ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ ৫ মিনিটের মরণ-ঘূর্ণি, অতঃপর সলিল-সমাধি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
হারিয়ে যাওয়ার এক মাস পরেও ভারত মহাসাগরের অতল জলে চলছে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ বিমানটির ধ্বংসাবশেষের খোঁজ। গত ৮ মার্চ কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয় বিমানটি। তাই নিখোঁজ অবস্থায় এক মাস কেটে যাওয়ার পর বিমানটির যাত্রী বা ক্রুদের মধ্যে আর বেঁচে নেই বলেই মেনে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ আর নিহতদের স্বজনেরা। কিন্তু যদি ধরেই নেয়া হয় বিমানটি অস্ট্রেলিয়া উপকূলে ভারত মহাসাগরে বিদ্ধস্ত হয়েছে তাহলে কেমন ছিল এর যাত্রীদের শেষ মুহূর্তের অভিজ্ঞতা?
এমএইচ-৩৭০ বিমানটির যাত্রীদের শেষ মুহূর্তের সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সবাইকে ধারণা দিতে সম্প্রতি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞ অস্ট্রেলীয় পাইলট ও ‘সিমুলেটর’ বিশেষজ্ঞ জিওফ্রে টমাস। তাতে দেখা যাচ্ছে বোয়িং ৭৭৭ এর সিমুলেটরে বসে রয়েছেন জিওফ্রে। এমএইচ ৩৭০ এর ককপিটে যা যা হয়ে থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, সেই সমস্ত কিছুই ওই সিমুলেটরের ককপিটে করে দেখাচ্ছেন তিনি। আর তা থেকেই পরিষ্কার, মৃত্যুযন্ত্রণাকে খুব কাছ থেকে অনুভব করেছিলেন যাত্রীরা। ঘুমের মধ্যে পরম শান্তিতে নয় বরং শেষের ওই পাঁচ মিনিট তারা কাটিয়েছিলেন ভয়াবহ মৃত্যুর অপেক্ষায়।
ধরে নেয়া যাক, বিমানের দুটি ইঞ্জিনই তখন বন্ধ। ২৩ হাজার ফুট উঁচু থেকে অবিশ্বাস্য গতিতে নিচে নেমে আসছে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর। সাংঘাতিক ঝাঁকুনি ও প্রবল ঘূর্ণি তখনই যাত্রীদের বুঝিয়ে দিয়েছিল মৃত্যু আসন্ন। তখন কারো কারো হয়তো চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল প্রিয় মানুষ, সন্তান বা বাবা-মায়ের মুখ।
অবশ্য এ সবই জিওফ্রের বিশ্বাস। গত এক মাস ধরে মালয়েশীয় সরকার, সেনাবাহিনী আর উপগ্রহ চিত্র থেকে পাওয়া তথ্যগুলি জোগাড় করেছেন তিনি। সে সবের ভিত্তিতেই ‘সিমুলেটর’ এর ককপিটে এমএইচ -৩৭০ এর শেষ মুহূর্তের ‘অ্যাকশন’ ফুটিয়ে তুলেছেন জিওফ্রে। তার সন্দেহ, বিমানটির পাইলট ক্যাপ্টেন জাহারি আহমেদ শাহই রয়েছেন উধাও রহস্যের নেপথ্যে। সিমুলেটরের ভিডিওটি দেখার পর সে সন্দেহ জোরদার হচ্ছে অনেকের মনেই।
এই সিমুলেটর জিনিসটা ঠিক কী? সহজ ভাবে বলতে গেলে এটি আসলে মাটিতে দাঁড় করিয়ে রাখা বিমান। প্রধানত পাইলটদের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের জন্যই এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিমানে যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, সিমুলেটরের ভিতরেও সে সবই থাকে। সিমুলেটরের ককপিট দেখতেও আসল বিমানের ককপিটের মতো। আকাশে ওড়ার সময়ে বিমানের ভিতরে যে কম্পন, শব্দ, অনুভূতি হয়, ঠিক একই রকম অভিজ্ঞতা হয় সিমুলেটরেও।
এ রকমই এক সিমুলেটরে এমএইচ ৩৭০ এর শেষ মুহূর্তগুলি ফুটিয়ে তুলেছেন জিওফ্রে। তথ্য অনুযায়ি এমএইচ- ৩৭০ এক বার ৪৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে গিয়েছিল, আবার ২৩ হাজার ফুটে নেমে এসেছিল। জিওফ্রেও সিমুলেটরের উচ্চতা সেই মতো পরিবর্তন করেছেন। বিমানটি যেভাবে অভিমুখ ঘুরিয়েছিল ঠিক সে ভাবেই সিমুলেটরের মুখ ঘুরিয়েছেন তিনি। এক সময় বন্ধ করে দিয়েছেন সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে শেষের পাঁচ মিনিটের অভিজ্ঞতাই ভয়াবহ। জিওফ্রে দেখাচ্ছেন, বিমানের জ্বালানি তখন প্রায় শেষ। প্রথমে বাম দিকের ইঞ্জিন বন্ধ হলো। তার মিনিট খানেক পর ডান দিকের ইঞ্জিন। এরপর সরাসরি ২৩ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে ভয়াবহ গতিতে নিচের দিকে নামতে থাকে বিমানটি। ককপিটে তখন বেজে উঠছে একাধিক বিপদসঙ্কেত। থরথর করে কাঁপছে বিমান। ভেতরে যাত্রীদের চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্না। তার পর একসময় সরাসরি ভারত মহাসাগরের অতল গর্ভে সলিল সমাধি সবার।
যে সময়ে বিমানটি নিচের দিকে নামতে শুরু করেছিল সে সময়ে অবশ্য যাত্রীদের ঘুমিয়ে থাকার কথা। কিন্তু জিওফ্রের ধারণা, বিমানের ঝাঁকুনি আর ঘূর্ণি শুরু হতেই জেগে গিয়েছিলেন যাত্রীরা। হয়তো কেউ কেউ আসন থেকে ছিটকেও পড়ে গিয়েছিলেন। কারণ রাতের দিকে পাইলট সতর্ক না করলে সচরাচর ‘সিটবেল্ট’ বেঁধে রাখেন না যাত্রীরা। সব মিলিয়ে যাত্রীদের মানসিক অবস্থার কথা ভেবেই কেঁপে উঠছেন অনেকে।
জিওফ্রের প্রশ্নটা অবশ্য অন্য। বোয়িং ৭৭৭ এর মতো বিমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত জোরদার। সে ক্ষেত্রে এমন দুর্ঘটনা প্রায় অসম্ভব। তবে পাইলট যদি গোটা বিষয়টির নেপথ্যে থাকেন সে ক্ষেত্রে এমনটা যে অপ্রত্যাশিত নয়, সেটাও মেনেছেন জিওফ্রে। অর্থাৎ ঘুরেফিরে সন্দেহ স্থির হয় পাইলট জাহারি আহমেদ শাহের দিকেই। তবে জাহারিকে সরিয়ে যাত্রী সেজে থাকা অন্য কোনও পারদর্শী পাইলটের পক্ষেও এই কুকীর্তি করা সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি। যদিও সবটাই এখন অনুমান।