নির্বোধের ইন্টারনেট
আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত ইন্টারনেট হচ্ছে ন্যারোব্যান্ড বা মোবাইলভিত্তিক ব্রডব্যান্ড। ইন্টারনেট বলতে এখন চার ধরনের সেবাকে বোঝায়। প্রথম ধরনের সেবাটি হলো তারভিত্তিক। কিছু আইএসপি ডিশের তারের মতো তারের সাহায্যে পাড়ায় পাড়ায় ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেয়। ৬৪ বা ১২৮ কেবিপিএস বা তার বেশি শেয়ারড ব্যান্ডউইদথ প্রদান করাকেই তারা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বলে। কিন্তু শেয়ারড হবার ফলে কার্যক্ষেত্রে এসব কানেকশন প্রায় জিপিআরএস বা এজ-এর মতোই স্বল্পগতিসম্পন্ন হয়ে থাকে। আমি একে কোনভাবেই ব্রডব্যান্ড বলতে পারিনা। কারণ এভাবে প্রকৃত ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেয়া সম্ভব। যদি এই ব্যান্ডউইদথটিকে শেয়ারড না করে ডেডিকেটেড করা হয় তবেই এটিকে ব্রডব্যান্ড হিসেবে চিহ্নিতকরা যেতে পারে।
আমাদের দেশে ব্রডব্যান্ড সেবা দানের দ্বিতীয় উপায়টি হলো ওয়াইম্যাক্স। বিশ্বজুড়ে ওয়াইম্যাক্স একটি স্বীকৃত তারবিহীন ইন্টারনেট প্রযুক্তি। তবে এই প্রযুক্তি সমস্যাবিহীন নয়। দুনিয়ার অনেক দেশে এই প্রযুক্তিতে সফল হতে পারেনি। আমাদের দেশেও এর অবস্থা খুব ভালো নয়। এই সেবা দানের জন্য দেশে দুটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে। এই সার্ভিস প্রভাইডারদের একটি দেশের ৪০টি জেলায় সেবা আছে বলে দাবি করে। তবে বাস্তবে এই সেবা ৯টি জেলাতে পাওয়া যায়। অন্য একটি প্রতিষ্ঠান দেশের ঢাকাসহ আরও কয়েকটি শহরে সেবা দিতে পারে বলে বিজ্ঞাপন প্রদান করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অবস্থা মোটেই ভাল নয়। ওয়াইম্যাক্স নিয়ে সমস্যা হলো যে, এটি কোথায় কাজ করবে আর কোথায় কাজ করবে না সেটি বলা কঠিন। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো খুবই খারাপ। আমরা একটি ওয়াইম্যাক্স সার্ভিস প্রভাইডারের কাছ থেকে একটি মডেম কিনে নিজের অফিসে কাজ করতে সক্ষম হলাম। কিন্তু সেই মডেমটি সেগুন বাগিচায় আমাদের একজন কর্মী তার বাসায় ব্যবহার করতে পারলেন না। দেশের বিদ্যমান ওয়াইম্যাক্স সেবা থেকে এই ধারণাটি নিশ্চিতভাবেই করা যায় যে আগামীতে এই সেবা ওয়াইম্যাক্স হিসেবে থাকবে না। এটি একটি মৃত প্রযুক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
তৃতীয় সেবাটি একটি মোবাইল কোম্পানির। তারা ইভিডিও নামের একটি মোবাইল ব্রডব্যান্ড সেবা প্রদান করে। এর গতি প্রায় ৪ মেগাবিট পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের কাজের বর্তমানের চাহিদার তুলনায় একে যথেষ্ট বলা যেতে পারে। এটি যারা চলতে ফিরতে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তাদের জন্য এই সেবাটি তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে এই সেবাটিও দেশের সর্বত্র পাওয়া যায় না। ওরাও কয়েকটি শহরের মাঝে সীমিত হয়ে আছে। গ্রামে এই সেবা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যেহেতু গ্রামে ব্যবহারকারী তেমন নেই সেহেতু এই সেবার সম্প্রসারণও বাণিজ্যিকভাবে হয়ে ওঠছে না। তবে যেহেতু এটি মোবাইল প্রযুক্তি নির্ভর সেহেতু যেখানে ব্রডব্যান্ড বা ইভিডিও পাওয়া যায় না সেখানে সাধারণ মোবাইল ইন্টারনেট হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা যায়।
চতুর্থ ও সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রডব্যান্ড পদ্ধতিটি হলো থ্রিজি। ২০১২ সালে সরকারি সংস্থা টেলিটক পরিক্ষামূলকভাবে এই সেবা প্রদান করা শুরু করে। ২০১৪ সাল নাগাদ তারা অনকেগুলো জেলা শহরে থ্রিজি সেবা দিতে পেরেছে। তবে থ্রিজির নিলাম হওয়ার পর বেসরকারি মোবাইল অপারেটররা বেশ দ্রুত থ্রিজির কভারেজ তৈরি করছে। ১৪ সালের জুনে সকল জেলা শহর থ্রিজি নেটওয়ার্কের আওতায় আসার কথা। ধারণা করা যায় যে এই কভারেজের ফলে অন্তত জেলা শহর পর্যন্ত দ্রুতগতির ইন্টারনেট পাওয়া যেতে পারে।
অন্যদিকে ইন্টারনেটের বড় সংকটের নাম এর মূল্য। এখনো দেশে ইন্টারনেটের দাম অনেক বেশি। এর ওপরে আছে ভ্যাট। এই দামে সাধারণ মানুষ এই সেবা ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে না।
এমন একটি অবস্থা থেকে ২০১৫ সালের মাঝে জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগের কাছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছানো কেবল কঠিন হবে নাÑ প্রায় দুরূহ মনে হতে পারে। এই বাক্যটি উচ্চারণ করছি আমি এজন্য যে, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য এখনো তেমনভাবে ইতিবাচক কোনো কাজ করা হচ্ছেনা। যেসব অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো এরই মাঝে সম্পন্ন হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেগুলোও হয়নি। আমাদের বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরও অনেক স্পষ্ট হবে।
আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি যে আমাদের ইন্টারনেট সেবার দুটি সেবার প্রথমটি হলো গতির অভাব। মোবাইল ফোনের নিম্নগতির ইন্টারনেটে কার্যত আমরা কিছুই করতে পারি না। ইভিডিওকে কাজে লাগানো হয়নি। এমনকি টেলিটক যথেষ্ট দ্রুত গতিতে সামনে যেতে পারেনি।
সাবমেরিন ক্যাবল : ইন্টারনেটের প্রসারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এর অবকাঠামো তৈরি ও সহজলভ্য করা। কিন্তু এক সময়ে এদেশের সরকারের কাছে ইন্টারনেটের কোনো গুরুত্বই ছিল না। তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার বুঝেই ওঠেনি যে, এর কোনো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নব্বই দশকের শুরুতে দুনিয়াজোড়া ইন্টারনেটের বিস্তার হতে থাকলেও ১৯৯৬ সালের আগে এদেশে ইন্টারনেট বলতে ছিল কেবল অফলাইন ই-মেইল সেবা। কোনো কোনো মানুষ ঢাকা থেকে বিদেশে ফোন করে ই-মেইল আদান প্রদান করতেন। ৯৬ সালে আমরা ভি-স্যাট স্থাপন করে অনলাইন ইন্টারনেটের যুগে পা ফেলি। সেই পা ফেলা ছিল খুবই দুর্বল। কারণ ইন্টারনেটের জন্য প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত দ্রুত গতির সংযুক্তি। সেটি আমাদের ছিল না। সেটি আমরা নিতেও চাইনি। আমাদের নীতি নির্ধারক, সরকার ও আমলারা এর গুরুত্বই বুঝেনি। সেই কারণে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সামনে দিয়ে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যখন সাবমেরিন ক্যাবল লাইন (সিমিউই-৩) স্থাপিত হয়, তখন বেগম খালেদা জিয়া সেই লাইনে যুক্ত না হবার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ সেই সংযুক্তিটি ছিল বিনামূল্যের। তখনকার সরকারের পক্ষ থেকে অজুহাত দেখানো হয় যে, সেই সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হলে দেশের সকল তথ্য পাচার হয়ে যাবে। এরপর ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সাবমেরিন ক্যাবল লাইন স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু তৎকালীন মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে পারেনি। অবশেষে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করে বেগম খালেদা জিয়ার ২০০১-২০০৬ সরকারের আমলে আমরা সাবমেরিন ক্যাবলে (সিমিউই-৪) যুক্ত হতে পারি। কিন্তু তারপরও সেই সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এই সম্পদটিকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের ছিল অবহেলার চরম দৃষ্টান্ত। আমি স্মরণ করতে পারি, এক সময়ে আমি নিজে কক্সবাজারের সৈকতে এই সাবমেরিন ক্যাবলকে উদোম অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলাম যেটির নিরাপত্তা বলতে কিছু ছিল না। কক্সবাজার থেকে ঢাকা পর্যন্ত এর সংযোগ স্থাপন ও দেশব্যাপী এর ব্যবহারের অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এখনও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অতি সাম্প্রতিককালে আমরা এর ব্যান্ডউইদথ বাড়াতে পেরেছি (৪৪.৬ জিবি থেকে ২৪৪.৬ জিবি)।