গোয়েন্দা, দুদকের নজরদারিতে ডা. ইমরান!

kb24খবর বাংলা ২৪ডেক্স: গোয়েন্দাদের নজরবন্দি অবস্থায় আছেন গণজাগরণ মঞ্চের ‘মুখপাত্র’ ডা. ইমরান এইচ সরকার। তার চলাফেরা, গতিবিধি, সভা, সমাবেশ, যোগাযোগের বিষয়ে কঠোর নজরদারি করছেন সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র এসব তথ্য জানায় প্রিয় দেশ ডটনেটকে।

অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সূত্র প্রিয় দেশ ডটনেটকে নিশ্চিত করেছে, ‘ডা. ইমরানের সম্পত্তির অনুসন্ধান করতে প্রতিষ্ঠানটির কয়েক কর্মকর্তা শীঘ্রই মাঠে নামছেন। গত ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর তার সম্পদ কতো বেড়েছে, এ বিষয়ে অনুসন্ধান করবে দুদকের তদন্তকারী দল।’

গণজাগরণ মঞ্চের ডা. ইমরান বিরোধী নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ‘আন্দোলনের নামে ডা. ইমরান কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আন্দোলনের খরচের নামে তিনি কোটি কোটি টাকা চাঁদা নিয়েছেন। এসব টাকা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের কোনো কর্মসূচিতে খরচ করা হয়নি।’

ডা. ইমরান বিরোধী অংশের নেতাকর্মীরা সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এমন অভিযোগ করেন। এর ভিত্তিতে দুদকের অনুসন্ধানকারী দল ইমরানের সম্পদের খোঁজে মাঠে নামছে বলে প্রতিষ্ঠানটির সূত্র প্রিয় দেশ ডটনেট’র কাছে উল্লেখ করে।

গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, ‘গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ডা. ইমরানের রাজনৈতিক মন্তব্য, ঘরোয়া আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তার সমালোচনার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। ডা. ইমরান এর মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। রাজনৈতিক দল গঠন করতে তিনি তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন কী না, এ বিষয়ে সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা।’

শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ধারণা করছেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ডা. ইমরান এইচ সরকার দেশ, বিদেশে পরিচিত। অগণতান্ত্রিক কোনো শক্তি তাকে তাই ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারে। তাকে দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করানোর পায়তারা করছে কোনো শক্তি।’

অন্যদিকে নিজেদেরকে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, সংগঠক দাবি করে ডা. ইমরান সরকারকে ‘মুখপাত্রের’ দায়িত্ব থেকে গত ১২ এপ্রিল ‘অব্যাহতি’ দিয়ে দেন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক ব্যক্তি।

ওই খবর শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে ডা. ইমরান সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি, যারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় এক নেতার নেতৃত্বে করেছেন। গণজাগরণ মঞ্চ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এর মুখপাত্র নির্ধারণ করার দায়িত্বও কোনো রাজনৈতিক দলের নয়।’

গণজাগরণ মঞ্চ, ছাত্র সংগঠনের সূত্রগুলো জানায়, ‘গণজাগরণ মঞ্চের সাম্প্রতিক ভাঙনের নেপথ্যে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ইন্ধন রয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রিয় নেতারা।’

সদ্য প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক, বরেণ্য কলামিস্ট এবিএম মূসা গত বছরের ৮ অক্টোবর প্রিয় দেশ ডটনেটকে বলেছিলেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ছিলো নতুন এক রাজনৈতিক খেলা। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন খেলা।’ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সম্পর্কে এভাবে অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ মূল্যায়ন করেন।

তাদের মধ্যে অনেকের কাছে রাজধানীর শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মূল নায়করা ‘রহস্যময় রাজনীতির গডফাদার’। এসব ‘রাজনৈতিক গডফাদার’ শাহবাগে সফল না হওয়ায় নতুন রাজনৈতিক খেলা খেলছেন বলে তারা মনে করছেন। তাদের এ খেলা সফল হলে দেশ অন্ধকারের মুখোমুখি হবে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।

দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতারাও মনে করেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তির উত্থানের পরিকল্পনা ছিলো আন্দোলনের দেশি, বিদেশি মূল নায়কদের।’

রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ‘মিশরে নির্বাচিত মুরসি সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের মতো পরিকল্পনা এদেশেও ছিলো গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মূল নায়কদের। তারা চেয়েছিলেন, তখনকার মহাজোট সরকারকে হটিয়ে তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে। তবে ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও আতঙ্ক রাজনীতিবিদদের এখনও কাটেনি।’

‘ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরাম’ নামের অখ্যাত একটি সংগঠনের নামে শুরু হওয়া গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন দেশ, বিদেশে কীভাবে আলোড়ন তোলে, এর পেছনে কারা ছিলেন, তাদের টার্গেট আরেকটা ওয়ান ইলেভেন ছিলো কী না, এ প্রশ্নগুলোও তখন আসে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় ওই আন্দোলন।

