ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। পণ্য আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে এবং অস্তিত্বহীন প্রকল্পে নেওয়া হচ্ছে এসব ঋণ। দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এ ধরনের ঋণের জন্য বেছে নেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকেই। এভাবে ব্যাংক ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় পাচারকারী হিসেবে নাম উঠেছে বিসমিল্লাহ গ্রুপের। এর বাইরেও রয়েছে প্রভাবশালী আরও কয়েকটি গ্রুপ। টাকা পাচারের এসব ঘটনার সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে এক শ্রেণীর ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীর। জানা গেছে, পাচার অর্থের বেশির ভাগই মালয়েশিয়া, ব্যাংকক ও দুবাই চলে যাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় ওই দেশগুলোকেই বেছে নিচ্ছেন পাচারকারীরা। সেখানে আবাসিক ভবন, জমি কেনা, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে এ অর্থ। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতেও অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক থেকে এভাবে শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে থাইল্যান্ডে পাচার করেছেন এক ব্যবসায়ী। দেশটিতে তিনি ব্যবসা খুলে বসেছেন। ব্যাংক তাকে এখন ঋণখেলাপি হিসেবে দেখাচ্ছে। সূত্র আরও জানায়, ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে রূপালী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোপাটের কয়েকটি অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ হয়েছে। ঋণ দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকা পাচারের সুযোগ করে দেওয়ার পেছনে রূপালী ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে। জনতা ব্যাংক থেকেও ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যাংকটির রমনা করপোরেট ও লোকাল অফিস থেকে ভুয়া দুটি কোম্পানির (নিটওয়্যার ও একটি টাওয়েল তৈরি প্রতিষ্ঠান) নামে ঋণ দেখিয়ে ৩৫০ কোটি টাকা আত্দসাৎ করা হয়। এ ছাড়া ভুয়া এলসির মাধ্যমে ৩৯২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিসমিল্লাহ গ্রুপ। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ঋণ জালিয়াতির ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্প্রতি বহুল আলোচিত হয়েছে এই বিসমিল্লাহ গ্রুপের নাম। পাঁচটি ব্যাংক থেকে অন্তত এক হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা পালিয়ে বিদেশ গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে হলমার্ক-বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ নিয়ে টাকা পাচারের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে ঘটেছে আরও অভিনব ঘটনা। সোনালী ব্যাংক থেকে এমন একজন বিদেশিকে ঋণ দেওয়া হয়েছে যার কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। জয়েন্ট ভেঞ্চার এগ্রিমেন্ট না নিয়ে ওই বিদেশির নামে অনিয়মিত ঋণপত্র দেখানো হয়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পরও পিএডি দায় সৃষ্টি করা হয়েছে। ঋণের এই পুরো টাকাই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ ছাড়া ফরেন বিল পারচেজ নেগোসিয়েশনের নামে বিদেশে পণ্য পাচার, গ্রাহকের সঙ্গে শাখা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনিয়মিত (বিটিবি) এলসির মাধ্যমে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে সোনালী ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অপর্যাপ্ত জামানতের বিপরীতে ওয়ান গ্রুপের নামে অতিরিক্ত ঋণ সৃষ্টি করে ব্যাংকটির প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ দায় সৃষ্টি করেছেন সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা। একই শাখা থেকে মেসার্স প্রিটেক্স (প্রা.) লিমিটেড নামে একটি অস্তিত্বহীন প্রকল্পে জামানত ছাড়াই কোটি কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। নাম-পরিচয়হীন বিদেশি ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়ার ঘটনাটি সোনালী ব্যাংকের এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই জয়েন্ট ভেঞ্চার এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যার এ দেশীয় অংশীদার রয়েছে।’ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বছরে গড়ে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে দেশ থেকে। বেশির ভাগ অর্থই গেছে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে। সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রতিবছর নামে-বেনামে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেটি ছোট এ দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশের অর্থ পাচারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা সংস্থার গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ২৮০ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বা ২২ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর আগের বছর ২০১০ সালে পাচার হয়েছিল ২১৯ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার বা ১৭ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার গড়ে ৮০ টাকা ধরে)। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) ‘ইলিসিট ফাইন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০২-১১’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন আরও বলছে, এই এক দশকে অন্তত এক হাজার ৬০৭ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার বা এক লাখ ২৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা অবৈধভাবে বাইরে চলে গেছে। এর ফলে বিশ্বের যে ১৫০টি উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে, সে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। ব্যাংক ঋণের টাকা পাচার হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করে দেওয়ার কাজটি পুরোপুরি প্রতারণামূলক জালিয়াতি। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ ধরনের কাজে প্ররোচনা দিয়ে থাকে ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা। বেনামি প্রকল্প এবং ভুয়া এলসির মাধ্যমে নেওয়া ঋণের অর্থই মূলত পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে বিদেশি এলসির ক্ষেত্রে এটা হয় না, স্থানীয় এলসির ক্ষেত্রে এই ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।’ এ জালিয়াতি বন্ধ করতে না পারলে ব্যাংকিং খাত হুমকিতে পড়বে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এলসি জালিয়াতিতে জড়িতদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে পারলে হয়তো অর্থ পাচার কিছুটা বন্ধ করা যেত। তবে এ ধরনের অপরাধ তদন্তে দুদকের যে সক্রিয় ভূমিকা থাকার কথা ছিল, সেটি না থাকাতেই টাকা পাচারের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।’ অর্থ পাচার ও ভুয়া এলসি বন্ধে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘ব্যাংকের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ভুয়া এলসির মাধ্যমে টাকা পাচার করা হচ্ছে, এটা ঠিক। ব্যাংকের এলসি বিল পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু শিপমেন্ট কীভাবে হলো বা এটা আদৌ হয়েছে কিনা, এটা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদিও এ ধরনের পর্যবেক্ষণ খুবই জটিল বিষয়। পুলিশি ব্যবস্থায় এটা বন্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কমিটেড হতে হবে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আরও সতর্কভাবে কাজ করতে হবে।