মহেশপুরের ফতেপুরে পিঠে বড়শি বিঁধে শূন্যে ঘুরলেন ৫ সন্ন্যাসী
খবর বাংলা২৪ ডেক্স:
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর গ্রামে লোহার রডের বড়শিতে গাথা জ্যান্ত তাজা মানুষ। চড়ক গাছে ঝুলিয়ে প্রায় ২৫/৩০ ফুট শুন্যে ঘুরাতে ঘুরাতে সন্ন্যাসী ভিম কুমার হালদার ছুড়ে দিচ্ছেন বাতাসা। শুধু ভিম কুমার হালদার নয় একে একে ৫ সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শী বিধে শূন্যে ঘুরে পালন করলেন শিব পুজারই অংশ চড়ক উৎসব। গাঁ শিউরে উঠা এই দৃশ্য দেখলেন প্রায় ২০ হাজার নারী- পুরুষ। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের বকুলতলায় প্রতি বছরের ন্যায় আজ বুধবার বিকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে চড়ক উৎসব টি।
মহেশপুর শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমের একটি গ্রাম ফতেপুরের বকুলতলা বাজার। এ গ্রামের বকুল তলা বাজারে ভারতীয় পঞ্জিকা মতে ২ বৈশাখ,আর বাংলাদেশের পঞ্জিকা মতে ৩ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পুজাটি। হিন্দু ধর্মাবলীরা উৎসব আয়োজনে এ পুজা করে থাকেন। প্রতি বছর এই পুজার মুল আকর্ষন থাকে ৬/৭ জন সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শিবিদ্ধ হয়ে শুন্যে ঘোরা। এবার এক জন সন্ন্যাসী অসুস্থ থাকার কারণে ৫ জন সন্ন্যাসী বড়শি (বান) ফোড়ালেন ।
স্থানীয়রা জানায়, প্রায় দুশ’ বছর ধরে চলে আসছে এ চড়ক পুজা। আর এ পুজাকে ঘিরে বকুল তলা বাজারে ২ দিন ধরে চলে বর্ণাঢ্য লোকজ মেলা।
ফতেপুরের এ চড়ক মেলার মুল আকর্ষণ বড়শিবিদ্ধ হয়ে শুণ্যে ঘোরানো (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় বান ফোড়ানো) এ দৃশ্য অবলোকনের সাথে সাথে মেলায় কেনা কাটা করতে আজ বুধবার সকাল থেকে হাজির হয় প্রায় ২০ হাজার নারী-পুরুষ। দুপুরের পর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে মেলা প্রাঙ্গনে। বিকেলের মধ্যে লোকে লোকারন্য হয়ে যায় পুরো এলাকা জুরে। চারিদিকে সাজ সাজ রব। পুরো এলাকা জুড়ে উৎসবের আমেজ। ঠিক বিকাল ৫ টা বাজার সাথে সাথে ৫ সন্ন্যাসী বৈচিতলা গ্রামের ভিম কুমার হালদার, জলিলপুর গ্রামের আনন্দ শর্মা, ফতেপুর গ্রামের মনা কর্মকার, প্রবীর হালদার, কৃশচন্দ্রপুর গ্রামের মংলা ফতেপুর বাওড়ে শ্ন্যান করেন। এরপর ৫ সন্ন্যাসী মাটির কলসে জল (পানি) ভরে মাথায় নিয়ে আসেন মেলা প্রাঙ্গনে তাদের চড়ক গাছের গোড়ায়। ঠিক ৫ টা ২০ মিনিটে প্রথমে ভীম হালদারের পিঠে দুটি বড়শী বিদ্ধ করা হয়। এ সময় স্মরণ করা হয় মহাদেব শিব ঠাকুরকে। এরপর ভীমকে ১০/১৫ জন পুরুষ ধরাধরী করে ঝুলিয়ে দেন চড়ক গাছে। অপর গাছের অপর প্রান্তে থাকা কপিকলের বাঁশ জোরে জোরে ঘোরাতে থাকেন ২০/৩০ জন যুবক। চড়ক গাছে লটকে দেওয়ার সাথে সাথে কিছু মহিলা তাদের এক দেড় বছরের শিশু সন্তানকে তুলে দেন সন্ন্যাসীদের কোলে। তাকে নিয়েই শুন্যে ঘুরতে থাকে সন্ন্যাসী এ অবস্থায় ছিটিয়ে দেওয়া হয় বাতাসা।
