বাংলা বর্ষ এবং বর্ষবরণ (একটি ইতিহাস ভিত্তিক পর্যালোচনা)
মানব সভ্যতায় দিন, মাস, বর্ষ গণনার ইতিহাস সুপ্রাচীন। সভ্যতার অগ্রযাত্রার সাথে সাথে এই গণনা প্রক্রিয়ায়ও এসেছে ভিন্নতা। গত দুদিন আগে সারা বাংলা জুড়ে ঘটা করে পালিত হল বাংলা নববর্ষ। এই নববর্ষ উদযাপনে দিন দিন নিত্যনতুন অনুষঙ্গযুক্ত হচ্ছে এবং আমাদের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির সাথে যা মিশে যাচ্ছে। এটা দোষের কিছু নয়, সমস্যা হল কতিপয় অতিউৎসুক মানুষ ইতিহাস বিকৃত করে এগুলোকে আমাদের বাংলা’র ইতিহাস বলে চালিয়ে দিচ্ছে। এবার পহেলা বৈশাখ কাটালাম খাগড়াছড়ির মারমা অধ্যুষিত “পান খাইয়া পাড়া”য়, ‘সাংগ্রাই’ উৎসবে; সেই গল্প নিয়ে লিখব খুব শীঘ্রই। কিন্তু সারাক্ষণ এইসব ভাবনা অদ্ভুত এক মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আর এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে গতকাল ঢাকায় ফিরে শুরু করলাম স্টাডি। নিজের মানসিক যন্ত্রণা লাঘবে স্টাডি করে যা পেলাম তা শেয়ার করার জন্যই আজকের লেখা। চেষ্টা ইতিহাস এবং তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে উৎসমূলে যাওয়া।
সময় বা কাল গননা মানব সভ্যতার উন্মেষ থেকেই হয়ে আসছে। সৃষ্টির সাথে সাথেই উদ্ভব হয়েছে সময় এর। আর এর পরিমাপের জন্য বিভিন্ন একক এর। সময় হচ্ছে একটি একমুখি মাত্রা। যাকে কখনও পিছিয়ে নেয়া যায়না। সময় এর একটি প্রধান একক হচ্ছে বছর। চন্দ্র বা সূর্যের পরিক্রমন এর মাধ্যমে এই বর্ষ বা বছর নির্ধারন করা হয়্ । মানুষ প্রধানত দুই ধরনের হিসাবে বছর নির্ধারন করে। চাঁদের পরিভ্রমন এর হিসেবে এবং সূর্যের পরিভ্রমনের হিসেবে। সূর্য ভিত্তিক বা সেীর বছর এর উপর নির্ভর করে আবহাওয়া ও ঋতু। অন্যদিকে চান্দ্র বছর ঋতুর উপর কোন প্রভাব ফেলেনা। ঋতুগত কারনে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এই সেীর বছর ব্যবহৃতহয় আঞ্চলিক ভাবে। সেভাবেই বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয় বাংলা সন।
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। বাংলাদেশ এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ঋতু বৈচিত্রকে ধারন করবার কারণে বাংলা সনের জনপ্রিয়তা এসেছে । বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চারটি ঋতু বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত এবং শীত ঋতুর সাথে এই অঞ্চলে যোগ হয়েছে বর্ষা ও শরৎ ঋতু। বাংলা সনের মাসগুলোর উপর ভিত্তি করেই এই ঋতু বিভাজন করা হয়েছে। কিন্তু কেন? কারণ বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ “সূর্যসিদ্ধান্ত” থেকে। বাংলা মাসের এই নামগুলি যে সকল নক্ষত্রের নাম অনুসারে রাখা হয়েছে সেগুলো হলঃ বৈশাখ – বিশাখা নক্ষত্রের; জ্যৈষ্ঠ – জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; আষাঢ় – উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে; শ্রাবণ – শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; ভাদ্র -উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; আশ্বিন – অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে; কার্তিক – কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; অগ্রহায়ণ(মার্গশীর্ষ) – মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; পৌষ – পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; মাঘ – মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; ফাল্গুন – উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে; চৈত্র – চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে। বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকামন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে। কিন্তু সব কয়টি বারের নামই এসেছে হিন্দু দেবতাদের নামানুসারে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বরাহমিহির ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটি পাঁচটি খণ্ডে সমাপ্ত। এই গ্রন্থটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হয়। পঞ্চসিদ্ধান্তিকার পাঁচটি খণ্ডের নাম– এই সিদ্ধান্তগুলো হলো– সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত ও ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত। প্রাচীন ভারতে দিন, মাস, বৎসর গণনার ক্ষেত্রে ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বরাহমিহিরের পরে ব্রহ্মগুপ্ত নামক অপর একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী (জন্ম ৫৯৮) একটি সিদ্ধান্ত রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থটির নাম ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত। এই গ্রন্থটি খলিফা আল-মনসুরের আদেশে সিন্দহিন্দ নামে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে সৌর-মাস নির্ধারিত হয়, সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। সূর্যের ভিন্ন অবস্থান নির্ণয় করা হয় আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের বিচারে। প্রাচীন কালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এর একটি ভাগকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হলো– মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন। সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য কোনো না কোন রাশির ভিতরে অবস্থান করে। এই বিচারে সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে সংক্রান্তি বলা হয়। এই বিচারে এক বছরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। একেকটি সংক্রান্তিকে একেকটি মাসের শেষ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে তার পরদিনই ১ বৈশাখ (পয়লা বৈশাখ) হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয় তার পরদিনই মাসের প্রথম দিন। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়। লক্ষ্য করা যায় সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগতে পারে, ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন। সেই কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা সমান হয় না। এই সনাতন বর্ষপঞ্জী অনুসারে বছর ঋতুভিত্তিক থাকে না। একেকটি মাস ক্রমশঃ মূল ঋতু থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে।
আধুনিক যে বাংলা বর্ষ প্রবর্তিত রয়েছে, তা মূলত বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংশোধিত বর্ষ গণনা প্রক্রিয়া যার মূল প্রোথিত রয়েছে ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬ সালে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের প্রস্তাববালী প্রদান করেন । বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের । যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে । এ প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড । এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয় । ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দীতে যে শতাব্দীকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না বা বিভাজ্য । জ্যোর্তিবিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি । বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের । এই সমস্যাগুলোকে দূর করবার জন্য ডঃ মুহম্মদ শহীদূল্লাহ কমিটি বাংলা একাডেমীর কাছে কতকগুলো প্রস্তাব করে । এগুলো হচ্ছে- • বছরের প্রথম পাঁচ মাস বৈশাখ হতে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের • বাকী মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন হতে চৈত্র হবে প্রতিটি ৩০ দিনের মাস • প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের। বাংলা একাডেমী সরকারীভাবে এই সংশোধিত বাংলা মাসের হিসাব গ্রহণ করে ।
বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে দু’টি মত আছে ৷ প্রথম মত অনুযায়ী প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খৃষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন ৷ সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন ৷ আধুনিক ভারতের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অধিকাংশ তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৷ অনুমান করা হয় যে জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের সোমবার ১২ এপ্রিল ৫৯৪ এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের সোমবার ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল ৷
দ্বিতীয় মত অনুসারে, উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রিয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো হিজরি সন। ১২০১ সালে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গ বিজয় এর পর থেকে উনিশ সতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে ব্যবহৃত হতো হিজরি সন। এছাড়া মুসলিম ধর্মিয় উৎসব সমুহও উদযাপিত হয় হিজরি বর্ষ অনুসারে। হিজরি সন চান্দ্র বর্ষ হওয়ায় এটির সাথে ঋতুর কোন সম্পর্ক ছিলনা। এ কারনে সেসময় কর আদায় করতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কারন এটাইি স্বাভাবিক যে কৃষি প্রধান সমাজে চাষিদের কাছে ফসল তুলার পরই কর আদায় করার মত যথেষ্ট অর্থ থাকত। এছাড়া একই কারনে ব্যবসায়ি ও অন্য পেশাজিবি রাও এসময় অধিক অর্থ হাতে পেতেন অর্থনিতির স্বাভাবিক তত্ব অনুযয়ি। অন্যদিকে হিজরি সন অনুযায়ি যে কোন বর্ষ শেষ হতে যখন কর আদায় এর হিসাব করা হতো তখন দেখা যেত ফসল তোলার সময় হতে কর আদায় এর সময় ভিন্ন হওয়ায় হয় ঠিক মত কর আদায় হয়নি কিংবা কৃষকেরা কর আদায় করতে গিয়ে অভাবে পতিত হতে হয়েছে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে সুলতানি আমলেই বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর আমলে একটি কাব্যে বাংলাদেশে প্রচলিত সন কে যাবনি আব্দ বলার প্রমান পাওয়া যায়। যা থেকে বোঝা যায় সে সময় বাংলাদেশে প্রচলিত স্থানিয় তারিখ গননাটি মুসলিম সুলতান দের প্রচলিত ছিল। এই প্রচলিত প্রাচিন বাংলা সন কে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে সংস্কার করা হয়। দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বর্তমানে প্রচলিত বাংলা সন কে বৈজ্ঞানিক ভাবে নির্ধারন করা হয়। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য যে, ‘সন’ ও ‘তারিখ’ দুটিই আরবি শব্দ। প্রথমটির অর্থ বর্ষ, দ্বিতিয়টির অর্থ দিন। তবে তারিখ অর্থ ইতিহাস ও হয়। সাল শব্দটি ফার্সি। মুঘল সাম্রাজ্য তার তুর্কি ও ইরানি প্রভাবের কারনে সম্রাটগন ফারসি পঞ্জিকা ব্যবহার করতেন ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক ক্ষেত্রে যা ছিল একটি সেীর পঞ্জিকা। তারা ফার্সি নববর্ষ বা নওরোজ ও উদযাপন করতেন। কিন্তু প্রসাশনিক ক্ষেত্রে কেবলমাত্র হিজরি সন ই ব্যবহার করা হতো। সম্রাট আকবর তার ”দিন-ই-ইলাহি” এর সাথে একটি ”তারিখে ইলাহি” নামে একটি নতুন সৈীর সাল প্রবর্তন এর চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যার্থ হন। তবে কেন্দ্রিয় ভাবে এই সন প্রচলনের চেষ্টার পুর্বেই অঞ্চল ভিত্তিক আগে থেকে প্রচলিত সন এবং হিজরি সন এর মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে কয়েকটি সন এর প্রচলন করেন সম্রাট আকবর। এই সন গুলিকে বলা হত ফসলি সন কারন এই সনগুলির গননা ফসল উৎপাদন এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল।
অন্য আরেকটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশে মুসলিম আমলের আগে শশাংক কর্তৃক প্রবর্তিত শকাব্দ ও বিক্রমাব্দ সহ বিভিন্ন ধরনের সন গননা প্রবর্তিত ছিল। আকবরের বাংলা ক্যালেন্ডার চালু হওয়ার পরও এই বাংলাদেশেই অন্যতম প্রচলিত ক্যালেন্ডার ছিল শকাব্দ বা শালিবাহন বর্ষ। ঠিক কোন সময় থেকে এই বর্ষ চালু হয়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন, শকরাজা শালিবাহনের মৃত্যুর দিন থেকে শকাব্দ গণনা শুরু। আল-বিরুনির মতে, এই বর্ষ চালু করেন রাজা বিক্রমাদিত্য। তিনি এক যুদ্ধে কোনো এক রাজাকে পরাজিত ও হত্যা করার প্রসঙ্গটি স্মরণীয় করে রাখতেই নাকি কাজটি করেছিলেন। আবার কেউ বলেন, শক-বংশজাত কুশান রাজা কনিষ্ক এই সাল প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ব্যাপার হলো, একই সঙ্গে ভারতের দুই প্রান্তে দুই নিয়মে শকাব্দ প্রচলিত ছিল। পশ্চিম ভারতে শকাব্দ পরিচালিত হত চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী। আর পূর্ব ভারতে শকাব্দ চলে সৌরবর্ষ অনুযায়ী। বাংলা বর্ষটি চান্দ্র ও সৌরবর্ষের মধ্যে ভারসাম্য আর সমন্বয়ের প্রতিফল।
এখন আসা যাক, নববর্ষ উদযাপন প্রসঙ্গে। মুসলিম পুর্ব ভারতবর্ষে বিভিন্ন সন প্রচলিত ছিল। বাংলায় তখন যে সন প্রচলিত ছিল তার প্রথম দিন ছিল ১লা অগ্রাহায়ন। হায়ন শব্দের অর্থ বছর বা সুর্যের একটি পরিক্রমন এর সময়। একারনে সম্রাট আকবরের সময় প্রচলিত বাংলাসনের আগে বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপিত হতো ১লা অগ্রহায়ন। এছাড়া কার্তিক ও চৈত্র মাসকেও বিভিন্ন সময় বৎসরের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারনের প্রমান পাওয়া যায়। আকবরের সময়কাল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে “মঙ্গল শোভাযাত্রা”। ধীরে ধীরে এতে আরও যোগ হয়েছে পান্তা ইলিশের কালচার। যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বৈশাখী সঙ্গীতানুষ্ঠানের। এবার হয়েছে ভুভুজেলা’র সংযোজন, সামনে হয়ত হবে ডিজে পার্টির…। এবার ‘সাকরাইন’ উৎসবে গিয়ে তাই দেখেছি…। এত কথার শেষ কথা, আপনি যে কোন উৎসব পালন করার স্বাধীনতা রাখেন যে কোনভাবে, কিন্তু সেই উৎসবকে আপনার মনের মত করে রাঙিয়ে কোন গোষ্ঠী, দল, জাতির কাছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিতে পারেন না। প্রায় হাজার বছরের পুরানো বাংলা বর্ষ এবং নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস নিশ্চয়ই কয়েকযুগ আগে কতিপয় ব্যাক্তি দ্বারা প্রচলিত রীতি দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহের যুগে ইতিহাস আমাদের দোরগোড়ায় চলে আসবেই। তাই অধুনা প্রচলিত ‘বাংলা নববর্ষ উদযাপন’ই হাজার বছরের প্রচলিত বাংলা বর্ষবরণ সংস্কৃতি নয়। কোথায় রয়েছ কৃষিভিত্তিক
বাংলার বর্ষবিদায় আর বর্ষবরণ? হালখাতা, বর্ষ শেষের ঝাড়ামোছা, গ্রাম বাংলার সেই বৈশাখী মেলা? ও হ্যাঁ, রয়েছে বৈশাখী কনসার্ট!!!
তথ্যসূত্রঃ সামহোয়্যার ইন ব্লগের “বোকা মানুষ বলতে চায়” এর লেখা।