রাজনীতির মাঠে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন নিয়ে পক্ষে, বিপক্ষে থাকলেও ওই আন্দোলন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের কাছে ‘আতঙ্কের’ ছিলো। আন্দোলনের শুরু থেকে যৌবনবতী থাকা পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আন্দোলনে নানাভাবে সহায়তা করলেও দলটি আন্দোলন বা এর মধ্য দিয়ে অপশক্তির ক্ষমতা দখলের বিষয়ে সর্তক ছিলো। এ আন্দোলনের পেছনে কারা ছিলেন, আন্দোলনে অর্থ যোগানদাতা, মদদদাতা কারা ছিলেন, তা জানত না আওয়ামী লীগ। একইভাবে তা বিএনপির নেতাদের কাছেও অজানা ছিলো।

সূত্রমতে, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও চিনেন না শাহবাগ আন্দোলনের মূল নায়কদের। তিনি এ আন্দোলনের বিপক্ষে এক পর্যায়ে কথা বলেন মহাজোটের পক্ষে হেফাজতের ভোট রাখার জন্য। জামায়াতকে শাহবাগ আন্দোলন নতুন করে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি করে বলে দলটির পক্ষ থেকে আন্দোলনের প্রবল বিরোধিতা করা হয়। শাহবাগ আন্দোলনের মদদদাতা ভারত বলে তখন জামায়াতের নেতারা অভিযোগ করেন।’

একইভাবে গণজাগরণ মঞ্চের বিপক্ষ শক্তি হেফাজত মাঠে নামলে অনেকে বলেন, ‘এটা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের খেলা।’ বাম রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শগত অবস্থান থেকে গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন করে। তবে অধিকাংশ বাম নেতা জানেন না, শাহবাগ আন্দোলনের পেছনে কারা ছিলেন।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের পক্ষ থেকেও কয়েকবার অভিযোগ করা হয়। এ টাকা কোত্থেকে এসেছে, কারা লুটপাট করেছেন, এসব প্রশ্নও আসছে। আন্দোলনে দেশের শীর্ষ কয়েক ব্যবসায়ী তখন খাবারের প্যাকেট, টাকা দেন। কিছুদিন পর তারাও এসব অস্বীকার করতে থাকেন। এটাও রাজনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে রহস্যের জন্ম দেয়।

বিএনপি, জামায়াতের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ‘শাহবাগ আন্দোলন আওয়ামী লীগেরই মদদে।’

জানা যায়, ‘গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে আওয়ামী লীগের কোনো মদদ ছিলো না। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করে। ওই নির্বাচনের আগে প্রকাশিত দলটির ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি উল্লেখ আছে। দলটি মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণের আন্দোলনের সমর্থন পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করেছে।’

তবে আওয়ামী লীগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাদেরও তখন নির্দেশ দেয়া হয়, গণজাগরণ মঞ্চে যেতে, সেখানে বক্তব্য দিতে।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরির মতো নেতাদের সেখানে পাঠানো হয় আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তবে তাদেরকে শাহবাগে গিয়ে হেনস্থার শিকার হতে হয়।

এমনকি তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও শাহবাগে গিয়ে ‘বোতল নিক্ষেপের’ শিকার হন। তোফায়েল আহমেদের মতো প্রবীণ নেতাকে শাহবাগের মঞ্চে উঠতে বাধা দেয়া হয়। এ নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, ‘শ্লোগান কন্যা’ লাকি আখতারের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখার নেতাকর্মীদের ঝগড়াও হয়। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের কয়েক নেতা লাকিকে লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করেন বলে তখন অভিযোগ উঠে।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে বিএনপি প্রথমে সমর্থন জানায়। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা প্রথমে ভেবেছিলেন, মহাজোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আন্দোলন হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষের ভোটের আশায় বিএনপি শাহবাগ আন্দোলনকে প্রথমে সমর্থন জানায়।

পরে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা যখন জানতে পারেন, আন্দোলনের পেছনে সরকারের মদদ নেই, তখন আন্দোলন থেকে দলটি সমর্থন প্রত্যাহার করে। বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে এও জানান, ‘শাহবাগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে।’ তখন খালেদা জিয়া গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দেন।

সূত্র জানায়, ‘রাজনীতির মাঠে চরমতম কাঁদা ছোড়াছুড়ি থাকলেও বিএনপি চায়নি, আওয়ামী লীগকে হটিয়ে তৃতীয় বা অগণতান্ত্রিক কোনো শক্তি ক্ষমতা দখল করে নিক। এছাড়া গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার জন্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯ দলের অন্যতম শরীক জামায়াতের চাপও ছিলো।’

এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারাও চিনেন না শাহবাগ আন্দোলনের মূল নায়কদের। দলটির শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রিয় দেশ ডটনেটকে বলেন, ‘এরশাদ এক পর্যায়ে আন্দোলনের বিপক্ষে কথা বলেন, বা আন্দোলনের সমালোচনা করেন মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে। কেননা, তখন হেফাজতের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের হেফাজত, গণজাগরণ মঞ্চ, দুই সংগঠনকেই দরকার।’

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend