জিন্দা পার্ক: জন্ম-মৃত্যুর লড়াই
(সাপ্তাহিক ‘সাপ্তাহিক’) – লিখেছেন- আদিত্য শাহীন।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর মৃত্যু, অপমৃত্যু ও হত্যা নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হচ্ছে প্রকৃতির বড় বড় শক্তি ও নিয়ামককে। যার ওপর ভর করে প্রাণবৈচিত্র্য টিকে থাকে, তার সবকিছুই ধ্বংস করা হচ্ছে নগরায়ণ, বাণিজ্য আর ব্যক্তিস্বার্থ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে। একসময় চারদিকে নদীর বেষ্টনী থাকার কারণে যে ঢাকাকে অন্যতম প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যময় একটি শহর হিসেবে গণ্য করা হতো, সেই ঢাকার চেয়ে বড় দুঃখের গল্প যেন আর কারও নেই। ঢাকা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড ধরে এগোতে থাকলেই এই গ্রীষ্মে সবুজ ফসলী ক্ষেত, গ্রামীণ জনজীবন, বড় বড় তাল, নারকেল গাছের সারি দেখা যেত কিছুকাল আগেও। এখন সেখানে রুক্ষ অবয়বে উত্তাপ ছড়াচ্ছে সাহারা মরুভূমি। চারদিকে অমুক সিটি, তমুক সিটির প্রতিযোগিতামূলক নির্মাণযজ্ঞ। ভূগর্ভস্থ বালি তুলে ভরাট করা হচ্ছে নিচু জমি। নির্মাণাধীন সুপ্রশস্ত রাস্তায় উড়ছে বালি আর কংক্রিট মেশানো ধুলো। কিছু দূর পর পর নির্মাণের যন্ত্রপাতি, বুলডোজার, মিক্সচার মেশিন, বালির স্তুূপ। এদিক-সেদিক কংক্রিটের কালভার্ট। রাস্তায়, প্রাচীরে, দূরে মাঠের ভেতর, গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত বাড়ির টিনের বেড়ায় শোভা পাচ্ছে সিটি আর আবাসন প্রকল্পের নাম।
পৃথিবীতে জমির সবচেয়ে বেশি দাম যে শহরে, যেখানে এক টুকরো জমিও বৈধ মালিকানা ছাড়া ভাবা যায় না, সেখানে জমি ও প্রকল্প শনাক্তকরণের অস্থির তৎপরতা দেখলে বোঝা যায় কেমন হরিলুট চলছে। অঙ্কের সমাধানও মেলে তখনই। আসলে হরিলুট চলছে প্রকৃতির। মানুষের বসবাসের নিশ্চয়তা বিধান করতে গিয়ে মানুষেরই নিঃশ্বাসের উৎস ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতীরের ইছাপুরা, কাঞ্চন, বেরাইদ, পূর্বগ্রাম, টানমশুরি গ্রামগুলো এখন ঢাকার সঙ্গে যুক্ত ইট-কংক্রিটের শহর সাজতে ব্যস্ত। চারদিকে খাঁ খাঁ করে। অট্টালিকার জঙ্গল সৃষ্টি করা হচ্ছে এখানে, যেখানে বাস করবে মানুষ নামের প্রাণী, অথচ চোখ মেলে দূরে তাকালে এখনই অন্তর কেঁদে ওঠে। গ্রামগুলো পেরুলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। একসময়ের অসংখ্য টিলা আর শালবনের সৌন্দর্যে, ফল ফসলের প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল যে রূপগঞ্জ, তা-ও যেন এখন মানুষসৃষ্ট বিপর্যয়ে বিপন্ন এক জনপদ। এখানেই রবীন্দ্রনাথের পল্লী প্রকৃতির স্বপ্নের মতো এক অদ্ভুত মনোরম এক ক্ষেত্র ‘জিন্দা পার্ক’।
যেটি কার্যত পার্ক নয়, বলা যেতে পারে শান্তিনিকেতনের অদূরে রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতনের আদলে গড়ে তোলা একটি প্রতিশ্রুতিশীল ও সমন্বিত পল্লী। এই উদ্যোগ ও মনোরম ক্ষেত্রটি শুধু দেশবাসী নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ার দাবি রাখে। ঢাকা থেকে টানা ধ্বংসের দৃশ্যপটে হতাশ, বিক্ষত আর তৃষ্ণার্ত মন সত্যিই শীতল হয়ে যায় এমন প্রাণবান্ধব ক্ষেত্রে এসে। কার্যক্রম, আয়োজন ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দেখে জাগে অন্যরকম আশা।