কিন্তু সেটিরও অতি সামান্য অংশ আমরা ব্যবহার করতে পারি। অথচ আমাদের পুরো জাতির ব্যবহৃত ব্যান্ডউইদথ কোনো কোনো দেশের মাত্র ৫০টি বাড়িতে ব্যবহৃত ব্যান্ডউইদথের সমান। কারণ সেই সব দেশ প্রতি বাড়ির জন্য ১ জিবি ব্যান্ডউইদথ দেবার প্রত্যাশা করে। আমাদের দেশেও আজকাল অন্তত ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইদথ যে কোনো কিশোরের জন্য প্রয়োজন হয়ে থাকে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো একটি সাবমেরিন ক্যাবল লাইনের মাঝেই আমরা বসে আছি। দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে একটি বিকল্প সাবমেরিন ক্যাবল লাইন স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেই বিকল্প এখনও তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। এতোদিনে কেবলমাত্র কয়েকটি টেরিস্টরিয়াল কানেকশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশের ভেতরেও ঢাকা থেকে কক্সবাজার পথে একটি মাত্র বিকল্প সংযোগ রয়েছে যেটির জন্য আরো অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা প্রয়োজন। সরকারের ঘোষণা অনুসারে আমরা আরেকটি সাবমেরিন ক্যাবল লাইনে যুক্ত হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে সেটি কবে নাগাদ আমরা পাবো তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। কুয়াকাটা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য একে ২০১৬ সালের সময়সীমায় ধরে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে দেশের ভেতরে ক্যাবল বসানোর সরকারি কার্যক্রম ও বেসরকারি উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।
ইন্টারনেট মৌলিক অধিকার : প্রথমত এই বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার যে ইন্টারনেট আর দশটা সাধারণ বিষয়ের মতো আলোচনার বিষয় নয়। আজকের পৃথিবীতে ইন্টারনেট এমন একটি বিষয় যা দিয়ে ডিজিটাল রূপান্তরের সকল কাজই করা হয়। আমাদের চারপাশের জীবন এখন ইন্টারনেট নির্ভর। মানুষে মানুষে যোগাযোগ হোক, বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ব্যবসায়ী কাজ হোক, শিক্ষা বা চিকিৎসার বিষয় হোক; সবই এখন ইন্টারনেট নির্ভর। আমি এই সভ্যতাকেই ইন্টারনেট সভ্যতা বলি। আমি মনে করি, মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাবার মৌলিক অধিকারের মতোই ইন্টারনেট পাবার মৌলিক অধিকার রয়েছে। এটি একটি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক অধিকার। আমি যদি পারতাম তবে সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশের মানুষের ইন্টারনেট পাবার অধিকার নিশ্চিত করতাম। এই কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও করতে পারেন। সংবিধানের নতুন একটি সংশোধনী এনে তিনি দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে ইন্টারনেটকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। সংবিধানে এটি লিখিত থাকতে পারে যে, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতোই ইন্টারনেটও একটি মৌলিক অধিকার। দেশের প্রতিটি নাগরিকের সেই অধিকার রয়েছে।
গত ৯ এপ্রিল ২০১৪ ঢাকার ইস্টার্ন প্লাস শপিং সেন্টারে স্থাপিত বিসিএস ল্যাপটপ বাজারের কম্পিউটার ও মোবাইল মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ইন্টারনেটকে প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার বলে দাবি করেছেন। তিনি একই অনুষ্ঠানে ইন্টারনেটের ভ্যাট প্রত্যাহার করার জন্য অর্থমন্ত্রীর পায়ে পড়ার কথা প্রত্যয়ও ঘোষণা করেছেন। সেই অনুষ্ঠানেই আমি ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিও করেছিলাম। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলকও এই দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। দেখার বিষয় হচ্ছে সরকারের মন্ত্রীদের দাবিও সরকার গ্রহণ করে কিনা।
লেখকঃ মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট।
(সূত্র: ভোরের কাগজ)