মেয়েরা কেন অত্যাচারী স্বামীদের ডিভোর্স করছে না: তসলিমা নাসরিন
ব্যভিচার যদিও নারী পুরুষ উভয়ে করার যোগ্যতা রাখে, করে কিন্তু পুরুষেরা। করার সুযোগ সুবিধে পুরুষেরা নিজেদের জন্য যত রেখেছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই নারীর জন্য রাখেনি। পুরুষের ব্যভিচারের শিকার নারী, আর শিকারের হয় ‘ব্যভিচারী’ বলে দুর্নাম। ব্যভিচার বা বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্বামীই ঘটায়, স্ত্রী মাথা পেতে সবই বরণ করে নেয়। ভোঁতা মাথা বলেই নেয়।
তিন বছর একসঙ্গে এক বাড়িতে বাস না করলে ডিভোর্স হতে পারে, কিন্তু স্ত্রীরা কি সে কারণে কোনও স্বামীকে ডিভোর্স করে? নিখোঁজ স্বামীকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়, তারপর নর্দমা থেকে তুলে মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়ে ধান-দুব্বো দিয়ে বরণ করে অপদার্থটিকে।
মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেয় স্বামীরা, তারপরও তাদের দেবতা মানার স্বভাব দূর হয় না নারীকূলের। শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্রমাগত অত্যাচারিত হচ্ছে নারী। পাষণ্ডদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘোচাতে তারপরও রাজি নয় ভীরু ভীতু নারীর দল।
যৌন অক্ষমতা পুরুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। যৌন অক্ষম স্বামীর সঙ্গে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ মেয়ে। মুখ বুজে। যৌনতা এবং তার আনন্দ পুরুষের জন্য। নারীর কাজ সন্তান উৎপাদন, এবং সন্তান লালন। এরকমই শেখানো হয়েছে নারীকে। নারী যে সত্য জানবে শিখবে বুঝবে, নারীর ভোঁতা মাথা যে ধারালো হবে তার কোনও উপায় রাখেনি এই কঠিন কঠোর পুরুষতন্ত্র।
যৌনরোগে আক্রান্ত স্বামী নিয়ে, দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে অথর্ব অক্ষম পঙ্গু পুরুষ নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে নারী। স্বামীর সেবার জন্য নারীর এই ঝি বা চাকরানির ভূমিকাকে ভালোবেসে আত্দত্যাগ বলে তারিফ করে আসছে পুরুষতন্ত্র। আর তাতেই খুশিতে বাকুম বাকুম আমাদের নারী। ঘরে ঘরে প্রেমহীনতা, অসন্তোষ, ঘৃণা, ঘরে ঘরে ব্যভিচার, স্বৈরাচার। ঘরে ঘরে নারীর ওপর নির্লজ্জ নিপীড়ন। তারপরও নারীর সাহস নেই মেরুদণ্ড শক্ত করে মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার। সাহস নেই নিজের জন্য একটি বাসস্থান তৈরি করার। ডিভোর্স করলে কী কী হবে তার একটি ফিরিস্তি দেওয়া হয়, যেমন ডিভোর্সী মেয়েদের দিকে পুরুষেরা হাত বাড়াবে। ভাববে এ খুব সহজলভ্য। কিন্তু এ কি কারও অজানা যে পুরুষের হাত বাড়ানোর জন্য ডিভোর্স হওয়া মেয়ের দরকার হয় না। কুমারী অকুমারী ডিভোর্সী অডিভোর্সী বুড়ি ছুড়ি যে কারও দিকেই ওরা ওদের হাত বাড়াতে পারে। আড়াই বছরের শিশুকেও ওরা ছেড়ে দেয় না। বলা হয় যে ‘ডিভোর্স করলে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হবে।’ আহ, না হয় হোক। হোক খারাপ তারপরও নিজের মতো করে বেঁচে থাকা তো যাবে। আজ যদি হাজার হাজার মেয়ে তা-ই চায়, নিজের ইচ্ছের মূল্য দেয়, বেঁচে থাকে নিজের একশ ভাগ স্বাধীনতা এবং একশ ভাগ অধিকার নিয়ে, একা, তবে কত ঐতিহ্য, কত সংস্কার, কত পরিবারপ্রথা আছে যে গালাগালি পেড়ে সামনে এসে দাঁড়াবে, বাধা দেবে! নিরাপত্তার কথা বলা হয়। স্বামী কি সত্যিই কোনও নিরাপত্তা? ঘরে ঘরে স্বামী দ্বারা স্ত্রী খুন, স্ত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, স্ত্রীকে গলা টিপে মেরে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেওয়া, রাতে রাতে ধর্ষণ করা- এর নাম কি নিরাপত্তা? পরিসংখ্যান বলে, মেয়েরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় স্বামীর ঘরে।
ভারতবর্ষে মেয়েদের অবস্থা যে ভীষণ করুণ, মেয়েরা যে বন্দি হয়ে আছে সংসার-কারাগারে, মেয়েদের যে নূ্যনতম অধিকার নেই নিজের অধিকারটুকু ভোগ করার- তা ভারতের ডিভোর্সের হার দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। বিবর্তন বলে একটি জিনিস আছে, পৃথিবীতে ঘটে। পৃথিবীতে এই দেশটি একমাত্র দেশ যে দেশের নারীর অবস্থায় বিবর্তন বলে কোনও জিনিস নেই। প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, অত্যাচারে অতিষ্ঠ ঠাকুরমার ঠাকুরমার ঠাকুরমার ঠাকুরমারা যে কারণে ডিভোর্স করতো না স্বামীদের, এখন এই ২০১৪ সালে আজকের তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন স্বনির্ভর মেয়েরা একই কারণে ডিভোর্স করছে না।