মামলার চাপে হেফাজত, ‘সমঝোতার চেষ্টায়’ সরকার

hafazot
নাশকতার অভিযোগে রাজধানীসহ সারা দেশে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের করা ৮৩টি মামলা সংগঠনটির কর্মকাণ্ডে বড় ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হেফাজতকে মামলার জালে আটকে সরকার সমঝোতার চেষ্টা করছে বলে দাবি করছেন অনেক নেতা। তবে এ দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে সরকারের সরাসরি সমালোচনা বন্ধ করেছেন সংগঠনের একটি পক্ষ।

সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের স্ববিরোধী বক্তব্য এবং গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সরকারের দূরত্বের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। বাংলামেইলের অনুসন্ধানে সংগঠনের সূত্র এবং পুলিশ সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এখনও মামলার তদন্ত ও নজরদারির মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামকে চাপে রেখেছে সরকার।
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গত বছরের ৫ মে’র সমাবেশ ঘিরে সহিংসতাসহ সারা দেশে দায়েরকৃত ৮৩ মামলায় হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। এসব মামলায় অজ্ঞাত ৪০ হাজার নেতাকর্মী আসামি বলে উল্লেখ থাকলেও ঘুরে ফিরে এসেছে দুইশ ব্যক্তির নাম।

রাজধানীর ১৩টি মামলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে। বাকি মামলাগুলোর তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

এদিকে চট্টগ্রামে লালখান বাজার মাদ্রাসায় গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি ইজহারুল ইসলাম ও তার ছেলে হারুন ইজহারসহ নয় জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। এ নাশকতার ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ৭ অক্টোবর। হেফাজতের রিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার মধ্যে এটিই প্রথম অভিযোগপত্র দায়েরের ঘটনা।

হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতা দাবি করছেন, সরকারবিরোধী কর্মসূচী দিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করলেই মামলার ‘ভয়’ দেখিয়ে নেতাদের নিষ্ক্রিয় করছে পুলিশ ও র‌্যাব। তবে কেউ কেউ এ ব্যাপারে এখন মুখ খুলতে নারাজ।

সংগঠন সূত্র জানিয়েছে, মামলা এবং গণজাগরণ মঞ্চ ইস্যুতে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতার দরজা খুলেছে সরকারের। গণজাগরণ মঞ্চকে ‘নির্লিপ্ত’ করার প্রস্তাব এসছে হেফাজতের পক্ষ থেকে। আর এ প্রস্তাবে নমনীয় হতে হেফাজতকে বাধ্য করা হয়েছে মামলার চাপের মাধ্যমে।

তবে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হেফাজতের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত চলছে। ৫ মে’র ঘটনার পর থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ডিবির তদন্তাধীন ১৩ মামলার তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়েরকৃত এসব মামলায় হেফাজতের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা, জামায়াতসহ সাতটি ইসলামি দলের নেতা এবং বিএনপির কয়েকজন নেতাও ফেঁসে যাচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, মুফতি ওয়াক্কাস ও মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে সরকারবিরোধী সহিংসতা চালানোর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে বলেও দাবি করছে পুলিশ।

হেফাজতের মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিষয়টি ভিত্তিহীন দাবি করে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘সহিংসতার অভিযোগেই সারা দেশে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৮৩টি মামলা হয়েছে। সব মামলার তদন্ত চলছে। লালখানের মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে বলে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। বাকিগুলো হয়নি।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমাদের তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। হেফাজতের সংশ্লিষ্ট মামলায় অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েকজন জামিনে আছেন। আমরা নাশকতাকারী এবং এর পেছনে ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করছি।’

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও আল্লামা আহমদ শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীর সঙ্গে মামলার ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক সদস্য মাওলানা এম এ করিম ইবনে মছব্বির দাবি করেন, ‘বর্তমানে দেশের স্থীতিশীল অবস্থার কারণেই কর্মসূচী থেকে আমরা সরে গেছি, মামলার ভয়ে নয়। আমাদের বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা মামলা টিকবে না।’

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘মামলা দিয়ে কর্মসূচি না করতে আমাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। কর্মসূচি আহ্বান করলেই র‌্যাব-পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তারের ভয় দেখায়। তাই অনেকে আবার সরেও পড়ছে। এ কারণে একটি গোপন সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সরকার এখন গণজাগরণ মঞ্চকে স্থগিত করে আমাদের নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করছে।’

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ মে রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, কোরআন শরিফ পোড়ানো, পুলিশের ওপর হামলা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এসব সহিংসতার পর গত বছরের ১৬ জুন পর্যন্ত রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও রমনা থানায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৪০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

৬ মে সকালের সহিংসতার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও সদর থানায় আরও তিনটি মামলা হয়।

এছাড়া গত বছরের ৬ এপ্রিল হেফাজতের সমাবেশের দিন একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ঘটনায় শাহবাগ থানায় আরেকটি মামলা হয়। এসব মামলায় হেফাজতে ইসলামের ৪০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে তিনটি হত্যা মামলা। সবকটির মামলার বাদী হয়েছে পুলিশ। হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের ৩৩ নেতাসহ জেলা পর্যায়য়ের নেতা মিলে দুইশ ব্যক্তি বেশির ভাগ মামলায় আসামি। প্রত্যেকে গড়ে ১২-১৩টি মামলার আসামি। মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৮ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতাকেও।

সূত্র জানায়, হেফাজত নেতাদের মধ্যে বেশির ভাগ মামলায় আসামি সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা জোনায়েদ বাবুনগরী, মুফতি ওয়াক্কাস, চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি মাওলানা মইনুদ্দিন রুহী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফরিদ উল্লাহ, মাওলানা শামসুল আলম, মাওলানা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মাওলানা তাজুল ইসলাম, মাওলানা জুলফিকার জহুর, জামায়াত নেতা মাওলানা হাফিজুর রহমান, হাজী জালাল উদ্দিন, এমএ কাসেম ফারুকী, হেফাজত নেতা মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মাওলানা মহিউদ্দিন, বগুড়া জেলার সদস্য সচিব ও ইসলামী ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলুল করিম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা হেফাজতের সভাপতি আল্লামা মনিরুজ্জামান সিরাজী, নাসিরনগর থানার সভাপতি মাওলানা সামসুদ্দিন, নরসিংদী সভাপতি শওকত হোসেন সরকার ও কুমিল্লার মুরাদনগর থানা হেফাজতের প্রধান মুফতি আমজাদ হোসেন প্রমুখ।

ডিবির কর্মকর্তরা জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে ১৩টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব ডিবির কাছে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া মতিঝিল থানা পুলিশ তিনটি মামলা, পল্টন থানা পুলিশ ২০টি মামলা এবং রমনা থানা পুলিশ তিনটি মামলা তদন্ত করছে।

গত বছরে ৩ সেপ্টেম্বর ১৮ দলের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুফতি ওয়াক্কাসকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে মুফতি ওয়াক্কাস স্বীকার করেছেন, গত ৫ মে হেফাজতের সমাবেশের সময় তিনি মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এবং অবস্থানের নির্দেশনা দিয়েছেন।

তদন্তে ডিবি জামায়াতে ইসলামী এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ছাড়া আরও পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। এ দলগুলো হলো- নেজামে ইসলাম, খেলাফতে মজলিস, খেলাফতে আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট ও মুসলিম লীগ।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, তদন্তে প্রমাণ পাওয়ার পর সাতটি দলের শতাধিক নেতাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অর্থের যোগানদাতা উস্কানিদাতাদের শনাক্ত করছে গোয়েন্দারা।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুল রহমান খান শুভ্রকে গ্রেপ্তারের পর হেফাজতের সমাবেশে কথিত নিহতদের তালিকা উদ্ধার করে ডিবি। এ মামলার তদন্ত থেকেও হেফাজতের মামলাগুলোর তদন্ত সূত্র পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, ডিবির ১৩টি মামলার মধ্যে পাঁচটি মামলার তদন্ত অনেকটাই গুছিয়ে ফেলা হয়েছে। এ মামলাগুলো হলো- গত বছরের ৬ মে মতিঝিল থানায় দায়ের করা থানায় হামলা ও বিস্ফোরক উপাদান সংক্রান্ত ১৩ নম্বর মামলা, পল্টন থানায় আহাদ পুলিশ বক্সের হামলার ঘটনায় প্রায় একই ধারার ১৮ নম্বর মামলা, হামলা ও হত্যার অভিযোগে দায়ের করা ৪২ নম্বর মামলা এবং হামলা, বিস্ফোরক ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা ১১ ও ১২ নম্বর মামলা।

এসব মামলার মধ্যে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান হত্যা মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

এদিকে তদন্ত শেষে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক আইনে দায়ের হওয়া মামলায় নয়জনকে আসামি করে অভিযোগপত্রটি চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের সাধারণ নিবন্ধন (জিআরও) শাখায় জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা, খুলশী থানার এসআই লোকমান হোসেন।

অভিযুক্তরা হচ্ছেন- লালখান বাজার মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি ইজহারুল ইসলাম ও তার ছেলে মুফতি হারুন ইজহার, সংগঠনের সদস্য- আবদুল হাই ওরফে সালমান, হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ ইছহাক, মনির হোসেন, আবদুল মান্নান, তফসির আহমেদ ও মোহাম্মদ জুনায়েদ।

অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অশান্ত করতে পরিকল্পিতভাবে নাশকতার জন্য আসামিরা গত বছরের ৭ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে নগরীর লালখান বাজারে জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে বোমা বানাতে যায়। এতে পাঁচজন ছাত্র আহত হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই ছাত্র মারা যায়। গ্রেনেডের মত শক্তিশালী বিস্ফোরক মজুদ করার অভিযোগও আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

সংগঠন সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলামের মূল কেন্দ্র চট্টগ্রাম। তাই সেখানকার একটি মামলায় অভিযোগপত্র দেয়ায় সমঝোতার প্রশ্নে চিন্তায় পড়ে সংগঠনটি। এরপর সম্প্রতি আল্লামা শফির বক্তব্যের মোড় এবং গণজাগরণ মঞ্চের ওপর সরকারি দলের সংগঠনের হামলায় সমীকরণ মিলে যাচ্ছে। তাই হেফাজতের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীর মধ্যে এখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend