এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি আহত ৩৩ শ্রমিক

এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি আহত ৩৩ শ্রমিক

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

রানা প্লাজা ট্র্যাজিডির এক বছর পার হতে চললেও এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি আহত ৩৩ শ্রমিক। এরা বর্তমানে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র-সিআরপিতে বিভিন্ন ট্রেডে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শেষে সিআরপি যে আর্থিক সহায়তা দেবে সেটাই এখন তাদের ভরসা।

গতকাল সোমবার সরেজমিনে সিআরপিতে গেলে আহত শ্রমিকরা প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ পাননি অভিযোগ করে এই প্রতিনিধিকে জানান, দুর্ঘটনার পর বায়ারদের পক্ষ থেকে ১৫ হাজার করে তিন মাসের বেতন বাবদ ৪৫ হাজার টাকা আর ডিসি অফিস থেকে কেউ ১০, কেউ বা ১৫ হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই পাননি। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ।

আগামী ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজিডির একবছর পূর্ণ হচ্ছে। সেদিনের ভয়াবহ ঘটনার প্রসঙ্গ তুললে আহত শ্রমিকরা জানান, ওই কথা (ভবন ধস) আর মনে করতে চাই না। কেমন যেন হাহাকার লাগে। এমন হাহাকার লাগার পরও তাদের ভুলে থাকার উপায় নেই, কারণ জীবন চালানোর জন্য একটা অবলম্বন প্রয়োজন। শ্রমিকরা জানান, তাদের জীবনে চলার গতি নাই। প্রতিদিনই থেমে যেতে চায়, বাদ পরে প্রয়োজন। কারো ভাইয়ের পড়া বন্ধ হয়, কারো মেয়ের। বিয়ের স্বপ্ন দখাও বন্ধ করেছেন অবিবাহিতরা। তাদের দাবি শুধু একটাই- জীবন চালানোর একটা অবলম্বন চাই। 

নিউ ওয়েব স্টাইলের হেলপার মাহফুজা কাজ করতেন রানা প্লাজার ৩ তলায়। সেইদিন তার পায়ে আর শরীরের নিম্ন অংশে আঘাত পান। আঘাত এতই প্রচণ্ড যে এখনও বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না। রোজ আসেন সিআরপিতে। এখানে তার চিকিত্সা হচ্ছে আর ট্রেনিং নিচ্ছেন টেইলারিংএ। দুই সন্তানের পড়াশুনা, বাড়ি ভাড়া দিয়ে রিকশা চালক স্বামী সংসার চালাতে পারেন না। মাহফুজা ছলছল চোখে বলেন, স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কও কেড়ে নিয়েছে এই দুর্ঘটনা। স্বামী প্রায়ই রাগ করেন। ওষুধ খেয়ে একটু ভাল থাকলেও কষ্ট হয় তার। 

জাকির হোসেন দুই সন্তানের জনক মাথা, বুক আর কোমড়ে আঘাত-পেয়েছেন। সুস্থ হয়ে একটি গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে ফিরে এসেছেন। মেশিনের শব্দ তাকে অসুস্থ করে ফেলেছে। এখন সিআরপিতে ট্রেনিং নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা। সংসার চলছে এর ওর সাহায্যে। 

১৯ বছরের রিমা মাথা নিচু করে বলেন, ‘বাপ-মায়রে সাহায্য করতাম, ছোট ভাইটা পড়তো। এখন বুড়া বাপই কাজ করে আমার খরচ চালায়। আমার চিন্তা, কবে আমি কাজ করুম। বিয়ের কথা ভুলেও ভাবি না, ভাবি শুধু কেমনে বাঁচুম। সংসার বাঁচামু।’ 

সিআরপি ভকেশনাল ট্রেনিংএ এই ৩৩ শ্রমিকের মধ্যে ১১ জন টেইলারিং শাখায় তিনমাসের ট্রেনিং নিচ্ছেন। এছাড়া জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্সে ৩ জন ছয় মাসের, দোকান ব্যবস্থাপনায় ১৬ জন এক মাসের এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণে ৩ জন তিন মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। তারা শুনেছেন এই প্রশিক্ষণ শেষ হলে তাদের সিআরপির পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তারা। 

সিআরপির নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব) সফিকুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, এপ্রিল মাস থেকেই তারা রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের একটি বিশেষ অংশকে চিহ্নিত করে সেবা দান শুরু করেছেন। যারা শারীরিকভাবে কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ- যেমন কোমড়ে ব্যথা, পা ছোট হওয়া, মেরুদন্ড ও বুকের হাড়ভাঙ্গা- তাদের চিকিত্সা দেয়ার পাশাপাশি যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন সেজন্য ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমরা তাদের জন্য দেশে ও বিদেশ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। যে ফান্ড জমা পড়েছে তা দিয়েই তাদের সহযোগিতা করা সম্ভব হবে। ট্রেনিং শেষে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে সহায়তা দেয়া হবে বলে তিনি জানান।

ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট রিসার্চ কমিটির প্রধান অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী মৃত ও দুইঅঙ্গ হারানো শ্রমিক পরিবার ১৫ লাখ টাকা, এক অঙ্গ হারানো শ্রমিক সাড়ে ৭ লাখ টাকা এবং কম আঘাত প্রাপ্ত ও মানসিক ক্ষতিগ্রস্তরা দেড় লাখ থেকে শুরু করে ক্ষেত্র বিশেষে পাঁচ লাখ টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা পাবেন।

কিন্তু কেন সিআরপির এই ৩৩ শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পাননি -এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল সিপার বলেন, তাদের তো পাঁচ লাখ টাকা করে পাওয়ার কথা। সকলকে তালিকাভুক্ত করে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এই ৩৩ জন কেন ডিসির দেয়া টাকা ছাড়া আর কোন টাকা পাননি তা ভেবে দেখবার বিষয়। তবে তারা রানা প্লাজার শ্রমিক না-ও হতে পারে বলে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, রানা প্লাজার শ্রমিক হলে কেন সিআরপি এই বিষয়ে সরকারকে ইনফরমেশন দেয়নি। বিষয়টি তিনি সুরাহা করবেন বলে আশ্বাস দেন। 

এদিকে গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, ওই ঘটনায় গাইবান্ধার নিহত শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে এখনও পুনর্বাসন করা হয়নি। ফলে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ওই ভবন ধসে জেলার নারীসহ ৪৯ জন নিহত, ১১ জন নিখোঁজ ও শতাধিক আহত হয়। তবে ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর অনুদান হিসাবে নিহত পরিবারপ্রতি এক লাখ টাকা করে দেয়া হয়। এছাড়া তিন দফায় প্রতি পরিবারকে ৪৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend