নতুন টোলনীতির বিপক্ষে জনপ্রতিনিধিরা
খবর বাংলা ২৪ডেক্স: দেশের সব সড়ক-মহাসড়কে টোল আরোপ করতে গত ২৪ মার্চ ‘টোল নীতিমালা-২০১৪’ অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। জুলাই থেকে এ টোলনীতি কার্যকর করতে চায় সরকার। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন ছাপানোর জন্য বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। এ টোল আরোপের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন কেউ-কেউ। এর কারণ- দেশীয় অর্থায়নে সেতু তৈরি করে টোল আদায়ের মাধ্যমে নির্মাণ-ব্যয় তোলার পরও কমপক্ষে ১৬টি সেতু টোলমুক্ত করা হচ্ছে না। এর মধ্যে ৪০ বছরের পুরনো সেতুও আছে। জোড়াতালি দিয়ে কোনওরকমে দাঁড় করিয়ে রাখা সেতু থেকেও নেওয়া হচ্ছে টোল। গ্রামাঞ্চলে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ও গরিব মানুষের কষ্ট বিবেচনা করে জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা এসব সেতু টোলমুক্ত করার আবেদন করেই যাচ্ছেন। কিন্তু রাজস্ব কমে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে তা করা হচ্ছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে নতুন করে টোল আরোপ সাধারণ মানুষের বাড়তি চাপ আসতে পারে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীন দেশে এখন সড়ক রয়েছে ২১ হাজার ৫৭১ কিলোমিটার। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সেতু আছে ৪ হাজার ৫০৭টি। বর্তমানে টোল আদায় হচ্ছে ৬১টি থেকে। এর পরিমাণ বছরে ৩৭০-৩৮০ কোটি টাকা। যে ১৪টি সেতুর টোল মওকুফ করার কথা, সেগুলো থেকে বছরে টোল আদায় হয় ৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সড়ক খাতে চট্টগ্রাম পোর্ট এক্সসেস রোড, হাটিকুমরুল-বনপাড়া এবং হবিগঞ্জের রুস্তমপুর থেকে জাফলং রোডে টোল আদায় করা হয়। এ ছাড়া ৫০টি ফেরিঘাটে টোল কার্যকর আছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, ‘টোল নীতিমালা-২০১৪’ অনুযায়ী টোল বাবদ আদায় করা অর্থ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত তহবিলে দেওয়ার কথা রয়েছে। জুন থেকে সড়ক তহবিল বোর্ড গঠনের তোড়জোড় চলছে। সড়ক, সেতু ও ফেরির বর্তমান ইজারা-মেয়াদ পর্যন্ত চলবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে নতুন টোল নীতিমালা অনুযায়ী পুনরায় ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলের অর্থ জোগানই নতুন টোল নীতিমালার মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীরা আগে টোল মওকুফের পক্ষে থাকলেও এখন তহবিলের অজুহাত তুলে পুরনো সেতু টোলমুক্ত করার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে টোলনীতি অনুমোদনের পর থেকে জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন এলাকায় চাপে আছেন। তারা জানান, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিপণন করতে যাতায়াতে টোলের কারণে তাদের অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয়। মাঝেমধ্যে ইজারাদারের সঙ্গে তাদের অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠি থেকে দেখা গেছে, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের চিঠিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের পণ্য বিপণনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়রোধে টোল মওকুফের আবেদন জানান। ২০১১ সাল থেকে এ দাবি জোরালো হতে থাকে। বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম গত ১৬ মার্চ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জামালপুর-ইসলামপুর-দেওয়ানগঞ্জ সড়কের ঝিনাই সেতুর টোল মওকুফের অনুরোধ করেছেন। তার চিঠি থেকে জানা গেছে, ওই সড়কের সপ্তম কিলোমিটারে অবস্থিত ঝিনাই সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। ১৮৮ মিটার দৈর্ঘ্যরে এ সেতু দিয়ে যাতায়াত করে জামালপুরের মেলান্দহ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জ উপজেলার শত-শত মানুষ। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে এই অঞ্চলের অনেকেই বিপর্যস্ত। এ কারণে এখানকার মানুষের পক্ষে টোল দেওয়া কষ্টকর।
চাঁদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ড. মো. শামছুল হক ভুঁইয়া গত ১৯ মার্চ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে চাঁদপুর সেতুর টোল মওকুফ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চাঁদপুরের নতুন বাজার-পুরনো বাজার সংযোগ সেতু ও হাজীগঞ্জ উপজেলার হাজীগঞ্জ সেতুর টোল মওকুফ করা হয়েছে। কিন্তু এলাকাবাসীর বারবার দাবির পরও চাঁদপুর সেতুর টোল মওকুফ করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সংসদে কথা বলেছি। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেব।
জানা গেছে, দেশীয় অর্থে নির্মিত ও কমপক্ষে ১২ বছর টোল আদায় হয়েছে, এমন ১৪টি সেতুর টোল মওকুফ করার জন্য জনপ্রতিনিধিরা বছরের পর বছর ধরে আবেদন জানিয়ে আসছেন। কিন্তু বারবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের শেষের দিকে এসব সেতু টোলমুক্ত করার একটি প্রস্তাব তৈরি করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। তবে ওই প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকা পড়ে। রাজস্ব কমে যাবে- কারণ দেখিয়ে এসব সেতুর টোল মওকুফ করা হয়নি।
মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৯টি সড়ক বিভাগে অবস্থিত বিভিন্ন মহাসড়কে এই ১৪টি সেতুর অবস্থান। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ সড়ক বিভাগে আছে দুটি- ধলেশ্বরী সেতু-১ ও ধলেশ্বরী সেতু-২।
মানিকগঞ্জ সড়ক বিভাগে আছে তরা সেতু, শরীয়তপুর সড়ক বিভাগের আঙ্গারিয়া সেতু, নওগাঁ সড়ক বিভাগের নজীপুর, মান্দা ও মহাদেবপুর সেতু। নাটোর সড়ক বিভাগের সিঙ্গার সেতু, সিলেট সড়ক বিভাগের শেওলা সেতু, লামাকাজী সেতু ও শেরপুর সেতু, খুলনা সড়ক বিভাগের খর্নিয়া সেতু। দিনাজপুরের মোহনপুর সেতু ও সুনামগঞ্জ সড়ক বিভাগের আহসানমারা সেতু।
এই ১৪টি সেতু ছাড়াও জামালপুর-ইসলামপুর-দেওয়ানগঞ্জ সড়কের ঝিনাই সেতু ও কুমিল্লা-লালমাই-চাঁদপুর-বেগমগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে চাঁদপুর সেতুর টোল মওকুফের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তরা সেতুটি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে। পাটুরিয়া থেকে ২২ কিলোমিটার ও ঢাকা থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার তরা এলাকায় এটি অবস্থিত।
মানিকগঞ্জ সড়ক বিভাগসূত্র জানিয়েছে, ১৯৭৪ সালে নির্মিত তরা সেতু থেকে এখনও টোল আদায় করা হচ্ছে। এলাকাবাসী সেতুটির টোল মওকুফ করার দাবি তুলেছেন। এ ছাড়া সিলেট সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, সিলেট সড়ক বিভাগের বিভিন্ন সেতুর মধ্যে শেওলা, লামাকাজী ও শেরপুর সেতুর টোল মওকুফ করা হয়নি। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, টোলের অর্থ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় করার জন্য তহবিলে রাখতে হবে।
জানা গেছে, সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কে আহসানমারা সেতু থেকে টোল আদায় হচ্ছে। সুনামগঞ্জ সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আহসানমারা সেতুর টোল মওকুফের দাবি তোলা হয়েছে। তবে তা মওকুফ না হওয়ায় টোল আদায় করা হচ্ছে।
এদিকে মাদারীপুর-শরীয়তপুর-চাঁদপুর মহাসড়কের আঙ্গারিয়া সেতু জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। এটির মেরামত-ব্যয় ও ইজারার জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়, তা ইতোমধ্যে আদায় করা টোলের চেয়েও কম। এ কারণে শরীয়তপুর সড়ক বিভাগ থেকে সেতুর টোলরহিত করার জন্য বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ সড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত এখনও আমাদের জানানো হয়নি। ১৯৯৩ সালে নির্মাণ করা সেতুটির টোল এখনও আদায় করা হচ্ছে।
পুরনো টোল মওকুফের আবেদন বিবেচনা না করে নতুন টোল আরোপের খবরে অস্বস্তিতে রয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। তাদের মতে, ব্যয় ওঠানোর পরও টোল আরোপ নিয়ে সাধারণ মানুষ আপত্তি জানিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নতুন টোলের খড়গ সহজভাবে নিতে পারছেন না অনেকে।
নতুন টোল নীতিমালায় বলা হয়েছে, জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক, জেলা সড়ক, পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপে (পিপিপি) নির্মিত সড়ক বা সেতু, ২০০ মিটারের বড় সেতু, উড়াল সড়ক, টানেল ও সরকার ঘোষিত যে-কোনও স্থাপনার ওপর টোল আরোপ করা যাবে। আদায়কৃত টোল সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলে জমা হবে, যা দিয়ে দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক মেরামত করা হবে। টোলের হার নির্ধারণে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কগুলোয় হবে সর্বনিম্ন ৫ টাকা ও সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা। কনটেইনারবাহী ট্রেইলার, ট্রাক, বাস থেকে শুরু করে রিকশা, ভ্যান, বাইসাইকেল, ঠেলাগাড়ি সব ধরনের যানবাহন ১৩টি ক্যাটাগরিতে টোলের আওতায় আসবে। এ ছাড়া সব সেতু ও ফেরিতে একক কাঠামোর আওতায় আদায় করা হবে টোল।
নীতিমালা অনুযায়ী, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ব্যবহারে ট্রেইলারের টোল হবে ১ হাজার টাকা, ভারী ট্রাক ৮০০, মাঝারি ট্রাক ৪০০, বড় বাস ৩৬০, ছোট ট্রাক ৩০০, মিনিবাস ২০০, কৃষিকাজে ব্যবহৃত যানবাহন (ট্রাক্টর, পাওয়ারটিলার) ২৪০, মাইক্রোবাস, পিকআপ ১৬০, ব্যক্তিগত গাড়ি ১০০, অটোরিকশা, টেম্পো ৪০, মোটরসাইকেল ২০ ও রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ১০ টাকা।
জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহারে টোলের হার হবে উল্লিখিত পরিমাণের ৪ ভাগের ৩ ভাগ, আঞ্চলিক মহাসড়কের ক্ষেত্রে অর্ধেক ও জেলা সড়কের ক্ষেত্রে ৪ ভাগের ১ ভাগ। তবে দৈর্ঘ্যভেদে টোলের হার পরিবর্তিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার চাইলে যে-কোনও সড়ককে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করে সর্বোচ্চ হারে টোল আরোপ করতে পারবে।
এদিকে ২০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যরে সেতুর ওপর টোল আরোপ করা হবে না। তবে ২০১ থেকে ৫০০, ৫০১ থেকে ৭৫০, ৭৫১ থেকে ১ হাজার ও ১ হাজার মিটারের অধিক দৈর্ঘ্যরে সেতুর জন্য নির্ধারিত হারে টোল দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে টোলের হার নির্ধারণ করা হবে যানবাহনের আকারভেদে। আবার ফেরি ও ফেরির স্থলে নির্মিত সেতুর জন্যও টোল দিতে হবে। ফেরির স্থলে নির্মিত সেতুর দৈর্ঘ্য ২০০ মিটারের কম হলেও টোল দিতে হবে কমপক্ষে এক বছর।
(সূত্র: আমাদের সময়)