বকরের হেলিকপ্টার-ফেরি রহস্য

বকরের হেলিকপ্টার-ফেরি রহস্য

খবর বাংলা ২৪ডেক্স: পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক (এ বি সিদ্দিক) অপহরণের ঘটনার রহস্যের উন্মোচন হয়নি। অনেক প্রশ্নের উত্তর না মেলায় জনমনে উদ্রেক হয়েছে নানা সন্দেহের। বিশেষ করে এ বি সিদ্দিকের দুই দফা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পাওয়া, দুবার ফেরি পার হওয়া এবং চোখ বাঁধা থাকার পরও হলফ করে সময় বলে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে চলছে সর্বত্র আলোচনা। সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল।

অন্যদিকে, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটির তদন্ত করতে গিয়ে রীতিমতো গোলকধাঁধায় পড়েছেন গোয়েন্দারা। অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। আবার ‘ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার পাওয়া রিজওয়ানা হাসান ও তার স্বামী এ বি সিদ্দিক তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ছোড়া অনেক প্রশ্নের উত্তরও কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। তবে অপহরণের ঘটনাটির নেপথ্য কাহিনী পুরোপুরিভাবে উন্মোচন করে জাতির সামনে তুলে ধরার দাবি জানিয়েছেন অপরাধ-বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনেরা।

অনুসন্ধান কমিটির প্রধান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান জানান, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তদন্ত চলছে। এ সময় কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রিজওয়ানার স্বামীর অপহরণের ঘটনাটি এখনো রহস্যাবৃত। মনে উদ্রেক হওয়া অনেক প্রশ্নের উত্তর আমরা পাচ্ছি না। তবে রিজওয়ানা বারবারই তার নিজের ওপর ক্ষুব্ধ কোনো গোষ্ঠীর ওপর সন্দেহের তীর ছোড়ার চেষ্টা করছেন। তার স্বামী একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। তারও তো কোনো শত্রু থাকতে পারে। কিংবা অন্য কোনো ঘটনার ফসল হতে পারে এটি। কিন্তু তা মানতে চাইছেন না তিনি।’ ঘটনার অনুসন্ধানে ফেলুদা কিংবা সত্যজিৎ রায়ের প্রসঙ্গ টেনে জিনাত হুদা বলেন, ‘ধরুন দেশীয় কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র এ বি সিদ্দিককে অপহরণ করেছিল। কিন্তু কোনো শর্ত ছাড়াই তারা তাকে ছেড়ে দিল? এতে করে একটা রহস্য তৈরি হয়েছে। পুরো ঘটনাটিতে লেগেছে কালিমা।’

অপরাধ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোখ বাঁধা অবস্থায় এ বি সিদ্দিক কীভাবে বুঝলেন যে তিনি দুবার ফেরি পার হয়েছেন! আবার তিনি বলেছেন দুই দফা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, অপহরণকারীদের মূল হোতা ‘ভাই’ নামক বস্ কখন এসেছেন, ওই বাসা থেকে অপহরণকারীরা ঠিক কোন সময় তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রওনা হয়েছে, ঠিক কখন মিরপুর আনসার ক্যাম্পের সামনে নামিয়ে দিয়েছে, তাও এ বি সিদ্দিক বলে দিচ্ছেন। এমনকি দুটি ফেরি পার হওয়ার সময় উল্লেখ করে এ বি সিদ্দিক পুরো বিষয়টিকে ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রথম ফেরি পার হতে আধঘণ্টা এবং দ্বিতীয় ফেরি পার হতে আধঘণ্টার কম সময় লেগেছে। এমনকি তাকে তুলে নেওয়ার পর মাইক্রোবাসটি প্রথমে কত সময় এবং প্রথম ফেরি পার হওয়ার পর দ্বিতীয় ফেরিতে উঠতে কত সময় লেগেছে তারও বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে দ্বিতীয় মাইক্রোবাসটি ছাইরঙা ছিল বলে তিনি যে তথ্য দিয়েছেন, তাও প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

এ বি সিদ্দিকের ভাষ্য উল্লেখ করে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট বলেন, অপহরণকারীরা নিয়ে যাওয়ার সময় দুটি ফেরি পার করলেও ফেরার সময় কোনো ফেরি পার করেনি। তাকে যে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল সেখানে যেতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগলেও আনসার ক্যাম্পের সামনে পৌঁছে দিতে লেগেছে মাত্র ঘণ্টাখানেক। তাহলে তিনি ওই বাড়ি থেকে কোন যানবাহনে এসেছিলেন? যদিও তিনি বলছেন, তাকে মাইক্রোবাসে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা এ বি সিদ্দিকের বরাত দিয়ে আরও বলেন, একান্ত জিজ্ঞাসাবাদে এ বি বলেছেন, অপহরণকারীরা তাকে তুলে নেওয়ার সময় মারধর করে। দ্বিতীয় মাইক্রোবাসে তোলার সময়ও তাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। কিন্তু তার শরীরে মারধরের তেমন কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চিকিৎসকরাও বলেছেন, এ বি সিদ্দিকের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো আছে। শুধু তার রক্তচাপ বেশি। অপরাধ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বি সিদ্দিক সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, তাকে এক সেকেন্ডের জন্যও চোখ খোলা হয়নি। আবার তিনি বলছেন, টয়লেটে যাওয়ার সময় তার চোখ খুলে দেওয়া হতো। তার ড্রাইভারকে প্রথম দিন পুলিশের হেফাজত থেকে নিজ জিম্মায় নিয়ে আসা হয়েছিল। তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের উচিত গাড়িচালককে গুরুত্ব সহকারে জিজ্ঞাসাবাদ করা। তারা আরও বলছেন, অপহরণকারীরা কোনো নির্যাতন করেনি। তাহলে এ বি সিদ্দিকের জামা ছিঁড়ল কীভাবে? এ বি সিদ্দিকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাত সাড়ে ১১টার দিকে অপহরণকারীরা তাকে মিরপুর আনসার ক্যাম্পের সামনে ছেড়ে দিয়েছিল। তবে রাত সোয়া ১টা পর্যন্ত তিনি কোথায় ছিলেন? আবার আনসার ক্যাম্প থেকে তিনি উল্টো পথে কাজীপাড়ার দিকে গিয়েছিলেন কেন? ‘যে কোনো শর্তে আমি আমার পরিবারের সদস্যকে ফেরত চাই’-সংবাদ সম্মেলনে রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে অপর এক ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ওই শর্তগুলো কী? তাহলে কি অপহরণকারীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে বা আগেই ছিল? এগুলো তিনি এখনো পরিষ্কার করেননি।

আবার প্রায় এক যুগ ধরে বন্ধ পোশাক কারখানাটির মালিকানা হঠাৎ করে কীভাবে তিন মাস আগে রিজওয়ানার পরিবার পেয়ে গেল? এর নেপথ্য কারণ কী? এদিকে, এ বি সিদ্দিকের ফিরে আসাটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে ড. জিনাত বলেন, পর্দার আড়াল থেকে অপহরণের ব্যাপারে যারা কলকাঠি নেড়েছেন, অনুসন্ধান কমিটির উচিত তাদের মুখোশ উন্মোচিত করা। কারণ এই অপহরণের ঘটনাটি সরকারকে বিব্রত করার মোটিভও হতে পারে। কোনো একটি মহলের হয়তো উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে দুর্বল, নাজুক ও জনগণের প্রতি সরকারের বিন্দুমাত্র দায়বোধ নেই এটি প্রমাণ করা। প্রসঙ্গত, বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভূঁইগড় থেকে এ বি সিদ্দিক অপহৃত হওয়ার ৩৫ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার রাতে তাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। এর আগে ফতুল্লা মডেল থানায় করা মামলায় তার স্ত্রী রিজওয়ানা হাসান উল্লেখ করেন, ‘পেশাগত কারণে আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে আসছি, যা অনেকের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এসব মহল বিভিন্ন সময় আমার বিরুদ্ধে প্রচারমাধ্যমে নানা অপপ্রচার চালিয়েছে এবং বিভিন্নভাবে আমাকে আমার কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে। আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে।’

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend