ছে করছিল।’”
৭ই মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশের পরিস্থিতি বদলে যায়। সারা দেশে চলতে থাকে অসহযোগ। বিচারপতি থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয় অসহযোগে। মূলত তখন থেকেই সারা দেশ চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশে। হাইকোর্ট থেকে সাধারণ মানুষ সবই চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর কথায়। এমন কি সিনেমা হলগুলোতে পাকিস্তানী পতাকা প্রদর্শন ও পাকিস্তানী জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন বন্ধ রাখে হল মালিকরা। মুক্তি প্রত্যাশী মানুষের ঘৃণা আর প্রতিবাদের মুখে সেনাবাহিনী ব্যারাকে আশ্রয় নেয় এই দিন।
১৯৭১ সালের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নামকরণ শুধু ‘ছাত্রলীগ’ ঘোষণা করা হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো হয়।
গণমানুষের মনে যে আগুন জ্বেলে দিলেন মুজিব, সে আগুন শুধু সামনেই ছুটে চলল। অসত্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত জেনে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে এল অপশক্তির বিরুদ্ধে। মুক্তিপাগল বাঙালী জেগে ওঠল অগ্নিমন্ত্রে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend