অন্তরের ময়লা ঝরেকলবের জ্বিকিরে আলহাজ হাকীম সৈয়দ সালেহ আহমদ
সুফিবাদের নিগূঢ় কথা
তাসাওফপন্থি সাধক ব্যতীত যারা জ্বিকিরের চর্চা করে থাকেন তারা যখন যার কাছ থেকে জ্বিকিরের যা আমল পেয়ে থাকেন বা কিতাব পড়ে সংগ্রহ করেন তা-ই জ্বিকির করেন। কিন্তু তরিকতপন্থি সাধকের জ্বিকিরের ব্যাপারে নিয়ম-কানুন মানতে হয়। কারণ তাদেরকে সাধনার জন্য নির্ধারিত লতিফার ছবক আমল করতে হয়। একেক লতিফায় একেক ধরনের জ্বিকিরের ছবক নিতে হয়। কলবের ছবক হলো, আল্লাহ আল্লাহ। রুহতেও অনুরূপ। মানবদেহে আলমে আমর (হুকুমের জগত্) ও আলমে খালকের (সৃষ্টি জগত্) মিলে ১০টি লতিফা রয়েছে। যেমন- কলব, রূহ, ছের, খফি, আখফা, নফস, বাদ, আব, আতশ ও খাক। এসব লতিফার ওপর সর্বমোট ৩৭টি ছবক রয়েছে। কিন্তু লতিফা সমূহের ছবক ভিন্নভিন্ন হয়ে থাকে। যা তরিকার ওয়াজিফা অনুযায়ী আমল করতে হয়। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, “(তারাই পরিণামদর্শী) যারা উপবিষ্ট, দণ্ডায়মান এবং অর্ধশায়িত অবস্থায় মহান আল্লাহর জ্বিকির করে এবং আসমান ও জমীনের সৃষ্টি রহস্য সম্বন্ধে চিন্তা করে।” পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, ফলে সে সর্বদা তার সঙ্গীরূপে থাকে” (সূরা-যুখরুফ : ৩৫)।
পবিত্র কুরআনে আরও আছে, “দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের হূদয় আল্লাহর জ্বিকির থেকে বিমুখ, তারা রয়েছে প্রকাশ্য গোমরাহীতে।” (সূরা জুমার : ২২)।
আল্লাহ বলেন, “শয়তান মানুষকে নফসে সুদূরে বসে কুমন্ত্রণা দেয়” (সূরা নাছ : ৫)। রসূল (স.) বলেন, “শয়তান মানুষের দিলে বাস করে, যখন দিল আল্লাহর জ্বিকির করে তখন শয়তান তীরের মত ভেগে যায়।” কলবে জ্বিকিরের মাধ্যমে অন্তরে যাবতীয় পাপ রাশি ঝরে যায়। ফলে অন্তর পবিত্র হয়। একটি হারিকেনের চিমনিতে প্রতিদিন ময়লা পড়ে পড়ে এমনভাবে কালো হয়ে যায় যে, ভেতরের আলো পর্যন্ত দেখা যায় না। কিন্তু প্রতিদিন যদি একবার যথাযথ প্রক্রিয়ায় ওই চিমনিটি পরিষ্কার করে ফেলা হয় তবে আর আলো আড়াল হয় না। অনুরূপভাবে মানুষের দিলও প্রতি মুহূর্তের পাপ-কালিমা দ্বারা কালো হতে থাকে। তাই যিনি কলবের জ্বিকির করেন তার পাপরাশি পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে তার অন্তরচক্ষু খুলে যায়। রসূলুল্লাহ (স.) ফরমান, “আমার চোখ নিদ্রিত হলেও অন্তকরণ জাগ্রত থাকে।” এলমে তাসাওফ তথা সুফিবাদে মুখের জ্বিকিরের চেয়ে অন্তরের জ্বিকিরের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি। কারণ অন্তর হল অদৃশ্য, ধরাছোঁয়ার বাইরের বস্তু। তাই সুক্ষাতিসুক্ষ্ম আত্মার মুখে জ্বিকির জারির জন্য রুহানি শক্তির দরকার হয়। মুখে শক্তি দিয়ে জ্বিকির করলেও অন্তরে নকশা বসানো যায় না। এজন্য সুফিগণ অন্তরের জ্বিকিরের ছবক দিয়ে থাকেন। অন্তরের মুখে আল্লাহ নামের জ্বিকিরের নকশা স্থাপন করার জন্য এত্তেহাদি তাওয়াজ্জোহ শক্তি অন্তরে ধারণ করা আবশ্যক। এত্তেহাদি শক্তি হল আল্লাহর নূর বা ফায়েজ। আল্লাহর নূর থাকে খাঁটি মোর্শেদ বা অলিআল্লাহর কলবে। কলবে জ্বিকির জারি হয় মূলত মোর্শেদের হুকুম থেকে। যিনি কামেল মোর্শেদ তিনি মানুষকে তওবা পাঠ করিয়ে তার কলবে তাওয়াজ্জোহ প্রবেশ করিয়ে দেন এবং তাঁর পাকজবানিতে রূহকে জ্বিকিরের জন্য নির্দেশ করেন। ফলে কলব নিজ থেকে জ্বিকির করতে শুরু করে। আল্লাহর অলির কাছে বায়েত হয়ে তাঁর সঙ্গে দিল মিশিয়ে তাঁর দিল হতে ঐশী নূর বা ফায়েজ অর্জন করতে হয়। অতঃপর কলবে খেয়াল করে কলবের মুখে আল্লাহ নামের মধুর জ্বিকির স্থাপন করার জন্য প্রত্যেক নামাজের শেষে দুচোখ বন্ধ করে ধ্যান-মোরাকাবা করতে হয়। আর এভাবেই জ্বিকির অন্তরে সেট করে নিতে হয়। এ অবস্থা নিজের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারলে জ্বিকির আর বন্ধ হয় না, বরং সবসময় কলব জ্বিকির করতে থাকে। কলবে একবার জ্বিকির চালু হয়ে গেলে পাপকাজ না করলে কিংবা আপন মোর্শেদের সঙ্গে বেয়াদবি না হলে জ্বিকির বন্ধ হয় না। হাদিস শরিফে আছে “যে ব্যক্তি আল্লাহর জ্বিকির করে আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জ্বিকির করে না তাদের উদাহরণ জীবত ও মৃত ব্যক্তির মত (বুখারী)।
ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহ.) বলেন, “মাছের জন্য যেমন পানি দরকার, তেমনি অন্তরের জন্য জ্বিকির আবশ্যক।” তাছাড়া দেহের যেমন খাবার প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি আত্মারও খাবারের প্রয়োজন হয়। আত্মার খাবার হল ফায়েজ তথা আল্লাহর জ্বিকির। আত্মা পবিত্র না হলে কোন ইবাদতই শুদ্ধ হয় না। তাই আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন সবার প্রথমে। অলিআল্লাহগণ হলেন আত্মার শিক্ষক। দুনিয়ার সব কাজ শিক্ষার জন্য যেমন শিক্ষকের নিকট যেতে হয়, তেমনি আত্মশুদ্ধির জন্যও আত্মিক শিক্ষক অলিআল্লাহর অনুসন্ধান করা ফরজ। মোমেনের জন্য সাধনার অর্জন হল ওহী, এলহাম, স্বপ্ন, কাশফ ও ফায়েজ। ওহীর দরজা বন্ধ। কিন্তু অবশিষ্ট চারটি কেয়ামত পর্যন্ত বহাল আছে। যে ওয়াজিফা আমল করে এ চারটির মর্তবা অর্জন করা যায় না, সে আমল নিষ্ফল। তাই যার সোহবতে গেলে এসব মর্তবা লাভ করা যায়, আত্মার পরিবর্তন হয়, মুর্দা দিল জিন্দা হয় এবং ফায়েজ বুঝা যায় সে রকম যোগ্যতার মোর্শেদের অনুস্মরণ করতে হবে। যিনি নিজেই আলোকিত নন, তার কাছে অন্ধকারে ডুবা মানুষ গিয়ে কি-ই বা ফায়দা পাবেন? অন্তরের জ্বিকির আত্মাকে পরিষ্কার ও পবিত্র করে তোলে। হাদিসে আছে, “প্রত্যেক জিনিসকে পরিষ্কার করার বস্তু রয়েছে, দিলের ময়লা পরিষ্কার করার বস্তু হল জ্বিকির” (মেশকাত শরীফ)।
সুতরাং কলবে জ্বিকির পয়দা করার মাধ্যমেই কলবকে পরিশুদ্ধ করা যায়। প্রত্যেক নামাজের শেষে সাধক মোরাকাবা অবস্থায় যার যে লতিফায় জ্বিকির বা ছবক তিনি তাতে খেয়াল করুন। গভীর ভাবে ডুবে যাবেন কলবের মধ্যে। আপন মোর্শেদের নূরানি চেহারা মোরাকাবায় সামনে নিয়ে গভীরভাবে আল্লাহকে স্বরণ করে তাঁর সাহায্য ভিক্ষা চাইতে হবে। এভাবে মোরাকাবা করতে করতে এমন একটা সময় আসবে যখন আপন মোর্শেদের নেক দৃষ্টি, দয়াল রসূল (স.)—এর মহব্বত ও আল্লাহপাকের অপার দয়ায় কলবে জ্বিকিরের ধ্বনি শোনা যাবে। এভাবে সাধনা ও এবাদত করতে করতে কলবে আল্লাহর জ্বিকিরের নকসা বসে যাবে। প্রত্যেক লতিফা থেকে জ্বিকির শোনা যাবে। এমনকি কখনও কখনও সর্বশরীরে জ্বিকির হবে। জ্বিকিরের কম্পন জাহেরিতেও বুঝা যায়। এ স্তরে সাধক সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য লাভ করবেন। কলবের এমন সাধনার জন্য বনে জঙ্গলে যেতে হয় না। জীবনের সব কাজ করেও ইচ্ছা থাকলে এরূপ সাধনা পাঁচওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে ও রহমতের ইবাদতের মধ্যে করা যায়। আর এর পদ্ধতি ও কৌশল শিক্ষার জন্য খাঁটি মোর্শেদের পরামর্শ ও তাঁর প্রবর্তিত ওয়াজিফা আমল করতে হয়।