দিবস : কপিরাইট নিয়ে কিছু কথা

দিবস : কপিরাইট নিয়ে কিছু কথা

মনজুরুর রহমান

images (5)

আজ বিশ্ব মেধা সম্পদ দিবস। সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে সারা পৃথিবীতেই এখন কপিরাইট এবং কপিরাইটজাত রিলেটেড রাইট বা অধিকার বহুল আলোচিত ও স্পর্শকাতর একটি অনুষঙ্গ। ১৯৪৮ সালে ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ২৭-এ দেয়া হয়েছে এর স্বীকৃতি। এ বিষয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ সচেতনতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে; প্রণয়ন করেছে আইন ও বিধি; প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ দেখভাল এবং সুরক্ষার সময়বান্ধব উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারপরও অনেকে দেশে সৃষ্টিশীল মানুষ বঞ্চিত তাদের অধিকার থেকে, স্বত্বাধিকার থেকে। উন্নত বিশ্ব প্রতিনিয়ত তাদের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে যেমন সচেতন তেমনি তারা তাদের সৃষ্টি বাজারজাত করে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেও করেছে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে গতিশীল। উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তার জিডিপির ১১.৯৭% অর্জন করেছে কপিরাইটজাত কর্মকাণ্ড থেকে। কানাডা করেছে ৫.৩৮%।

অন্যদিকে এশিয়ার সিঙ্গাপুর ২০০১ সালে তাদের জিডিপিতে যুক্ত করেছে ৫.৭%।

আমরাও করছি ; কিন্তু তার প্রকৃত হিসাব আমাদের কাছে নেই, আছে শুভঙ্করের ফাঁকি।

আমাদের সৃষ্টিশীল জনগোষ্ঠী উপেক্ষিত এবং দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিগত ৫০ বছরে অসংখ্য দেশবরেণ্য লেখক-শিল্পী রোগ-শোকে ভুগে বিনাচিকিত্সায় নিঃশেষ হয়েছেন। কতবার তাদের কল্যাণের জন্য তহবিল গঠনের প্রয়োজন পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। অন্যদিকে ‘গুড়ের লাভ পিঁপড়া’-তে খাওয়ার ফলে সরকার প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে। সৃষ্টিশীল মানুষ ও দেশের স্বার্থেই এ পরিস্থিতি থেকে জরুরি উত্তরণ প্রয়োজন। আমাদের আছে ২০০০ সালের চমত্কার কপিরাইট আইন, ২০০৬ সালের বিধিমালা, আইন দেখার জন্য আছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর, থানা-পুলিশ, আদালত এবং আরো অনেক কিছু। তবে এর বিপরীতে আছে সৃষ্টিশীল মানুষ এবং ভোক্তাবৃন্দের সচেতনতার অভাব, আত্মকেন্দ্রিকতা, অন্যকে ঠকিয়ে সম্পদশালী হওয়ার প্রবণতা এবং আইনানুগভাবে একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারের অভাব। অথচ নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার আন্তর্জাতিক বিধান ও উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। WIPO ও CISAC দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সহযোগিতা দেয়ার জন্য। বাংলাদেশ কপিরাইট আইনের অধ্যায় ৮ এর ধারা ২১ থেকে ৪৭-এও বিধানে তাদের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। এখন দরকার স্বার্থ সুরক্ষা ও দেখভাল করার জন্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিজস্ব সমিতি গঠন; যা পৃথিবীব্যাপী Collective Management Organization বা CMO নামে পরিচিত।

আজ থেকে প্রায় ২৩৭ বছর আগে ১৭৭৭ সালে পশ্চিমের দেশ ফ্রান্সে গঠিত হয়েছে প্রথম CMO বা কপিরাইট সমিতি। এরপর থেকে ক্রমাগত পৃথিবীব্যাপী স্ব-স্ব স্বার্থের দিকে নজর দিয়ে সংগঠিত হয়েছে সচেতন মানুষেরা। তারাই আবার এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগ, স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রযুক্তি বিনিময়ের জন্য ১৯২৬ সালে সমিতিসমূহের কনফেডারেশন গঠন করেছে। যা International Confederation of Societies of Authors and Composers বা CISAC নামে খ্যাত।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দেশীয় কপিরাইট আইন এবং আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান প্রতিপালন করে আমাদের সৃজনশীল নাগরিকগণ যদি পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, দূরত্ব ও আলস্য ভুলে এগিয়ে আসেন তা হলে বাংলাদেশেও সম্ভব দ্রুত কপিরাইট সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করা। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি ও অর্থ সাহায্য দিয়ে সমিতি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করতে CISAC সম্মত আছে মর্মে আমরা জ্ঞাত হয়েছি। এই মুহূর্তে সকল বিষয়ে না হোক, অন্তত সঙ্গীত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ খুব স্বল্প সময়ে কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। সোসাইটি হলেই কেবল বন্ধ হবে ফুটপাতের পাইরেসি, এফএম রেডিও, মোবাইল ফোনে বে-আইনি সঙ্গীত ব্যবহার, পেনড্রাইভ ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনা অনুমতিতে সঙ্গীত সংগ্রহ, হোটেল, পরিবহন এবং বিমানসহ যে যে স্থান এবং মাধ্যমে চুক্তিবিহীন সঙ্গীত ব্যবহূত হয় তার সব কিছুই। বন্ধ হবে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের চাতুর্য, তাস্কর্য ও দুর্বৃত্তায়ন। তদুপরি দেশীয় সোসাইটি হলে বিদেশ থেকেও আসতে বাধ্য বিপুল পরিমাণ রয়্যালটি। সোসাইটিই কেবল পাহারা দিতে সক্ষম তার সমিতিভুক্ত সদস্যদের উর্বর সোনালি শস্যক্ষেত্র।

বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই প্রয়োজন প্রকৃত জাগরণ। কিন্তু আমরা যে কুম্ভকর্ণ ! আমাদের ঘুম ভাঙাবে কে?

লেখক :গবেষক

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend