সাতশ’ বছরের সাক্ষী বড়ইবাড়ি ঢোল সমুদ্র
খবর বাংলা২৪ ডেক্স: কালিয়াকৈরে তিন মাসের খননশেষে চলছে গবেষণা। এটি মুসলিম স্থাপত্য বলেই অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, বড়ইবাড়ি ঢোল সমুদ্র মুসলিম প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার ছোট কেন্দ্র হতে পারে। তবে ভিন্ন মতে এটা বৈষ্ণব মঠ হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। দালানের ধ্বংসাবশেষটি ৮ মিটার দীর্ঘ ও ৮ মিটার বিস্তৃত।
ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের সফিপুর বাজার। এখান থেকেই কালিয়াকৈরের বড়ইবাড়ি যাওয়ার রাস্তা। চলেছে সাপের মতো একেবেঁকে। রাস্তার দুপাশে প্রাণ জুড়ানো সবুজ ধানক্ষেত। ১৩ কিলোমিটার উত্তরে গিয়ে দেখা গেল, সাতশ’ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী ‘বড়ইবাড়ি ঢোলসমুদ্র’ প্রত্ন নিদর্শন। তিন মাসের খনন শেষে চলছে তথ্য ও নিদর্শন নিয়ে গবেষণা।
ধারণা করা হচ্ছে, এটি মধ্যযুগের একটি নিদর্শন। খননের সময় কোন প্রাণিচিত্র না পাওয়ায় অনেকটা নিশ্চিত এটি মুসলিম স্থাপত্য। আশপাশের মুসলিম স্থাপত্য কাঠামো এবং বড় একাধিক পুকুর দেখে মনে করা হচ্ছে সামন্ত রাজা, কররানী, গাজী ও সুফি সাধকরা এ অঞ্চল শাসন করেছেন। এ নিদর্শন এ ভূখণ্ডে মুসলমানদের ইতিহাস সন্ধানে নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে ১২৭৫ সালে সোনারগাঁও থেকে। সেসময় শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্ররা আসতো। সেসময় প্রায় দুইশ’ বছর মুসলিম শাসন ছিল। বড়ইবাড়ি ঢোলসমুদ্র সেই প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার ছোট কেন্দ হতে পারে। এটি শাসন রাজ্যের রাজধানীও হতে পারে।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম শাহনেওয়াজ বলেন, বড়ইবাড়ি ঢোলসমুদ্র প্রত্নস্থলটি একটু ‘অদ্ভুত’ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রত্ন নিদর্শন। মুসলিম বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলেও এটি মুসলিম স্থাপত্য কিনা সেটি নিশ্চিত নয়। প্রাপ্ত সামগ্রীতে মুসলিম অলংকরণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হলেও সেটি মসজিদ বা খানকাহ বলা যায় না।
তিনি জানান, খ্রিস্টীয় ১৬ থেকে ১৭ শতকে এই অঞ্চলে বৈষ্ণব অনুসারীদের উপস্থিতি দেখা যায়। তারা ব্রাক্ষ্মণদের বিরোধিতা করে নিজেদের আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে জাহির করে। বৈষ্ণবরা মূর্তিপুজা করতো না। চারপাশে যেহেতু মুসলমানদের শাসন ছিলো তাই তারা কোনো স্থাপত্য নির্মাণে মুসলিম সামগ্রী ব্যবহার করে থাকতে পারে।
মধ্যযুগ গবেষক এ ঐতিহাসিকের মতে, এটি বৈষ্ণব মঠ হতে পারে। আর বড়ইবাড়ি ঢোলসমুদ্র প্রত্নস্থলটির অবস্থান গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায়। ‘কালিয়া’ শব্দের সঙ্গে ‘লোকজ’ যোগসূত্র রয়েছে। তিনি বলেন, প্রাপ্ত তথ্য ও নিদর্শনের ভিত্তিতে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে এটি মুসলিম স্থাপত্য বা নিদর্শন নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এটি মধ্যযুগের নিদর্শন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে
বড়ইবাড়ির ঢোলসমুদ্র গ্রামে খনন শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। খননে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে একের পর এক নিদর্শন। পাওয়া গেছে, বিভিন্ন কারুকাজ খচিত একটি দালানের ধ্বংসাবশেষ। ধারণা করা হচ্ছে, এটি খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতাব্দীতে নির্মিত। এটি ৮ মিটার দীর্ঘ ও ৮ মিটার বিস্তৃত। পশ্চিম-উত্তর, পশ্চিম-দক্ষিণ ও পূর্ব-দক্ষিণ কোণের পিলারের অংশ বিশেষ ছাড়াও পশ্চিমমুখী দরজা এবং প্রায় পৌনে দুই মিটার প্রশস্ত দেয়াল অক্ষত রয়েছে। প্রায় আড়াই মিটার উঁচু দেয়ালের ভিত্তিমূলে ব্যবহার করা হয়েছে ঝামা ইট; যা ভবনকে আর্দ্রতা থেকে সুরক্ষা দিত।
অনুসন্ধান দলের সদস্য ফিল্ড অফিসার নাসিমা শাহীন বলেন, দেয়ালের বাইরে হাতে কাটা ইটের জালি নকশা ও অলংকরণ, টেরাকোটা এবং বিভিন্ন আকৃতির ইটের স্থাপত্যশৈলী, কর্নার ট্যারেট, পাথর, ফুটন্ত পদ্মফুল, আঙ্গুর ফল, চারা, মাটির পাত্র, গ্লেইস টাইলস, ডালিম ফল, তেঁতুল পাতা, ফুলের কলি, বটপাতার নকশাসহ বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে।
খননে যারা ছিলেন
আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে খনন করা হয়েছে। ঐতিহ্যের সন্ধানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা আঞ্চলিক বিভাগের ব্যবস্থাপনায় তিন মাস চলে খনন। ২৫ জন শ্রমিক নিয়ে খনন শুরু হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ত্রিশাল কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে সহায়তা করেছেন। ‘মুটের চালা’ নামক ঢিবির ৪ শতাংশ জমির ওপর অনুসন্ধান দল খনন করেছে। সুউচ্চ সেই ঢিবির চারটি জায়গায় খনন করা হয়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ও খনন দলের নেতা নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘বাজেট না থাকায় আপাতত খনন বন্ধ রাখা হয়েছে। পরে বাজেট নিয়ে আশপাশের এলাকায় মাঠ, পুকুর, দীঘিসহ বিভিন্ন স্থান খনন করা হবে। আশা করা হচ্ছে, খননের পর আরও নিদর্শন পাওয়া যাবে।’
সরেজমিন
বড়ইবাড়ি ঢোলসমুদ্রে গিয়ে দেখা যায়, খনন করা স্থানটি মাটিতে ঢেকে রাখা হয়েছে। সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি এটি। দেখাশোনার জন্য এখনও লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। পাশেই দেখা যায় মস্ত এক মাঠ। গ্রাম ঘুরে তিনটি বড় পুকুরও দেখা গেছে। আর পুরো গ্রামের এখানে সেখানে পড়ে আছে পুরনো ইটের টুকরা।
এছাড়া চোখে পড়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালকের লাগানো সাইন বোর্ড। লেখা আছে, ‘কোন ব্যক্তি এই পুরাকীর্তির কোন রকম ধ্বংস বা অনিষ্ট সাধন করলে বা এর কোন বিকৃতি বা অংগচ্ছেদ ঘটালে বা এর কোন অংশের উপর কিছু লিখলে বা খোদাই করলে বা কোন চিহ্ন বা দাগ কাটলে, ১৯৬৮ সালের ১৪ নং পুরাকীর্তি আইনের ১৯ ধারার অধীনে তিনি সর্বাধিক এক বত্সর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।’
নতুন ইতিহাস জানার অপেক্ষা
বড়ইবাড়ি ঢোলসমুদ্র যে মধ্যযুগের নিদর্শন সেটা প্রায় নিশ্চিত। তবে মুসলিম সভ্যতা নাকি হিন্দু সভ্যতা এটা নিয়ে সন্ধিহান বিশেষজ্ঞরা। সে যাই হোক, এর সঠিক ইতিহাস বের করতে পারলে এই অঞ্চলের ইতিহাস যে নতুন করে লিখতে হবে এটা নিশ্চিত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোঃ আতাউর রহমান বলেন, রাজশাহীর বাঘা মসজিদে একই রকম টেরাকোটা ও ইটের ব্যবহার রয়েছে। সরকারিভাবে এগুলো সংরক্ষণ করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা চলছে। তিনি বলেন, জাতীয় ইতিহাসের বইগুলোতে বড়ইবাড়ি ঢোলসমুদ্র বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তাই এটা নির্ধারণ করা আমাদের জন্য খুব কঠিন ছিল। এবার ঢোলসমুদ্র এলাকার রাজবাড়ী খননে বেরিয়ে আসা তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। এখানে পরবর্তী সময়ে আরো খনন চালানো হবে। সরকারিভাবে এসব প্রত্নস্থাপনা সংরক্ষণের চিন্তা ভাবনা চলছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য
কথা হয় স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে। খনন করা জায়গার পৈত্রিক মালিকানা চার ভাইয়ের। এরা হলেন- মো. মফিজ উদ্দীন, চাঁদ মিয়া মাস্টার, শাহাজ উদ্দীন এবং মো. শাহজাহান। এদের একজন চাঁদ মিয়া মাস্টার বলেন, যেখানে খনন করা হয়েছে সেই উঁচু ঢিবিটার নাম মুটের চালা। জায়গাটা আগে জঙ্গলে ঢাকা থাকত। ভয়ে মানুষ এখানে আসতো না। শেয়ালের অভয়ারণ্য ছিল এটি। এটাই যে এখন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যাবে সেটা ভাবতেই ভালো লাগছে।
জায়গার আরেক মালিক মো. শাহজানের ছেলে আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আমাদের বাড়ির পাশেই ‘লবলং সাগর’ নামে একটা বন্দর ছিল। সেই বন্দরকে কেন্দ করেই এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে বলে দাদির কাছে শুনেছি। আমরা এখানে বাস করছি চার পুরুষ ধরে।
যেভাবে শনাক্ত করা হয়েছে
২০০১ সালে প্রথম বড়ইবাড়ি ঢোলসমুদ্র প্রত্ননিদর্শনটি শনাক্ত করা হয়। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় আনুষ্ঠানিক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়। এই এলাকার পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরনো ইটের টুকরা। দুই থেকে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়েই দেখা মেলে টুকরা ইটের। এটা থেকেই খননের আগ্রহ পায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।