রাজনীতির চাপে অসহায় সরকারি কর্মকর্তারা

rajখবর বাংলা২৪ ডেক্স: 

প্রস্তাবিত গণকর্মচারী আইন হিমাগারে; ক্ষমতাসীনদের হুকুম তামিল না হলেই হয়রানি; ৯০ দশকের পর চাকরিচ্যুতি, ওএসডি, সংযুক্তি, হয়রানিমূলক বদলির ব্যাপকতা বাড়ে; আমলাতন্ত্রের ক্রান্তিকাল কাটছে না। মেধা, আইন-কানুনকে বিচার-বিবেচনা না করে ধারাবাহিকভাবে স্বেচ্ছাধীন কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয়ার কারণে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে বেসামরিক প্রশাসন তথা আমলাতন্ত্র। ফলে নির্বাচিত সরকারের কুড়ি বছর পথচলার সময়ে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি—এমন মন্তব্য বিশ্লেষকদের।

প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৯০ দশকের পর থেকে আমলাতন্ত্রকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বা ক্ষেত্রবিশেষে ঢালাওভাবে ব্যক্তি বা দলের পক্ষে কাজে লাগানোর প্রবণতা শুরু হয়। সেই থেকে ক্ষমতায় আসা প্রত্যেক সরকার আমলাদেরকে আইন-কানুনের পরিবর্তে স্বেচ্ছাধীন সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার প্রক্রিয়া কমবেশি অনুসরণ করে আসছে। দেশের সংবিধানে গণকর্মচারীদের আইন করার কথা বলা হলেও আজও তা হয়নি।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বেসামরিক আমলাতন্ত্রে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। উপজেলা, জেলা থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে (সচিব) থাকা কর্মকর্তারাও রয়েছেন নানা অস্থিরতায়।
ভুক্তভোগী আমলারা বলছেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই মান-সম্মান নিয়ে তারা স্বাভাবিক কাজ করতে পারছেন না। নেতা-পাতি নেতাদের দৌরাত্ম্যে মাঠ প্রশাসনে কার্যত নাভিশ্বাস উঠেছে। কথায় কথায় হয়রানিমূলক বদলি, ওএসডি, সংযুক্তির যাঁতাকলে ফেলবার হুমকি রয়েছে তাদের মাথার ওপর।
সূত্র নিশ্চিত করেছে, অনেক সময় ক্ষমতার মূল কেন্দ্রের কোন কোন কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়েও হুমকি-ধামকি চলছে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতি নেতা এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে জনপ্রতিনিধিদেরও কেউ কেউ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভাল আচরণ না করার অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় কর্মরত জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে আমলাদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধির আচরণ কেমন হবে- সেটি নির্ধারণ করে নীতিমালা জারির প্রস্তাব করেছেন। আগামী জুলাই মাসে শুরু হতে যাওয়া ডিসি সম্মেলনে তার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি করেছেন ওই জেলা প্রশাসক।
সূত্র বলছে, আমলারা যদি আইন-কানুন বা বিধি-বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হতে না পারেন তবে প্রশাসনে বিশৃংখলা দেখা দিতে বাধ্য।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসার জন্য নির্বাচন পদ্ধতির কাজ শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পুনরায় আমলাদের ব্যবহার করে প্রশাসনকে দলীয়করণের কাজ শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন পক্ষ অনেক কর্মকর্তাকে জনতার মঞ্চের (১৯৯৬ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক মঞ্চ) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে চিহ্নিত করে বাধ্যতামূলক চাকরিচ্যুতি, অসম্মানজনক বদলি, হয়রানি, সংযুক্তি, ওএসডি করে। এর আগে অবশ্য ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে ১৩ সচিবকে এক রাতে অসম্মানজনক বদলি করে। ফলে প্রশাসনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে আওয়ামীপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করে শত শত কর্মকর্তাকে নানা রকম হয়রানি করা হয়। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার বিএনপি-জামায়াতপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করে অনেক আমলাকে একইভাবে হয়রানি করে। ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারও আমলাদের ওপর হয়রানি অব্যাহত রাখে। ২০০৯ সালের পর আজ পর্যন্ত আমলাদের ওপর আচরণের কোন হেরফের হয়নি। যখনই কাউকে পছন্দ না হয় বা কেউ বেআইনী হুকুম তামিলে অসম্মতি জানান, তখনই তার গায়ে একটি দলীয় সীল লাগিয়ে হয়রানির প্রবণতা আগের তুলনায় বাড়ছে।
সূত্র বলছে, নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি, পোস্টিং—সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে স্বেচ্ছাধীন বিবেচনাবোধ। ৯০ দশকের পর বেসামরিক আমলাদের জন্য একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়া হলেও আজ অবধি তা করা হয়নি। যখন যে সরকার আসে তখন তাদের সুবিধামত এডহক নীতিমালা করে আমলাদের পরিচালনা করা হয়।
সর্বশেষ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ গণকর্মচারী আইন করার জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে একটি খসড়া করেছিল। বেশকিছু সেমিনার, কর্মশালা হয়েছিল। কিন্তু গণকর্মচারীদের চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ওই আইন হিমাগারে চলে গেছে।
আমলাদের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণভার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হাতে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করলেও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেই হয়। এ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী বলছেন, অতীতের মতো হয়রানিমূলক কোন পদক্ষেপ বর্তমান সরকার নিচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে বদলি করা হয় না। নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা ও কর্মদক্ষতাকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে দাবি এই সচিবের। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন আমলাতন্ত্রের জন্য একটি স্থায়ী আইন থাকা দরকার। সেটির জন্য নতুন করে আবার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী নিজেই সচেতন আছেন।
মাঠ প্রশাসনে ইউএনও-ডিসিদের ওপর জুলুমবাজি চলছে এমন কথা অবশ্য একাধিক জেলার ডিসি ও ইউএনও স্বীকার করেছেন। তারা বদলির জন্য তদ্বিরও করছেন। আবার অনেক এলাকা থেকে ডিসি-এসপি, ইউএনও ওসিদের তুলে নেয়ারও তদ্বির হয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এমপিদের পক্ষ থেকে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক অবশ্য বলছেন, আমলাতন্ত্রের ওপর কোন চাপ বা জুুলুম চলছে এমন অভিযোগ তার কাছে নেই। নিয়োগ-বদলি নিয়মিত কাজের অংশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেখানে রদবদল প্রয়োজন সেখানে তা করা হবে। এটি কারো তদ্বিরে করা হবে বা হচ্ছে এমন ধারণা ভুল।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend