বিএনপি এখন বিশ্রাম ও অবকাশে আছে-বিশেষ সাক্ষাৎকারে হান্নান শাহ
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ্দেশের সব রাজনৈতিক দলের মতো বিএনপিও এখন রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশনে (বিশ্রাম ও অবকাশে) আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ্। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি না থাকায় বিএনপির মতো দলের নেতাকর্মীদের এখন অনেকটা বিশ্রামে থাকতে হচ্ছে। কবে নাগাদ কর্মসূচি আসতে পারে তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলেও তিনি মনে করেন।সম্প্রতি মহাখালীস্থ ডিওএইচএসএর নিজ বাসায় একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ওয়ান ইলেভেনের পরীক্ষিত ও নির্যাতিত এই শীর্ষ নেতা এ সময় নিজের রাজনৈতিক জীবন, সেনা জীবন, দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জিয়া পরিবার এমনকি নিজের পারিবারিক বিষয় নিয়েও খোলামেলা কথা বলেন।হান্নান শাহ বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার আগে দলকে সংগঠিত করে তোলা জরুরি। তারই অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলা কমিটিসহ অন্যান্য কমিটির পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা থেকে জেলা পর্যায়ে সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য যুগ্ম মহাসচিবদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্রিটিশবিরোধী ফকির-দরবেশ আন্দোলনে তারই পূর্বপুরুষ ফকির মজনু শাহ্ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি নিজেও বেছে নিয়েছিলেন সু-শৃঙ্খলিত সেনা জীবন। তাই একাধারে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরোধিতাকারী বিদ্রোহীর রক্ত যেমন তার শরীরে বইছে, তেমনি সেনাজীবনের দেশপ্রেম ও আনুগত্য রয়েছে তার জীবনে। এসব কারণে যখনই কোনো অন্যায় দেখেন তখনই বিদ্রোহ করেন। যেমনটি করেছিলেন, জিয়া হত্যাকা-ের পরপরই। তৎকালীন সেনাকমান্ডের বিরোধিতা করে নিজ উদ্যোগে জিয়াউর রহমানের মরদেহকে উদ্ধার করে রাজধানী ঢাকায় প্রেরণ করেছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশে আন্দোলনের তীব্রতা পেঁৗছে দিয়েছিলেন। তেমনি ওয়ান ইলেভেনে জিয়া পরিবারের দুঃসময়ে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছিলেন। যার কারণে শুধু তিনি নিজে নির্যাতিত হননি, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।ওয়ান ইলেভেনের সময়ের মতো এবারো দলে ভূমিকা পালন করবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে হান্নান শাহ বলেন, পরিস্থিতি এলে আবারো হান্নান শাহ্ তৈরি হয়ে যাবেন। তিনি একজন সৈনিক। আর একজন সৈনিক তখনই যুদ্ধ করেন যখন বহিঃশত্রু আক্রমণ করে। বিএনপিতে এখন বহিঃশত্রুর আক্রমণ নেই। যা আছে তা নিজেদের ব্যর্থতা। আর আন্দোলনের এ সব ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করে সামনের দিনগুলোতে এগোতে হবে বলে তিনি মনে করেন।হান্নান শাহ্ বলেন, আন্দোলনে দল ও জোটের অনেক নেতাকর্মী আহত-নিহত হওয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার নেতাকর্মী অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। প্রায় সব নেতাকর্মী এলাকাছাড়া ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। কিন্তু বিএনপি হঠাৎ করে রাজপথের আন্দোলন থেকে পিছুটান দেয়ায় স্বাভাবিকভাবে এসব নেতাকর্মীদের ভেতর ডাবল (দুই গুণ) ক্ষোভ রয়েছে। কারণ আন্দোলনের মধ্যে থাকলে তারা যেমন ব্যস্ত সময় পার করতে পারেন তেমনি সরকার পতনের অপেক্ষায় থাকতে পারেন। কিন্তু এখন অলস সময় পার ও এই সরকারের দীর্ঘমেয়াদি থাকার দুশ্চিন্তা কাজ করছে তাদের মধ্যে।বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল নিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের আরপিও বাধ্যবাধকতার কারণে আগামী জুন মাসের মধ্যে কাউন্সিল করতে হবে। তবে কাউন্সিল করার আগে মহানগরসহ সব কমিটি পুনর্গঠন করে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা উচিত। এবার দলের চেয়ারপারসন এ ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন।
কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের মহাসচিব পরিবর্তন বা ভারমুক্ত হচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি প্রশ্নটা অনেকটা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আন্দোলনে অনেক সিনিয়র নেতাদের ব্যর্থতা ছিল। আর এই নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণেই ছাত্রদল ও যুবদলের মতো তরুণদের কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।
মহাসচিব নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাপুরুষদের দিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। আর এটাই বাস্তবতা। কর্মীরা কেন্দ্রের নির্দেশমতো মাঠে থাকলেও সঠিক সময়ে সঠিক দিক-নির্দেশনার অভাব ছিল। এজন্য কর্মীদের মাঝে আশাহত মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। আগামী কাউন্সিলে এসব বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি মনে করেন।
দেশব্যাপী সরকারবিরোধী ও নির্বাচন ঠেকাও আন্দোলনের ঢেউ উঠলেও রাজধানী ঢাকা ছিল নিরুত্তাপ। এ প্রসঙ্গে হান্নান শাহ্ বলেন, ঢাকা মহানগর নেতৃত্ব সুসংগঠিতভাবে আন্দোলনে যোগ দেয়নি। তারা মূলত পলাশীর ট্র্যাজেডির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে- সারাদেশের নেতাকর্মীদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ।
ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক এই নেতা জানান, ঢাকা মহানগরে অসংখ্য ত্যাগী নেতাকর্মী রয়েছেন। এদের জন্য দরকার সুযোগ্য নেতৃত্ব। কিন্তু বারবার গোল দিতে ব্যর্থ হলে তাকে পরবর্তী ম্যাচে রাখা হবে কিনা তা চিন্তা করতে হবে।
ঢাকা মহানগর বিএনপি দুই ভাগ করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এরকম সিদ্ধান্তের কথা জানেন না। তবে এটা করা হলে আওয়ামী লীগের বিভক্ত সিটি করপোরেশন নীতিকে মেনে নেয়ার শামিল হবে।
মহানগরের দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নেত্রী কোন দায়িত্ব দিলে তা পালন করা আমাদের রাজনীতির জন্য ফরজ।’
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে হান্নান শাহ্ বলেন, তিনি মনে করেন বিদেশি শক্তির প্রভাবে ও ইন্ধনে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, দিলি্লর দিকনির্দেশনা নিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। বিদেশি চক্রান্ত ছাড়া আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তারা ক্ষমতায় এসে প্রতিবার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে। সংবিধান নিয়ে আওয়ামী লীগ জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে তারা এ কাজ করেছে। ভারত বাংলাদেশকে অঙ্গরাজ্য হিসেবে ব্যবহার করতে চায় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের দলের কেউ যদি মনে করে এই সরকারকে বিদেশিরা সমর্থন দেয়নি, সেটা তাদের ভুল ধারণা।
নির্বাচন কমিশনের প্রসঙ্গে সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, বিতর্কিত এই নির্বাচন কমিটি কাজীর খাতায় আছে গোয়ালে নাই। এই নির্বাচন কমিশন জনগণ মেনে নেয়নি। এরা কোনো নির্বাচনে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেনি।
জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ সম্পর্কে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, এরশাদ ও রওশন পরস্পর বিরোধী দল। এখন স্ব-স্ব স্বার্থ অর্জনের জন্য তারা এক হয়েছেন। তা ছাড়া রাজনীতিতে এরশাদ তার স্বভাবসুলভ আচরণ করছেন।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে এরশাদের দ্বৈত ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এরশাদ মূলত ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেন না এবং ভবিষতেও পারবেন না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উভয় পক্ষের দায়িত্বশীলতা সঠিকভাবে পালন করেননি। সরকার একটি নির্দিষ্ট নীলনকশা নিয়ে এগিয়েছে। কিন্তু তা প্রতিরোধের জন্য বিএনপি কিছুই করেনি। দেশের ক্রান্তিলগ্নে এসে পৃথিবীর সব স্থানে সংলাপকে গুরুত্ব দেয়া হয়। একই সঙ্গে সংলাপের প্রতিটি বৈঠকের অবস্থা ও অগ্রগতি গণমাধ্যমে জনগণকে জানানো হয়। কিন্তু এখানে এই সংলাপকে বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যম থেকে আড়াল করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনে অনেক এলাকায় জামায়াতের বিরোধিতা ও অসহযোগিতার কারণে বিএনপি হেরে গেছে_ এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেমন জোটগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তেমনটি এই উপজেলা নির্বাচনে নেয়া হয়নি। এ ছাড়া নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিদ্ধান্তহীনতাকেও দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের সিদ্ধান্তে অনেক ত্যাগী নেতা নিষ্ক্রিয় ছিলেন, অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে, যার দরকার ছিল না।
হান্নান শাহ বলেন, আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা যদি প্রশাসন ও পেশিশক্তির জোর না দেখাত তাহলে উপজেলা নির্বাচনে ১০-১২টির বেশি আসন পেত না।
বর্তমান সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে না। বিএনপি গতবারের আন্দোলনে যে সব ভুল করেছিল এবার সেই ভুল সংশোধন করে আবারো আন্দোলনে নামবে। আর এবারের আন্দোলনে সরকার বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল।