তিস্তাসহ উত্তরবঙ্গের নদীজল বন্টন প্রতিবেশীদের উপর আস্থা রেখে প্রয়োজন সার্থক পরিকল্পনার
খবর বাংলা ২৪ ডেক্স: সময় একটি প্রভাবশালী মাত্রিকতা। এর প্রভাবে ১৯৪৭ থেকে পরের ছয় দশকে ভারত, নেপাল ও চিন নানান মাত্রায় ও বৈপরীত্যে নৈকট্য-দূরত্বের গতি সৃষ্টি করেছে। দূরত্ব হয়ত বেড়েছে কিন্তু যখন আন্তঃরাষ্ট্রীয় উন্নয়নের রঙ্গমঞ্চে আসর বসে, তখন মৈত্রী ও মানসিক মেলবন্ধন খুব জরুরি হয়ে ওঠে। পারস্পরিক পরিসরে প্রবাহমান নদীগুলির জল সম্পদেও সম্যক বিকাশের জন্য সদিচ্ছা খুবই জরুরি হয়। প্রথমে ভারত ও নেপালের প্রসঙ্গগুলি দেখা যেতে পারে।
ভারতের উত্তরের হিমালয় পর্বতমালা যদি চন্দ্রহার হয়, তবে নেপাল সেই চন্দ্রহারের মধ্যমণি। হিমালয়ের উঁচু পার্বত্য ঢালের হিমবাহ থেকে যেমন বহু নদীর সৃষ্টি হয়েছে। তেমনই উচ্চ হিমালয়ের সর্বোচ্চ জলবিভাজিকার উত্তরে তিব্বতীয় হিমলায়ে উদ্ভূত হয়েছে বহু নদী যেমন অরুণ, সপ্তকোশী, কর্ণালী। মাউন্ড এভারেস্টের পাদমূল থেকে সৃষ্টি হয়েছে বরুণের। এই রাষ্ট্রের পশ্চিম সীমা নির্ধারিত হয়েছে। একটি নদীর দ্বারা তার নাম কালি। সপ্তকোশী, সানকোশী, বাগমতী, তামুর সবাই দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গায় মিশেছে। গঙ্গা অববাহিকার বামতীরের জলসম্ভারে পূর্ণ নদীগুলি এসেছে নেপাল রাষ্ট্রের পার্বত্য অঞ্চল থেকে। এই কারণে নেপাল, ভারত বাংলাদেশ বাঁধা পড়েছে এক রঙ্গমঞ্চে যেখানে গঙ্গার জলের বন্টনের যারা সক্রিয় রঙ্গকর্মীর ভূমিকা নেবে। পারস্পরিক সহযোগিতার নিগড়ে। ভারত আর নেপাল জলবন্টনের ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় জলসম্ভারের উন্নয়ন বহুদিন ধরে একসঙ্গে পথ চলেছে। সপ্তকোশী, কোশী, কালিগঙ্গার ক্ষেত্রে এই ধরনের সহায়তা উভয় দেশকে উন্নত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশ আশির দশক থেকে। কারণ স্বাভাবিকভাবে গঙ্গার ব দ্বীপ্রবাহের দেশ- বাংলাদেশ আর বামতীরের জলসম্ভারের যোগান দেয় নেপালের নদীগুলি। পরে মহানন্দা, তিস্তার পালা। গঙ্গার ডানতীরের জলের যোগানদার দাক্ষিণাত্য মালভূমির শুধুমাত্র বৃষ্টির জলে পুষ্ট চম্বল, কেন, বেতোয়া, ধসন, শোন, কোয়েল কারো প্রভৃতি। এরা নেপাল থেকে উৎপন্ন নদীগুলির ন্যায় বৃষ্টি ও বরফগলা জলে গঙ্গাকে পুষ্ট করে না। তাই মধ্য ও নিম্ন গঙ্গার জলসম্পদের সৃষ্টিতে নেপাল অনন্য ভূমিকা পালন করে।
নেপাল ভৌগোলিক বিস্তৃতি বৈশিষ্ট্যময় এবং জলসম্ভার ব্যবস্থাও অনন্য প্রকৃতির । পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত প্রায় আয়তকার এই রাষ্ট্র পার্বত্যময়, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্খ মাউন্ট এভারেস্ট (৮৮৫০মি.) ও অন্যান্য উচ্চতম শৃঙ্গগুলি যেমন, মাকালু, অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘা এই দেশের উত্তরের সীমাকে গঠন করছে। দক্ষিণের মধ্যহিমালয় শৈলশিলা নেপালে মহাভারত লেখ নামে পরিচিত। উচ্চতা ও বন্ধুরতায় অনেকটাই দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের মতো। এর দক্ষিণে শিবালিকের ছোটো ছোটো পাহাড় আর বিস্তৃত নদী সমভূমি। তরাই ভূমি নেপালের দক্ষিণতম সীমায় খুবই অপ্রশস্ত একটি অঞ্চল। মহাভারত লেখ পাহাড়ে উত্তরে উচ্চ হিমালয়ের উদ্ভূত নদীর সংখ্যাই বেশি, যারা বৃষ্টিপাত ও বরফগলা জলে সারাবছর পুষ্টি থাকে। কালি, নারায়ণী বা সপ্তগন্ডকী, ইন্দ্রাবতী, সান কোশী, ভোট কোশী, অরুণ বরুণ প্রভৃতি। মহাভারত লেখের দক্ষিণের ঢাল থেকেও বহু নদীর উদ্ভব হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুজনাই, দলদলি; বাংলাদেশের আত্রেয়ী, ঘাগাট এর মতো এরাও প্রচুর জলের প্রবাহ নিয়ে গঙ্গায় মিশেছে। আর আছে নেপালের দক্ষিণ তরাই অঞ্চলের ভৌমজলে পুষ্ট বহু ছোটো ছোটো নদী ও ঝোরা যেমন রাপ্তি, সিমরা, পাল বক্যা, মাধো, রালা- এরা নেপালের পলিব্যজনীর জলের উৎস।
দার্জিলিং, সিকিম, ভুটানের মতোই নেপালের জলসম্পদ ব্যবহারের সম্ভাবনা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশি। কৃষিতে ব্যবহার অনেকটাই সীমিত, কিন্তু দার্জিলিং বা ভুটানের তুলনায় নেপাল সমতল কৃষিজমির আয়তন বেশি। আর মাঝারি উচ্চতার কৃষি ধাপগলিতে বিন্ধু সেচ বা ফোয়ারা সেচ করলে জল ব্যবহারের। মাত্রা অনেকটাই বেড়ে যাবে। তখন কোশী বা অন্যান্য সেচবাধর জলের চাহিদা বাড়বে নেপালের চাষের জমিতে নেপালের সমভূমিতে এখনও ধান চাষের জন্য বৃষ্টিপাতই ভরসা; আর গ্রীষ্ম মৌসুমির অনিশ্চয়তাও কম নয়। মোট বৃষ্টিপাতের ৩০-৪০ শতাংশ একেবারেই অনিশ্চিত। আর এসব নদী ভারতের সেচ বা বিদ্যুৎ অবশ্যই দেয়, কিন্তু তার সঙ্গে সৃষ্টি করে সর্বনাশী বন্যা। কোশী এ বিষয়ে আমাদের নিদ্রাহরণকারী। সর্বনাশী কোশী বিগত ১০০ বছরে তার খাতকে পরিবর্তন করেছে। প্রায় ২০০ কিমি জুড়ে; পূর্ব থেকে পশ্চিমে। তিস্তা চলেছে এর বিপরীতে পশ্চিমে থেকে পূর্বে ভারতের এই বিধ্বংশী বন্যার হাত থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় প্লাবন খালের মাধ্যমে বন্যার জল গঙ্গার খাতে ফেলা। গঙ্গার সেই অতিরিক্ত প্রবাহ ভারতে ও বাংলাদেশে সেচ, জলবিদ্যুৎ বা অন্য প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়ে প্রতিটি পরিসরকে সুজলা, সুফলা করবে। আর এসবের জন্য প্রয়োজন এক সার্বিক বিধিবদ্ধ পরিকল্পনার। সেই পরিকল্পনার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় বোঝাপড়ার দরকার হবে। এমনই আর একটি ক্ষেত্র অবহেলায় পড়ে রয়েছে রাজনৈতিক শীতলতার গর্ভে। এই পরিসর ভারত ও চিনের আন্তঃরাষ্ট্রীয় জলভান্ডারের মধ্যে আর এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারত। ভারত ও চিনের মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় জলচুক্তি নেই অথচ সাংপো ব্রক্ষ্মপুত্র বা সিন্ধুর অববাহিকার জলবিভাজন ভারত-চিন-পাকিস্তান-নেপাল আর বাংলাদেশের সহাবস্থান খুবই প্রয়োজন। সাংপো বা ব্রক্ষ্মপুত্র সম্পর্কে আমাদের তথ্য অসম্পূর্ণ থাকবে যদি ভারত ও চিন জলচুক্তি সম্পাদন করে পারস্পরিক তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা না করে। সাংপো তিব্বতের নদী, পরিক্রমার পরে জলসম্ভারে পূর্ণ হয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতে নামচা বারওয়া অতিক্রম করে লুহিত যোগ দিয়েছে ব্রক্ষ্মপুত্রের সঙ্গে। লুহিত এর উৎস চিনের কাংরি কারপো গিরিপথের উত্তরে। সেই অর্থে উচ্চ ও মধ্য লুহিত চিনের, ওয়াংলু এর নীচের অংশ ভারতের। এভাবেই এক নদী দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে নিবিড় আন্তঃসম্পর্কে সৃষ্টি করে, ভারতে ব্রহ্মপুত্র এক বিপুল জলসম্ভারের রূপ নিয়েছে। উত্তরে হিমালয় আর দক্ষিণে মেঘালয় মালভূমি ও উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে এর বিস্তৃত সমভূমির অস্তিত্ব উন্নত কৃষিসম্ভাবনাকে সৃষ্টি করেছে। অরুণাচল হিমালয় অঞ্চলে ৪০০ সেমি এ অধিক বৃষ্টিপাতের প্রবাহ নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ডানপাড়ে যোগ দিয়েছে সুবর্ণসিরি, ডিবং ডিহাং প্রভৃতি অতি ¯্রােতস্বিনী সব নদী। ডানদিকে লুহিতের পরে মিশেছে বহু ছোটো ছোটো নদী, মেঘালয় মালভূমির অতিবৃষ্টির অঞ্চল থেকে নেমেছে এই নদীগুলি। অসম সমভূমিতে ব্রহ্মপুত্র বিশাল ব্যজনী খাত নির্মাণ করে ধুবরীর দক্ষিণে বাঁক নিয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের অংশ এর ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম সব উপনদী তিস্তা, তোর্ষা ও সংকোশ। ভারতীয় অংশের ব্রহ্মপুত্র আর বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে পার্থক্য অনেক বিষয়ে। অসমে ব্রহ্মপুত্র এক মহিমাযুক্ত প্রবল প্রবাহের নদী। বাংলাদেশে এর উপনদীর অভাবে এবং অধিক পরাক্রান্ত পদ্মার তুলনায় অনেকটাই নিষ্প্রভ। ব্রহ্মপুত্রের জলসম্ভারের পরিমাণ জুন থেকে নভেম্বরে সর্বাধিক, সবটাই প্রায় অনিয়ন্ত্রিত। এসময়ের প্রবল বন্যার আতঙ্ক সমভূমির সর্বত্রই অনুভব করা যায়। এই বন্যার বিপর্যয় রোধে ব্রহ্মপুত্রের জলসম্ভারের প্লাবনকালীন নিয়ন্ত্রণ খুবই প্রয়োজন। বন্যাকালীন প্রবাহের সম্যক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন একটি প্লাবন পরিবহন খাল ব্যবস্থার; ৫০ মিটার উচ্চতার এর Intake থেকে ১০ মিটার উচ্চতাযুক্ত অঞ্চলের মধ্যে ধুবড়ি থেকে পশ্চিমবঙ্গের কাঁথি পর্যন্ত হবে এর বিস্তৃতি। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে ব্রহ্মপুত্রের বর্তমান ও পুরাতন খাতগুলিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অতিরিক্ত প্লাবনকে প্রশমিত করা সম্ভবপর। আর প্লাবনের জলে জলসেচ হবে। অতিরিক্ত সঞ্চয়ের আধার যোগাবে শুখা মরশুমের জলের যোগান। ব্রহ্মপুত্রকে শাসন করা খুবই উন্নত প্রযুক্তি ও প্রচুর বিনিয়োগের দ্বারাই সম্ভবপর। ভারত ও বাংলাদেশ সব অর্থেই এই প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের শরিক হতে সক্ষম। ব্রহ্মপুত্রের কারণে ভারত-বাংলাদশের জলবন্টন চুক্তি যেমন বাঞ্ছনীয়, তেমনই ভারত-চিন জলচুক্তিও একই কারণে গুরুত্বপূর্ণ। চিনে সাংপোর নদীর উচ্চপ্রবাহকে ব্যবহার করার পরে- যে কারণে চিন-ভারত জলচুক্তি অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা হল সিন্ধু ও সাইয়ক এর প্রসঙ্গ নিয়ে। সাংপোর বিপরীত দিকে প্রবাহের সিন্ধুর কারণে আমরা সিন্ধু জলচুক্তি করেছি। কিন্তু সিন্ধু, সাইয়ক, নেপালের অরুণ, অসমের লুহিতের কিছু অংশে চিনের উপরে প্রবাহিত হয়েছে। আরও বহু নদী আছে, অপেক্ষাকৃত ছোটো আয়তনে ও প্রবাহে কিন্তু তাদের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- সিকিম, চিন, ভুটানের মধ্যে প্রবাহিত ছোটো ছোটো নদী উপত্যকা, অরুণাচলের তাওয়াং উপত্যকা, লুহিতে প্রবাহিত মায়ানমারের নদী বা উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রবাহিত উপত্যকা, লুহিতে প্রবাহিত মায়ানমারের নদী বা উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রবাহিত নদী- যা কিনা চিন ও মায়ানমারের সামান্য অংশে অনুপ্রবেশ করে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেছে- এদের প্রসঙ্গগুলি জলচুক্তির দ্বারা সমাধান হতে পারে।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় নদী ব্যবস্থার সম্পদ বিভাজনের প্রসঙ্গ সহজেই হতে পারে। প্রাচ্যের স্থিরতা, মিত্রতা ও সমানুভূতিকে ভিত্তি করে আসতে পারে। আমাদের নিজস্ব প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার যেমন অভাব নেই, তেমনই আমাদের প্রতিবেশীরাও সেই প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অধিকারী। তাই সমস্যা নেই, প্রয়োজন শুধু সার্থক পরিকল্পনার। চলবে…