এভাবেই বড়শীতে বিধে ৪/৫ পাক শুণ্যে ঘুরে নেমে আসেন ভীম হালদার। এ নিয়ে ১০ বার চড়ক গাছে চড়লেন তিনি। ভীম হালদার জানান,এখানে হিন্দুর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু সবাই চড়ক গাছে উঠতে পারে না। এতে সাহস লাগে। ভীমের পর একে একে বান ফোড়ালেন আনন্দ শর্মা, মনা কর্মকার, প্রবীন হালদার ও মংলা । স্থানীয়রা জানান, আগে শুধুমাত্র পিঠে বান ফুড়িয়েই ঝুলিয়ে দেওয়া হতো চড়ক গাছে। আর সে অবস্থাতেই ঘোরানো হতো। প্রায় একশো বছর আগে এক সন্ন্যাসীর পিঠের চামড়া ছিড়ে পড়ে আহত হওয়ার কারণে বড়শির উপর এখন গামছা পেচিয়ে দেওয়া হয়।
সন্ন্যাসী মনা কর্মকার জানান, শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টির জন্যই তারা প্রতি বছর চড়ক গাছে চড়ে থাকেন।
সন্ন্যাসী প্রবীর হালদার,মংলা কুমার,ভীম হালদার জানান, শরীরে বড়শী বিধার ফলে বড় ধরণের ক্ষতের সৃষ্টি হলেও সামান্যই রক্ত বের হয়। কিন্তু এর জন্য কোন ঔষধ লাগে না তাদের। চড়ক গাছ থেকে নামিয়ে গাছের গোড়ায় থাকা সিঁদুর টিপে দিলেই হয়।
তারা আরো জানান, পূর্ব পুরুষদের কাছে শুনেছেন দু’শ বছর আগে এখানে চড়ক পুজা শুরু হয়। আগে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে এ পুজার আয়োজন করা হতো। সেই স্থানে আশ্রয়ন প্রকল্প গড়ে তোলায় এখন ফতেপুর বকুল তলায় চড়ক পুজা হয়। এ পুজাকে ঘিরে বসে জমজমাট মেলা। লোকজ ঐতিহ্যের হরেক রকম পসরা সাজিয়ে দোকানীরা বেচাকেনা করেন ২ দিন ধরে। মিষ্টির দোকানী মোসলেম আলী (৫৩) ১০/১২ রকমের মিষ্টি সাজিয়ে বিকিনিকি করছেন। তিনি এবার ৫ম বারের মত মেলায় আসলেও বেচাকেনা বেশ ভালোই হচ্ছে বলে জানান। কুষ্টিয়ার একতারপুরের সাখা সিঁদুর বিক্রেতা বিমল সরকারও বিকিনিকি করছেন তার পণ্য সম্ভার। পুজা ও মেলা কমিটির সভাপতি সুনিল ঘোষ ও সাধারণ সম্পাদক সুবোল কর্মকার জানান, চড়ক পুজা মুলত শিব পুজারই অংশ বিশেষ। নানা আনুষ্ঠানিকতায় তা সম্পন্ন করা হয়।
তারা আরো জানান, চড়ক মেলা কমিটির পক্ষ থেকে সন্ন্যাসীদের কে কোন টাকা পয়সা দেওয়া হয় না। শুধু মাত্র একটি ধুতি,দুটি গামছা দেওয়া হয়ে থাকে।
এদিকে মেলা প্রাঙ্গনের পাশের বাগানের মধ্যে চলছে জমজমাট জুয়ার আসর। মেলায় কেনা কাটা করতে আসা বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ গুলো জুয়ারীদের কারনে একেবারে নিশ্ব হয়ে বাড়ী ফিরতে হয়।