তিল তিল করে এমন একটি পল্লী প্রকৃতির আয়োজন চলছে চৌত্রিশ বছর ধরে, অথচ এই বিশাল কর্মযজ্ঞ কোথাও তেমন আলোচিত নয়। এমনকি পর্যটন কেন্দ্র মূল্যায়নেও তেমন লেখালেখি হয়নি কোথাও। যে কারণে শিক্ষা, শিল্পকলা, স্থাপত্য, গ্রামীণ উন্নয়ন চিন্তা, সামাজিক শৃঙ্খলার ভাবনা, ধর্মচিন্তা, কৃষি, প্রকৃতি, বিনোদন ও গ্রামীণ জীবনকে একটি উন্নত বেষ্টনীতে বাঁধার সমন্বিত এই আয়োজনটি কাছাকাছি হলেও রাজধানীর বেশিরভাগ মানুষেরই অনেকটা অজানা। ‘জিন্দা পার্ক’ কথাটির মধ্যে কোনো তান্ত্রিক বা অলৌকিক কোনোকিছুর স্থান নেই। জিন্দা হচ্ছে রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের শান্ত নিরিবিলি ছায়াঘেরা একটি গ্রাম, যে গ্রামকে ঘিরে রয়েছে আরও আট-নয়টি গ্রাম, যার মধ্যে রয়েছে মনোহরপুর, পলখান, অলপকালনি, খাইসা, কালনি, ওলব, বইলদা ও চাপড়ি। কৃষি গ্রামগুলোর প্রধান জীবন-জীবিকা আর প্রকৃতিই গ্রামগুলোর সবচেয়ে বড় বৈভব। এই গ্রামেরই সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন আব্দুল কাদের আকন্দ। তারই চার সন্তানের তৃতীয়জন তবারক হোসেন কুসুমের চিন্তা ও পরিকল্পনার ফসল হচ্ছে এই পল্লী প্রকৃতি ‘জিন্দা পার্ক’।
এর সঙ্গে এখন যুক্ত এলাকার পাঁচ হাজার মানুষ। কিন্তু সূচনা কুসুমসহ তার অন্য চারবন্ধু অর্থাৎ পাঁচজনের হাত দিয়ে। সে এক ব্যতিক্রম কাহিনী। কুসুম যখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে। একদিন বাবার কাছে চেয়েছিলেন স্থাবর অস্থাবর জমিজমা। ছেলের এমন আবদার বাবা উড়িয়ে দেয়ায় বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় কুসুম। তারপর কয়েক বছর পর আবার বাড়ি ফিরে একই আবদার। বাবা এবার ছেলের এমন ব্যাকুলতা দেখে কিছুটা নমনীয় হন। জমিজমা সবই ছেলেকে ব্যবহার করতে দেন এই শর্তে- কোন গাছ কাটা যাবে না। কুসুম সেই শর্ত মেনে পৈতৃক ৬০ বিঘা জমি ব্যবহারের অনুমতি পেয়েই তার নিকটতম কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে জায়গাটিকে অন্যরকম করে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অন্যান্য বন্ধুদের কিছু জমিও। দিনে দিনে সেখানে যুক্ত হতে থাকে নানান কিছু।
অগ্রপথিক পল্লী সমিতি হিসেবে শুরু হয় নতুন এক অভিযান। যে অভিযানের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় ১০ গ্রামের মানুষের জন্য এক উন্নয়ন ক্ষেত্র, যেখানে গ্রামের প্রতিটি মানুষ জীবনের প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। যার মাধ্যমে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও চেতনায় এগিয়ে যাবে গোটা গ্রাম। নতুন প্রজন্ম হয়ে উঠবে স্বপ্নবান, শিক্ষিত ও আত্মবিশ্বাসী। এই লক্ষণ থেকেই সাজানো শুরু হয় বিরাট ক্ষেত্রটি। কাটা হয় ২৫ থেকে ৩০ বিঘার লেক। যেখানে মাছ চাষের পাশাপাশি করা হয় নৌভ্রমণের ব্যবস্থা। চারদিকে রোপিত হতে থাকে ঔষধি, বনজ ও ফলের গাছ। আড়াই ’শ প্রজাতির ৫০ হাজারেরও বেশি গাছের সমন্বয়ে সেটি পরিণত হয় অনন্য এক বাগানে। পরে তবারক হোসেন কুসুমের ব্যক্তিগত বিনিয়োগে গড়ে তোলা হয় একটি আন্তর্জাতিক মানের স্কুল ‘লিটল এঞ্জেলস্ সেমিনারি’, যেখানে প্লে গ্রুপ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান চালু করা হয় । গড়ে তোলা হয় একটি মসজিদ, লাইব্রেরি, কমিউনিটি ক্লিনিক, ঈদগাহ, গোরস্তান, শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ, খেলার মাঠ। ভেতরে একটি ছোট দুগ্ধ খামার ও নার্সারিও রয়েছে। সবমিলিয়ে শতাধিক বিঘা জমির ওপর পরিবেশবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন একেকটি স্থাপনা। যা উন্নয়ন তদারকি ও তত্ত্বাবধানের জন্য চালু রয়েছে ব্যতিক্রমী এক নিয়ম শৃঙ্খলার ব্যবস্থা। যে নিয়ম বাধ্যতামূলক রয়েছে এখানকার ৪০ জন নিয়মিত স্থায়ী কর্মী ও আরও ৪০-৫০ জন দিনমজুরের জন্য। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রত্যেককে সপ্তাহের একটি দিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশগ্রহণ, প্রত্যেক মুসলমান কর্মীর জন্য নিয়ম করে মসজিদের জামায়াতে উপস্থিত হয়ে নামাজ আদায় এবং প্রত্যেকের জন্য প্রতিদিন আধাঘণ্টা লাইব্রেরিতে কাটানো। এর কোনটির ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ নেই। যে কথা উল্লেখ না করলেই নয়, এখানকার কর্মীদের জন্য মসজিদে একটি হাতের ছাপ (ফিঙ্গার প্রিন্ট) দেয়ার অত্যাধুনিক মেশিন রয়েছে। প্রত্যেক কর্মীর হাতের ছাপ প্রমাণ করে তার মসজিদে উপস্থিতি। লাইব্রেরিতেও রয়েছে প্রতিদিনের রেজিস্টার খাতায় নাম-স্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা। এর বাইরেও সততা, নৈতিকতা ও শৃঙ্খলাবিষয়ক ব্যতিক্রমী নানা নিয়ম কানুন রয়েছে। এসব বিষয় তদারকিসহ সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য রয়েছে অন্যরকম কর্মকাঠামো। এই কাঠামোর আওতায় রয়েছে চারটি বিভাগ। কর্মবিভাগ, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। কর্মবিভাগের সদস্য ৫০ জন, শাসন বিভাগের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সদস্য নিযুক্ত করা হয়, আইন বিভাগে রয়েছে ১০ জন ও বিচার বিভাগে ৩ জন।
চারিদিকে সাজানো গোছানো ছিমছাম ছায়াঘেরা এক পল্লী প্রকৃতি। ভেতরে অতিথিদের বসার ও বিশ্রামের জন্য ছোট ছোট দুটি কটেজ রয়েছে, যেগুলো তৈরি করা হয়েছে একেবারে ব্যতিক্রম নকশা ও উপকরণে। স্কুলসহ বড় স্থাপনাগুলোতে প্রচলিত জানালা ও গ্লাসের বাহুল্য নেই। লোহার গ্রিল, এলুমিনিয়ামের পরিবর্তে বিভিন্ন গাছের কাঠের শৈল্পিক ব্যবহার। মসজিদসহ প্রত্যেকটি স্থাপনাই ভিন্ন ও জ্যামিতিক আকৃতির। দেশের অন্য কোথাও এমন পরিচ্ছন্ন ও অন্য ধরনের ভবন চোখে পড়ে না। পাঁচতলার বিশাল একটি লাইব্রেরি ভবনের কাজও শেষের পথে। যেটির কোনো কোনো অংশে ইতালির কলোসিয়াম, আবার কোনো অংশে হিরোশিমা নাগাসাকির ধ্বংসপ্রাপ্ত চেনা ভবনটির মতো গোলাকার। বাগানের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে একটি প্রশস্ত রাস্তা। তার দুপাশে ঝাউবন। ঝাউবন পেরুলেই লাইব্রেরি। একেকটি উদ্যোগ ও স্থাপনা দেখলে মনে হয় বড় কোনো স্থপতি গভীর শিল্পচিন্তা ও ব্যবহার সুবিধার কথা চিন্তা করে এমন নকশা অনুসরণ করেছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব নকশার সবই তবারক হোসেন কুসুমের মাথা থেকে এসেছে। স্থানীয় একজন প্রকৌশলী কিছু সহযোগিতা করেছেন মাত্র।
প্রকৃতি পর্যটন বা ইকো টুরিজমের এক অনবদ্য আয়োজনের কথা দেশের মানুষ না জানলেও সম্প্রতি এই ‘জিন্দা পার্ক’ দখল ও রক্ষা নিয়ে নানান কথা উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে। বস্তুতপক্ষে জিন্দা পার্ক পড়েছে হুমকির মুখে। অর্থাৎ এই বিশাল কর্মউদ্যোগও আবাসন আয়োজনের মহাযজ্ঞে বিপন্ন হতে চলেছে। একথা বলতেই হবে যে, সরকারের পূর্বাচল নামের গৃহায়ন মহাপরিকল্পনা যখন শুরু হয়েছে তখন গোটা অঞ্চলের জমি অধিগ্রহণের ভেতর এই জিন্দা পার্কও রেহাই পায়নি। ১৯৯৬ সালে এর পুরো জমি অধিগ্রহণ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অধিগ্রহণের বিধি অনুযায়ী প্রাকৃতিক সম্পদ, পার্ক, জনহিতকর স্থাপনাসহ যে ধরনের আয়োজন সেখানে রয়েছে সেগুলোকে কোনোরকম পরিবর্তন করার নিয়ম নেই, তাই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একবার সেখানকার স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চালানো হলেও পরে সরকার বিষয়গুলো উপলব্ধি করে ‘পার্ক’ হিসেবে ক্ষেত্রটিকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে রাজউক এটি উচ্ছেদের জন্য বহুমুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ৩ এপ্রিল রাজউক বিপুলসংখ্যক পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ জিন্দা পার্ক-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনাকারীদের উচ্ছেদ করার একটি অভিযান চালায়। সেদিন জিন্দাপার্ক-এর চারদিকে জেগে ওঠে অসংখ্য ব্যানার ফেস্টুন। পাঁচ হাজার মানুষ এক হয়ে কণ্ঠ ছাড়ে, ‘রাজউকের রক্তাক্ত থাবা থেকে জিন্দাপার্ক রক্ষা করুন’।
দেশের ২১টি সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন জড়ো হয় সেখানে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বিপুলসংখ্যক মানুষের পাশে দাঁড়ান। তিনি জিন্দা পার্কের সামনের বালুর মাঠে বিক্ষোভকারীদের নিয়ে অবস্থান গড়ে তোলেন। জিন্দা পার্ক রক্ষায় প্রয়োজনে আত্মাহুতি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় এলাকার যুব সমাজ। সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে রাজউক উচ্ছেদ থেকে নিজেদের বিরত করে। উপস্থিত রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সবার উপস্থিতিতে রাজউক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার আলোকে এই ক্ষেত্রের আগামী দিনের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে। তাৎক্ষণিক রাজউক সেখানে একটি সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে আসে। যেখানে উল্লেখ করা হয় ‘রাজউকের অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি/ ‘রাজউক জিন্দাপার্ক’/ প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও উন্নয়নে/ অগ্রপথিক পল্লী সমিতি/ আদেশক্রমে রাজউক’। কিন্তু এরপরও গত ১৬ এপ্রিল রাজউক পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ওই পার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনাকারীদের সম্পর্কে অবৈধ বাণিজ্যিক কর্মকা- পরিচালনা করে অর্থ উপার্জন করছে মর্মে বক্তব্য প্রকাশ করেছে। এ সম্পর্কে জিন্দা পার্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তবারক