নদ কেটে এবার সরু খাল
খবর বাংলা২৪ ডেক্স: মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই কপোতাক্ষ নদের জমি দখল করে ভবন নির্মাণের পর এবার সরু খালে পরিণত করা হচ্ছে। এবার নদটি খনন করে মাটি রাখা হচ্ছে নদের ভেতরেই। ফলে ভারী বৃষ্টিতে স্তূপ ধসে ফের নদ ভরাট হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
এ অবস্থা সাতক্ষীরার তালা উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই কপোতাক্ষ নদের। এভাবেই পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রায় ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার খননের কাজ করে চলেছে। যদিও খনন কাজে অভিযোগ উঠেছে দুর্নীতি আর অনিয়মের।
কপোতাক্ষ নদ ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার তাহেরপুর থেকে উৎপত্তি হয়ে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, যশোরের ঝিকরগাছা, কেশবপুর ও মনিরামপুর, সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া, আশাশুনি ও শ্যামনগর এবং খুলনার পাইকগাছার শিববাড়ি শিপসা নদীর ত্রি-মোহনায় মিশেছে। নদটির দৈর্ঘ প্রায় দুইশ’ কিলোমিটার। বর্তমানে সাত কিলোমিটার বাদে সবই ভরাট হয়ে গেছে পলি পড়ে। এতে নদের দু’তীরের কয়েক লাখ মানুষ প্রতিবছরই জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
যশোর পাউবো দপ্তর থেকে জানা গেছে, ২০১১ সালের জুলাইয়ে কপোতাক্ষ নদ খননে চার বছর মেয়াদী প্রায় ২৬২ কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২১ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার খননে ৬১ কোটি ৮০ লাখ ৭৪ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এ খনন কাজের কার্যাদেশ দেয়া হয় ১৫ টি গ্রুপে ১২টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ১৯ হাজার ৪৫০ মিটার, দুই জন ইউপি চেয়ারম্যানকে ৮৫৫ মিটার ও চার জন ইউপি সদস্যকে ৯৪৫ মিটার করে।
পাউবো সূত্রমতে, কপোতাক্ষ নদ খননের নকশা অনুযায়ী তলদেশের প্রস্ত হবে স্থান বিশেষ ১০৩ ফুট থেকে ১৩০ ফুট। শুরুর দিকে প্রস্ত হবে স্থান বিশেষ ১৪৮ ফুট থেকে ২০৩ ফুট এবং গভীরতা হবে স্থান বিশেষ ১০ ফুট থেকে ১৪ ফুট। খননের মূল নকশা থেকে চলতি অর্থবছরে (২০১৩-১৪) খনন করা হচ্ছে, তলদেশ প্রস্ত ৩৩ ফুট, শুরুতে প্রস্ত ৪৯ ফুট ও গভীরতা সাড়ে ৬ ফুট। খননকৃত মাটি ১৭০ ফুট দূরে ফেলার কথা রয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে তালা উপজেলার মাগুরা, বারুইপাড়া ও চরগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কপোতাক্ষ নদের এক পাশে খননযন্ত্র (এক্সক্যাভেটর) দিয়ে খনন করা হচ্ছে। আটটি খননযন্ত্র (এক্সক্যাভেটর) এই খনন কাজ করছে। নদের তলদেশ ২০ থেকে ২৫ ফুট, মাথা ৩০ থেকে ৩৫ ফুট ও দুই থেকে তিন ফুট গভীর করা হচ্ছে। খননের মাটি নদের ভিতরে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো স্থানে চাচা-ছোলা করা হচ্ছে বা হয়েছে।
তালা উপজেলার মাগুরা গ্রামের জহর আলী গাজী বাংলামেইলকে জানান, কপোতাক্ষ নদের তলা ২২ থেকে ২৫ ফুট, উপরে ৩০ থেকে ৪০ ফুট ও দুই থেকে তিন ফুট গভীর করে কাটা হচ্ছে। খননের মাটি নদের ভেতরে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। বর্ষা হলে এ মাটি ধসে নদ আবার ভরাট হয়ে যাবে।
মাগুরা গ্রামের শিক্ষক জনাব আলী বাংলামেইলকে জানান, কপোতাক্ষ নদ খননে আগেও লুটপাট হয়েছে, এবারও তাই হচ্ছে। পাউবো কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা কপোতাক্ষকে দুধের গাভী হিসেবে ব্যবহার করছে।
বারুইপাড়া নারায়ন দেবনাথ অভিযোগ করে বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা কাজ তেমন তদারকি করে না, ফিল্ডেও আসে না ঠিকমতো। এজন্য ঠিকাদাররা সুযোগ পেয়ে কাজে অনিয়ম করে।’
একই গ্রামের নিমাই দেবনাথ বাংলামেইলকে বলেন, নদ খনন করে মাটি যে ভাবে রাখা হচ্ছে, এতে নদের চরভরাটি জমি দখল করতে ভূমিদুস্যদের সুবিধা হবে। এমন কথা মাগুরা গ্রামের সুফিয়া বেগম, সাদ্দাম হোসেন, গনেশ মণ্ডল, বিধান রায়সহ অনেকেরই।
খননযন্ত্র (এক্সক্যাভেটর) চালক মিজানুর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘খনন করে মাটি নদের তীরে রাখা হচ্ছে। পরে এ মাটি অপসারণ করা হবে।’ নিয়ম অনুযায়ী খনন হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঠিকাদার যে ভাবে বলেছে, সেভাবে খনন করছি।’
ঠিকাদারের পক্ষে কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা জামানুল হক মুন্নি বাংলামেইলকে বলেন, ‘নকশা অনুযায়ী খনন করার চেষ্টা করছি। তবে সব সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন হয় না। তিনি বলেন, ‘যশোরের এমএসসি-একেএ (জেভি) ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক শামিম চাকলাদারসহ ১২জন ঠিকাদার খননের কাজ বাস্তবায়ন করছেন।’
কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদ মুল ডিজাইন অনুযায়ী খনন করা হচ্ছে না। লোক দেখানো খনন করে লুটপাট করা হচ্ছে।’
এমএসসি-একেএ (জেভি) প্রতিষ্ঠানের মালিক শামিম চাকলাদার বাংলামেইলকে বলেন, ‘নকশা অনুযায়ী খনন করা হচ্ছে। তবে খননকৃত মাটি আপাতত নদের ভেতর রাখা হচ্ছে। এ মাটি নদের ভেতর থেকে অপসারণ করা হবে।’
কাজ তদারকি কর্মকর্তা (এসও) মো. রফিকুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘খনন কাজে কোনো প্রকার অনিয়ম হবে না। ফিল্ডে না আসার প্রশ্নই ওঠে না।
খেশরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম লিয়াকত হোসেন কপোতাক্ষ খননের কাজ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত বাংলামেইলকে বলেন, ‘নামে আমি কাজ পেয়েছি। ভেতরে অনেকেই এ খনন কাজের সঙ্গে আছে।’
যশোর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলি মো. মশিউর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, নদের ভেতরে কোনো মাটি রাখা যাবে না। খননের মাটি নদের ভেতর থেকে অপসারণ করতে হবে।