ভালোবেসে ধর্মান্তরিত, স্বামীকে হারিয়ে একা পঙ্গু বৃষ্টি
খবর বাংলা ২৪ ডেক্স: আমরা তো কারো কাছে ভিক্ষে চাই না। চাই শুধু একটা কাজ। কাজ করার মতো শক্তিও নেই। ভারী কোনো কাজ করতে পারি না। এ কারণে কেউ বাসা বাড়ির কোনো কাজেও নেয় না। এমনও দিন যায় দুই তিন দিন কোনো চাল চড়ে না চুলায়। ফলে মাঝে মাঝে সন্তানদের নিয়ে না খেয়েই থাকতে হয়। আর কতদিন না খেয়ে থাকবো বলেন?
রানা প্লাজা ধসের পর সেখান থেকে বেঁচে যাওয়া আহত নারী শ্রমিক আফরোজা বেগম তার বর্তমান দুঃখময় জীবনের নিত্যদিনের কথাগুলো এভাবেই তুলে ধরলেন।
আফরোজার স্বপ্ন ছিল গার্মেন্টসে কাজ করে জায়গা জমি কিনবেন। কবর দেয়ার মতো জায়গাটুকু তার হবে। স্বামী বেকার ও অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলার দামুদুরপুর গ্রাম থেকে তিন সন্তানদের নিয়ে ছুটে আসেন সাভারের দগুরমুড়ায় কাজ করার জন্য। কাজও পান। কিন্তু রানা প্লাজা ধসের পর তার সব স্বপ্ন এখন এলোমেলো।
তিনি জানান, রানা প্লাজা ধসের ঘটনার দিন প্রচণ্ড আঘাত পান মাথায়, হাতে ও মেরুদণ্ডে। মেরুদণ্ড ফেটে যাওয়ায় তিনি এখন হেলতেও পারেন না। করতে পারেন না কোনো ভারি কাজ। এ কারণে কেউই তাকে কোনো কাজে নেয় না। গত এক বছরে তার চিকিৎসা বাবদ ও সংসার চালানোর জন্য বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা ধারদেনা করেছেন। যা পরিশোধ করার মতো তার কোনো সামর্থ্য নেই। তারপরও ধারদেনা করছেন যদি কোনো চাকরি জুটাতে পারেন এ সাহসে। কিন্তু চাকরি তো তার মিলে না। উদ্ধারের পর পোশাক শ্রমিক সংগঠনের অনেক নেতাই পাশে ছিল এখন তারা আর কেউই খোঁজ খবর রাখেন না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, তাকে উদ্ধারের পর হাসপাতালে তিনি মাত্র ১০ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে বিকাশে ৪৫ হাজার টাকা পান। তারপর আর কোনো টাকাই পাননি তিনি। যারা বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিল তারাই মূলত টাকা পেয়েছে। কিন্তু তার ভাগ্যে মিলেছে শুধু কষ্ট আর দুঃখ।
আফরোজা বলেন, ‘গত তিন মাস যাবৎ কোনো ঘর ভাড়া দিতে পারিনি। এরই মাঝে একদিন একটি মিডিয়ার বদৌলতে দুই হাজার টাকা পেয়ে সেই টাকার অর্ধেক ঘর ভাড়া দেই। বাকি টাকায় চাল কিনেছি। যে খাবার কিনেছি তাও দুই একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তখন বাচ্চাদের কী খাওয়াবো জানি না।’
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আমার কার্ড নং ৮৪৫৮।
প্রধানমন্ত্রী অনেকজনকে অনেক টাকা দিল, কই সেই টাকাতো আমার ভাগ্যে জুটলো না। আমি কী তাদের দলের নই?’
তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে পড়ে চতুর্থ শ্রেণীতে, দ্বিতীয়টি দ্বিতীয় শ্রেণীতে এবং সবার ছোটটা পড়ালেখা করতে চায় কিন্তু টাকার কারণে তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে সাহস পান না আফরোজা।
ডাক্তার তাকে এক বছর ভারি কোনো কাজ না করতে এবং বিশ্রামে থাকতে বললেও তিনি মাঝে মাঝে ছুটে যান বিভিন্ন গার্মেন্টে কাজের খোঁজে। কিন্তু কেউই তাকে কাজ দিতে চায় না।
বড় কষ্টে আফরোজা বলেন, ‘সেইসব মানুষগুলোর কাছে সাহায্য চাইলে তারা বলে কাজ করে খেতে পারো না?’ তখন উত্তরে আফরোজা বলেন, ‘কাজ দেন কাজ করবো। তবু ভিক্ষা করে খেতে চাই না।’
রানা প্লাজায় বেঁচে যাওয়া আরেক অভাগী আহত শ্রমিক বৃষ্টি। তিনি ও তার স্বামী সাইদুর রহমান মিলে দুইজন থাকতেন সাভারের মজিদপুরে। আর কাজ করতেন রানা প্লাজার তৃতীয় তলার নিউ এ বটমস গার্মেন্টসে। তিনি কাজ করতেন একজন অপারেটর হিসেবে। কার্ড নং ১২৪০।
দুটি রঙিন চোখে সুন্দর করে সংসার সাজানোসহ নানান স্বপ্ন ছিল তারও। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো এখন তার চোখে শুধুই ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। ঘটনার দিন তার কাছেই কাজ করা স্বামীকে মরতে দেখেছেন তিনি। ফলে আজও ভুলতে পারেন না সেইদিনের দুর্বিসহ স্মৃতিগুলো।
আটকা পড়া বৃষ্টিকে ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে উদ্ধার করা হয়। এসময় তিনি তার হাতে ও দুই পায়ে ব্যাপক আঘাত পান। পায়ের আঘাতের ব্যাথা এখনো তাকে ভুগায়। প্রচণ্ড ব্যাথায় চলতে ফিরতে এমনি ভালো করে দাঁড়াতেও পারেন না। সব হারানো এতিম বৃষ্টির কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় থাকেন সাভারের রেডিও কলোনিতে একটি ভাড়া বাসায়। সেই বাসায় শুধু একা। কোনো কাজও পাননি। আর কাজ করবেন কী করে তার তো দুই পা মাঝে মাঝে অবশ হয়ে আসে। তখন আর হাঁটতেও পারেন না।
বৃষ্টি বলেন, ‘ঘটনার পর স্বামীর ক্ষতিপূরণ বাবদ লাখ দুয়েক টাকাও পেয়েছিলাম। কিন্তু দজ্জাল শ্বশুর সেই টাকা ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ছোটবেলায় মাকে হারাই। হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হওয়ার দোষে বাবার সাথে এখন আর কোনো ধরনের যোগাযোগও নেই।’
সব হারানো বৃষ্টির পাশে এখন কেউই নেই। ফলে তিনি এখন মানসিক প্রতিবন্ধীর মতো জীবনযাপন করেন। কোনো কথাও ভালো করে গুছিয়ে বলতে পারেন না। কী করবেন সামনের দিনগুলোতে? কার কাছে থাকবেন জীবনের বাকি সময়টুকু এই ভাবনায় তাড়া করে প্রতিনিয়ত বৃষ্টিকে।
আহত আফরোজার কাজের শক্তি ও সামর্থ্য নেই। আরেকদিকে বৃষ্টি সব হারিয়ে এখন একা। কিন্তু তার চেয়েও বড় এতিম হয়েছে শুভ ও পারভেজ নামের দুই অবুঝ দুই শিশু। তারা তাদের মাকে হারিয়ে এখন দাদী ও নানীর কাছে থাকচ্ছে।