খবর বাংলা২৪ ডেক্সঃ সন্দেহ আর অবিশ্বাসের ঘূর্ণিপাকে বিএনপি। শীর্ষ নেতারা একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করেন না- কী আন্দোলনে, কী দল পুনর্গঠনে। ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র আগ মুহূর্তে কয়েকজন নেতার জেলে যাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল দলের ভেতরই। আবার ওই সময় যারা বাইরে ছিলেন, তাদের আত্মগোপনে থাকা নিয়েও ছিল তীব্র সমালোচনা। সর্বশেষ গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমানউল্লাহ আমান জেলে গেলেও একই মামলায় মির্জা আব্বাসের জামিন নিয়েও নানা গুঞ্জন ওঠে। অনেক নেতাই নিজেদের ঘনিষ্ঠজনদের কাছে নাম ধরে বলছেন, ‘অমুকে সরকারের এজেন্ট, অমুকে ওই সংস্থার এজেন্ট’।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়েও দলের ভেতরে নানা সমালোচনা রয়েছে।
পরস্পরের প্রতি নেতাদের এ ধরনের সন্দেহ-অবিশ্বাসের বিষয়টি অজানা নয় খোদ চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। কারও কারও বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগও আসছে বিএনপি-প্রধানের কাছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের এ আস্থাহীনতায় তৃণমূলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন এ কারণেই অনেকটা সমস্যাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন নেতারা। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস না থাকায় ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দল। আগামী দিনের সরকারবিরোধী আন্দোলনে এ ধরনের নৈরাশ্যবাদী (ফ্রাস্টেশন) অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে দল চরম বিপর্যয়ে পড়বে।
২০ এপ্রিল এক মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে নিম্ন আদালত থেকে জেলে পাঠানো হয় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানকে। একই মামলায় স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্য মির্জা আব্বাসের জামিন মঞ্জুর করা হয়। এ নিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও নানা ‘মুখরোচক’ মন্তব্য শোনা যাচ্ছে। আব্বাসবিরোধী নেতারা বলছেন, সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে জামিন নেওয়া হয়েছে। আব্বাসই মূলত সরকারের ‘এজেন্ট’।
আবার আব্বাস সমর্থক নেতারা বলছেন, দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতেই সরকারের প্রভাবে দ্বিধাবিভক্ত রায় এসেছে। এ রায়ে তারাও স্তম্ভিত। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদেরও দ্বিধাবিভক্ত অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়ে গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে মুক্তি পান বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রমুখ। গ্রেফতার হওয়ার আগে সরকারের বিরুদ্ধে এসব নেতার মুখে তীব্র সমালোচনার ঝড় লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কারামুক্তির পর ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ছাড়া বাকি সবাই একেবারেই চুপসে যান। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা বক্তব্য শোনা যায়। নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, কারাগার থেকে বের হওয়া নেতারা সরকারের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা করেই বের হয়েছেন। তাই তারা চুপসে গেছেন। দলের ভেতরে থাকা ব্যারিস্টার মওদুদবিরোধীদের মুখে এও শোনা গেছে, সরকারবিরোধী বেশি কথা বললে মওদুদের গুলশানের বাড়িটিও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই ব্যারিস্টার মওদুদ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। একেবারেই চুপসে গেছেন। এমনকি প্রবীণ এই আইনজীবী রাজনীতি থেকে পুরোপুরি অবসরে যাবেন এমন গুঞ্জনও রয়েছে দলের ভেতরে-বাইরে। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় এখন সাবেক আমলাবেষ্টিত। বিএনপির মূল রাজনীতির নিয়ন্ত্রকও তারাই। অনেক ক্ষেত্রে তারা দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তও নেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনেকটাই ‘নামকাওয়াস্তা’।
স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য এমন কথাই সাফ জানিয়েছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও গুলশান কার্যালয়ের ওইসব কর্মকর্তার কাছ থেকেই তাদের শুনতে হয় বলে জানান একাধিক সিনিয়র নেতা। জানা গেছে, গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের একবার সালাম দিয়েও অনেক কেন্দ্রীয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতা নিজেকে ধন্য মনে করেন। ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করার আগে দফায় দফায় ধরনা দিতে হয় তাদের কাছে। অথচ ২০-৩০ বছর ধরে মাঠের রাজনীতিতে তারাই হলেন বিএনপির প্রাণশক্তি। সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে জেলা পর্যায়ের আন্দোলন ছিল উল্লেখ করার মতো। শহীদ জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করে আসা অনেক নেতাকেও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয় অরাজনৈতিক এসব কর্মকর্তার হাতে। ওই কার্যালয়ের কারও কারও পোশাক-আশাক, চালচলনে মনে হয়, এখনো তারা সরকারের সুবিধাভোগী। এ নিয়ে গুলশানে আসা নেতা-কর্মীদের মধ্যেও নানা ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায়। অথচ এ কার্যালয়ে আসার আগে তাদের চেহারা ছিল ভিন্ন। কার্যালয়ে আসা অনেক নেতা-কর্মীর মুখে শোনা যায়, এ অফিসের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি বর্ধিত অংশ। সেখানে ডাক না পড়লে সিনিয়র কোনো নেতা যান না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতারাও বেগম জিয়াকে কোনোমতে একটি সালাম দিতে পারলেই খুশি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে মাঠের সত্য কথা বলতে পারেন না। কারণ তা মুহূর্তেই চলে যায় কার্যালয়ে বাইরে। এমনকি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলেও। বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলেও বেশ কয়েক ধাপ আটকানো হয় রাজপথের এই পরীক্ষিত নেতাদের। এ জন্য তাদের অনেকেই গুলশান কার্যালয়ে যেতে চান না। এদিকে বেশ কয়েক দিন ধরে দল পুনর্গঠনের নামে ‘হুটহাট’ করে জেলা কমিটি ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে। এ কারণে বিএনপির তৃণমূলের পুরনো কোন্দল নতুনরূপে দানা বেঁধেছে। বিএনপির অনেকেই মনে করছেন, দল এখন উল্টো পথে হাঁটছে। শাস্তির ‘খড়গ’ তৃণমূলে কেন- এ প্রশ্নও উঠছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি সমস্যা ছিল ঢাকা মহানগর ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। নীতিনির্ধারকরা তাকে প্রাধান্য দেননি। ঢাকা মহানগরীতে নতুন কমিটি দেওয়ার কথা একাধিকবার বলা হলেও কার ‘ইশারায়’ তা আটকে আছে- এ নিয়ে নেতা-কর্মীরাও সন্দেহ-সংশয়ে রয়েছেন। বিএনপির নির্বাহী কমিটিও দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ। এ নিয়েও নীতিনির্ধারকদের কোনো মাথাব্যথা নেই। মেয়াদোত্তীর্ণ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। নিষ্ক্রিয় নির্বাহী কমিটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিচ্ছে না বিএনপি। দলের পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবও নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাঁচবার জেলে গিয়েও ‘ভারমুক্ত’ হলেন না বিএনপির ক্লিন ইমেজের নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ নিয়ে নেতা-কর্মীরাও হতাশ। এসব বিষয় সমাধান না করে পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি ভেঙে ছোট করায় কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ মাঠের নেতা-কর্মীরা। জানা গেছে, দল পুনর্গঠনের নামে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি করার ক্ষেত্রে তৃণমূলের নেতাদের মতামতেরও গুরুত্ব থাকছে না। তৃণমূল যাদের দায়িত্বে চাইছে প্রভাবশালী একটি মহল থেকে ভিন্ন নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। এ নিয়ে মাঠের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা গেছে। নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। আবার বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি তারুণ্যনির্ভর হবে- নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য এলেও আহ্বায়ক কমিটিতে সেই বার্ধ্যকের ছাপও পাওয়া গেছে। দলের প্রভাবশালী ওই মহলের যোগসাজশে ব্যক্তি পছন্দের ‘পকেট’ কমিটিও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে আগামীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন নেতা-কর্মীরা। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক এই দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন ১১টি। এর মধ্যে গুটিকয় বাদে বাকিগুলো নামসর্বস্ব। সরকারবিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই অধিকাংশ সংগঠনের। তৃণমূল পর্যায়ে পকেট কমিটি থাকলেও নেই কোনো কার্যক্রম। অধিকাংশ সংগঠনের কেন্দ্রের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একাধিক ঘরোয়া বৈঠকে ঢাকা মহানগরী বিএনপির পাশাপাশি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর ওপরও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ জন্য শীঘ্রই মেয়াদোত্তীর্ণ অঙ্গ সংগঠনগুলো পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যদিও কমিটি কবে হবে তা এখনো অনিশ্চিত। এসব সংগঠনের মাঠের নেতাদের বক্তব্য হলো_ দীর্ঘদিন ধরে একই কমিটি থাকায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হতাশ। আর তাই বিএনপির আন্দোলনেও তারা সাড়া দিচ্ছেন না। দলের মাঠের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ- দল পুনর্গঠন কিংবা আন্দোলন নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা সব বিষয়েই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। ঢাকা মহানগরী বিএনপির কমিটি, অঙ্গ সংগঠনের কমিটি, জাতীয় কাউন্সিল, পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব নির্বাচন করা নিয়ে এ ধরনের অবস্থান এরই প্রমাণ। এতে দলই চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। ভুল-শুদ্ধ যাই হোক সংগঠনের স্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি বলেও মনে করেন তারা। এ ধরনের অবস্থান দলের ‘দৈন্যদশা’ও বলে স্বীকার করেন অনেক নেতা। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে মুখ ফুটে অনেক নেতা বলতে না পারলেও বাইরে তারা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে এসব হতাশার কথা জানান। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপিসহ নানা অঙ্গ সংগঠনের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ভাঙান কোনো কোনো নেতা। তার নামে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজিও করা হচ্ছে। অবশ্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একাধিকবার নেতাদের সতর্ক করে বলেছেন, তারেক রহমান প্রত্যক্ষভাবে দলের রাজনীতিতে অনুপস্থিত। মাঠের বাস্তবতার অনেক কিছুই জানেন না তিনি। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তই তার সিদ্ধান্ত। তাই তার নাম ভাঙিয়ে কমিটি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করতে হবে। এ ছাড়া জিয়া পরিবারকে জড়িয়ে কেউ নিজস্ব ফায়দা হাসিল করলে তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। দলের ভেতরে বিভিন্ন বিষয়ে নেতাদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি হচ্ছে বলে স্বীকারও করলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, তিন নেতার জামিনের আবেদনে একজন ছাড়া দুজনকে জেলে পাঠানোর ঘটনায় কিছুটা সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। আমার মতে, এটা সরকারের একটি অপকৌশল। সরকার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে নানাভাবে সন্দেহ-অবিশ্বাস জন্মাতে কাজ করে। কারণ যখনই এ ধরনের সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, তখনই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সমস্যা দেখা দেয়। এটাই সরকারের উদ্দেশ্য। আশা করি, নেতা-কর্মীরা এসব বিষয়ে সতর্ক হবেন। সব নেতার প্রতিই কর্মীদের ইতিবাচক ধারণা রাখতে হবে।