হোসেন কুসুমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাজউক গত ৩ এপ্রিল দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সামনে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার আলোকে এই ক্ষেত্র পরিচালনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশ্বাস দিলেও এখনও সে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উপরন্তু পার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনাকারীদের সব ত্যাগ ও সৃজনশীল উদ্যোগকে চরম অবমূল্যায়ন করে অনেক নেতিবাচক অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে, যা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। কুসুমসহ তার অন্য বন্ধুরা বলেন, এই বিশাল কর্মক্ষেত্রটি একটি সাধনার ফসল। এখান থেকে আজও পর্যন্ত কেউই ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করা কিংবা বাড়তি অর্থ উপার্জনের স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। রাজউকের অধিগ্রহণ করা এই পার্কটির মালিকানা রাজউক-এর। কিন্তু স্কুল, লাইব্রেরি, মসজিদসহ বহুসংখ্যক স্থাপনা এবং সেগুলোকে ঘিরে যে কার্যক্রম চলছে ও আগামীর কর্মপরিকল্পনা রয়েছে, তা কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা আমরা যেমন চাই না, একইসঙ্গে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজও তা চান না।
জিন্দা পার্কের উদ্যোক্তারা ওই বিশাল ক্ষেত্রে একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ জ্ঞান, শিক্ষা ও মানবতার পক্ষে আরও অনেক আয়োজনের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু তারা সন্দিহান সে স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে কি-না। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তবারক হোসেন কুসুম তার জীবনের এই স্বপ্নটি পূরণ করতে গিয়ে সংসার জীবনে পর্যন্ত প্রবেশ করেননি। এমনকি দামি কোন বেশভূষা পর্যন্ত ধারণ করেন না। সাধারণত অতি সাধারণ পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরেন। তার অনুসরণে ওই প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মীই (স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা ছাড়া) গ্রামের অতি সাধারণ দরিদ্র মানুষের পোশাক (শার্ট-লুঙ্গি কিংবা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি) পরেন। কর্মীদের মধ্যেও একই ধরনের কর্তব্যনিষ্ঠা, ত্যাগ ও নমনীয়তার নজির দেখা যায়। চারদিকে যখন কৃষি, প্রকৃতি আর সাধারণ গ্রামবাংলার সহজ-সরল জীবনব্যবস্থাকে নানা প্রক্রিয়ায় মুছে ফেলার প্রতিযোগিতা চলছে, তখন ১০ গ্রামের মানুষের স্বপ্নের এই প্রাণকেন্দ্র সত্যিই এক টুকরো আশ্রয়। যারা এটিকে সবটুকু সৃজনশীলতা ও প্রেম দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন, আজ তাদের উপেক্ষা মানে প্রকৃতির অনেক অনুষঙ্গের মতো পাঁচ হাজার মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা। খুব বেশি কিছু চাওয়াও তাদের নেই, শুধু দাবি জিন্দা পার্ক পরিচালনার অধিকারটুকু বহাল রাখা। এইটুকু না থাকলে এই বিশাল পল্লী প্রকৃতির স্বপ্নটুকুকে আর কেউ লালন করতে পারবে না, ঘটবে অপমৃত্যু।