বাকশাল গঠনে সায় ছিল না তাজউদ্দীনের

20592_f3

পঁচাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দল পরিচালনা এবং যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একক ক্ষমতার অধিকারী হন তিনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল গঠনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এ নিয়ে তাদের মতবিরোধ পরিবার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে আদর্শগত মতবিরোধও হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ প্রশ্ন তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়স্বজনদের নানা সুবিধা নেয়া প্রসঙ্গেও। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ) গঠন করতে যাচ্ছেন শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, এ জন্যই কি আমরা ২৪ বছর সংগ্রাম করেছি? যেভাবে দেশ চলছে তাতে আপনিও থাকবেন না, আমরাও থাকবো না। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদের লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা’ বইতে বাকশাল গঠনে তাজউদ্দীন আহমদের আপত্তি ও মন্ত্রিসভা থেকে তার পদত্যাগ অংশের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিস্তারিত বর্ণনায় শারমিন লিখেছেন,  আব্বু ও মুজিব কাকু একে অন্যের গৃহে যাতায়াত করতেন অবাধে। তাঁরা একত্রে বুদ্ধি-পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। রাতের পর রাত জেগে দু’জনে মিলে দেশ ও দশের জন্য কাজ করতেন। তারা ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাঁদের দু’জনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশই বাড়তে থাকলো। এবারে মুজিব কাকুর আগমনের প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। নীতিগত ও আদর্শিক ব্যাপার দু’জন তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছেন। আব্বু ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে তিনি আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না, মুজিব কাকু যেদিন ইস্তফা দিতে বলবেন সেদিনই তিনি ইস্তফা দেবেন। নিজে থেকে ইস্তফা দিয়ে মুজিব কাকুকে বিব্রত করবেন না, আবার তাঁর আজীবনের নীতি ও আদর্শের সঙ্গেও আপস করবেন না। তিনি রাগ করে ক’দিন অফিসে যাননি।মুজিব কাকুর আসার খবর পেয়ে আম্মা উপরে গেলেন। আব্বুর সঙ্গে মুজিব কাকুর তখন ভীষণ তর্ক চলছে। আব্বু ওনাকে বলছেন, ‘মুজিব ভাই আজকে আমি আপনাকে যে কথাগুলো বলবো, আমি জানি আপনি সে কথাগুলো যুক্তি দিয়ে খ-াতে পারবেন না।’ আব্বু গণতন্ত্রকে হত্যা করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক লীগ)- যা তিনি গঠন করতে যাচ্ছেন তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে বললেন। প্রশ্ন তুললেন দলের হাতে অস্ত্র, দলীয় ক্যাডারদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বাধার সৃষ্টি ও সাধারণ মানুষদের তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আত্মীয়স্বজন ও দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অন্যায় সুবিধা গ্রহণ সম্পর্কে। আব্বু বললেন, ‘মুজিব ভাই, এই জন্যই কি আমরা ২৪ বছর সংগ্রাম করেছিলাম? যেভাবে দেশ চলছে, আপনিও থাকবেন না, আমরাও থাকবো না, দেশ চলে যাবে রাজাকার- আলবদরদের হাতে।’বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আব্বু তাঁর চূড়ান্ত মতামত মুজিব কাকুকে জানিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরীকে সাক্ষী রেখে তিনি মুজিব কাকুকে ফোন করে বলেছিলেন, আপনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা। আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সঙ্গে একমত নই… বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেয়া আছে যে, সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সব সময়, আজকে আপনি একটি কলমের খোঁচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দ্য ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইউর পজিশন।

২৬শে অক্টোবর দুপুর ১২.২২ মিনিটে আব্বু পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে অফিস থেকে ফোন করে আম্মাকে জানালেন, লিলি, আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছি। ১২টা বেজে ২২ মিনিটে আমি পদত্যাগপত্রে সই করেছি। ফোনের মধ্যেই আম্মা আব্বুকে অভিনন্দন জানালেন। আম্মার ওহঃঁরঃরাব ঝবহংব ছিল প্রখর। ’৭২ সাল থেকেই তিনি আব্বুকে বলতেন যে আব্বু মন্ত্রিসভায় বেশি দিন টিকতে পারবেন না, তাকে কাজ করতে দেয়া হবে না। 

দুপুর একটার কিছু পরে আব্বু সরকারি বাসায় ফিরে এলেন বন্ধু আরহাম সিদ্দিকীর গাড়িতে করে। নিজের জন্য সরকারি গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করলেন পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই। আব্বু ফিরে আসার পরপরই আমাদের বাড়ি লোকারণ্য হয়ে গেল। সকলেরই প্রশ্ন তার পদত্যাগ সম্পর্কে। আব্বু হাসিভরা মুখে পদত্যাগ সম্পর্কিত প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে গেলেন। মুজিব কাকুর বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না। 

আম্মা আমাদের বললেন, তোমাদের আব্বু পদত্যাগ করে মহাসম্মানের কাজ করেছেন। পরদিন সব পত্রিকার শিরোনামে আব্বুর পদত্যাগের বিষয়টি প্রকাশিত হলো- তাজউদ্দীনের পদত্যাগ। সরকার-প্রভাবিত কিছু কাগজে লেখা হলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করানো হলো। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থটা কি? এই প্রশ্নের কোন উত্তরই খুঁজে পেলাম না। পত্রিকার কোন বিবরণে না। নিজের হৃদয়েও না। ঐতিহাসিক চরমপত্রের রচয়িতা ও পাঠক এম আর আখতার মুকুল আব্বুর পদত্যাগ সম্পর্কে লিখেছেন, মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। মনে হলো বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে শাণিত তরবারি অদৃশ্য হয়ে গেল। … ছায়ার মতো যে নির্লোভ ব্যক্তি অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেছেন এবং নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ দিয়ে বহু বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন এক গোপন চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে শেখ সাহেব সেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। 

চক্রান্তকারীদের প্ররোচনায় মুজিব কাকু আব্বুকে এমনই অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে আব্বু মন্ত্রী থাকাকালে সরকারি সচিবকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন আব্বুর কাছে কে আসে, কি কথাবার্তা হয় এসব খবর ওনাকে জানাতে। 

বহির্বিশ্বেও আব্বুর পদত্যাগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া হলো। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জমিরউদ্দিন আহমেদকে ডেকে পাঠালেন সে দেশের জাতির জনক টুংকু আব্দুর রহমান। তিনি জানালেন যে, তাজউদ্দীনের এই সরিয়ে দেয়াটাকে তাঁরা ভাল মনে করছেন না।

মুক্তিযুদ্ধের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান অর্থমন্ত্রী যাঁকে সবাই চেনে, যিনি বাংলাদেশের জন্য সব দিকে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁকে কেন হঠাৎ সরিয়ে দেয়া হলো? জমিরউদ্দিন আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে চিঠির মাধ্যমে এবং ঢাকায় এসে মুজিব কাকুকে সরাসরি মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিক্রিয়া জানালেন। মুজিব কাকু উত্তর দিলেন, আমি কাকে মন্ত্রী রাখি না রাখি তাতে ওদের কি রে?’ রাষ্ট্রদূত জবাব দিলেন, ‘এটা অন্য কেউ নয়, তাজউদ্দীন। আমাদের মতো গরিব দেশে তাজউদ্দীন যে কয়দিন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, শুধু ভিক্ষা করেই বেড়িয়েছেন। কিন্তু ভিক্ষুকেরও যে ডিগনিটি, আত্মমর্যাদা থাকতে পারে তা তাজউদ্দীনের ছিল। তাই তিনি সবার মনে দাগ কেটেছেন। কাজেই তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাবেই।

’৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যার অন্যতম মদতদাতা মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটস হেনরি কিসিঞ্জারের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে আগমনের প্রাক্কালে, মার্কিন আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচক আব্বুর পদত্যাগ লক্ষণীয় বিষয়।

পদত্যাগের ক’ঘণ্টা আগে থেকেই সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা সচিবালয় ঘিরে রেখেছিল। পদত্যাগ করার পরও আব্বুর যেন মুক্তি মিললো না। আব্বুর ওপর কড়া নজর রাখা হলো। আব্বুর গতিবিধির ওপর রিপোর্ট করার জন্য সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নিযুক্ত করা হলো। প্রথমে সরকারি বাসভবন, সেটা ছাড়ার পর আমাদের নিজস্ব বাসভবনের ওপর নজর রাখা শুরু হলো। আব্বু দুঃখ করে বলতেন যে, পাকিস্তান আমলেও যেমন পেছনে গোয়েন্দা লেগে থাকতো, স্বাধীন বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা। বাস্তবে পাকিস্তান থেকে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসন পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক মন ও মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সে কারণেই ন্যায়নীতি ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার ধারক আব্বুর মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় অবশ্যম্ভাবী ছিল। ওই বাস্তবতা সত্ত্বেও সেদিন বহু মানুষই কল্পনা করতে পারেননি যে, আব্বু ও মুজিব কাকুর পথ স্বাধীন দেশের মাটিতেই চিরতরে আলাদা হয়ে যাবে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend