ভণ্ড নবীর গ্রেফতার দাবিতে উত্তাল রংপুর
খবর বাংলা২৪ ডেক্স: অগ্নিপূজক, নবী রাসুল দাবিদার ভণ্ডবাবা ফিরোজ কবীরকে গ্রেফতার এবং তার আস্তানা স্থায়ীভাবে সিলগালা কারার দাবিতে রংপুর মহানগরীতে সোমবার দুপুরে স্মরণকালের সর্বৃবৃহৎ বিক্ষোভ করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা।
দাবি আদায়ে তারা প্রতিবাদ সমাবেশ, ডিসি, এসপির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। গত বছর এই ভণ্ড বাবা সম্পর্কে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল।
ভণ্ড দয়ালবাবা ফিরোজ কবীর নিজের নামে কালেমা পাঠ, নিজের মুত্যুর তারিখ ঘোষণা, কোরআন হাদিসের বিকৃত অর্থ উপস্থাপন, দুই ওয়াক্ত নামাজ দাবি করে নিজেকে হজরত ও জামানার মোজাদ্দেদ মাহবুবে সোবহানী উপাধি দানকারীর ধৃষ্ঠতা প্রদর্শন করায় ফুঁসে উঠেছেন রংপুরের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা।
সোমবার দুপুরে ভণ্ডবাবার দরবার মাহিগঞ্জের বড়হাজরাসহ আশেপাশের হাজার হাজার মুসল্লিরা রংপুর সিটি বাজারের সামনে জমায়েত হন। সেখানে সমাবেশে বক্তব্য দেন ঈমান আকিদা সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা ইউনুস আলী, যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা মোহাম্মদ আলী, সদস্য সচিব এটিএম গোলাম মোস্তফা, সদস্য মাওলানা মাহমুদুর রহমান রিপন, মাওলানা খায়রুল ইসলাম, মুফতি নাজমুল ইসলাম, মাওলানা তাজুল ইসলাম, ক্বারী আতাউল হক আল হক্কানী, হাফেজ ইদ্রিস আলী প্রমুখ।
পরে ঈমাদ আকিদা সংরক্ষণ কমিটির প্রধান মুরব্বি মাওলানা ইউনুস আলীসহ মুরব্বিদের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রথমে ডিসি অফিস ও পরে এসপি অফিস ঘেরাও করে।
এ সময় ভণ্ডবাবার গ্রেফতারের দাবিতে শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো নগরী। ঘেরাওকালে মুসল্লিদের একটি প্রতিনিধি দল ডিসি ফরিদ আহাম্মেদ ও এসপি আব্দুর রাজ্জাকের কাছে তিন দফা দাবিতে স্মারকলিপি দেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, অগ্নিপূজক, নবী রাসুল, আল্লাহ ও ইসলাম অবমাননাকারী ভণ্ডবাবা ফিরোজকবীরকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মাহিগঞ্জের বড় হাজরায় ভণ্ডবাবার দরবারের জমিসহ সব স্থাপনা স্থায়ীভাবে সিলগালা করে দিতে হবে। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে ধর্মপ্রাণ তৌহিদি মুসলমানদের হৃদয়ে জমাট বাঁধা ক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে এবং তার মাধ্যমে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলে তার দায় দ্বায়িত্ব প্রশাসনকেই বহন করতে হবে উল্লেখ করা হয় স্মারকলিপিতে।
ভণ্ডবাবা ফিরোজ কবীরের বিরুদ্ধে রংপুরের মাহিগঞ্জের বড় হাজরায় কবিরিয়া দরবার শরিফ স্থাপন করে অগ্নিকুণ্ডলী বানিয়ে কাচা কাঠ পুড়িয়ে অগ্নিপূজার মাধ্যমে রোগব্যাধি ভালো করা, নিজেকে বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য নবী রাসুল দাবি, সালামের পরিবর্তে দুই হাতের তালু একত্রিত করে বুকের মাঝে নিয়ে এসে (বৌদ্ধদের অনুকরণে) মাথা নোয়ানোর পদ্ধতি চালু করা, পবিত্র কালেমা তাইয়েবার সাথে নবীর নাম বাদ দিয়ে নিজের নাম সংযুক্ত করে ভক্তদের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ফিরোজ কবির রাসুলুল্লাহ বলতে বাধ্য করা, সুরা ইখলাসসহ বিভিন্ন আয়াতের মধ্যে যেখানে আল্লাহ আছে সেখানে আল্লাহ না বলে আনতাল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ) বলাসহ কোরআন ও হাদিসের অর্থ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা, পবিত্র কোরআনের অর্থ বিকৃত করে সৃষ্টিকর্তা একাধিক বলে দাবি করা, হাদিসকে ভিত্তিহীন দাবি করে তার তরজমাকৃত কোরআনের অর্থই সঠিক বলে দাবি করা, এক হাতে কোরআন রেখে অন্যহাতে অনর্গল সিগারেট খাওয়া, পৃথিবীতে মুসলমান হিন্দু বলে কিছু নেই সবাই সমান বলে দাবি করাসহ বিভিন্ন অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের গুরুতর অভিযোগ করে আসছিলেন মুসল্লিরা।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে কুমারি ভোগ, মাবুদকে পাওয়ার জন্য সাগরেদদের কুমারিভোগের মন্ত্র শিক্ষা দেয়া, তরুণ তরুণীদের প্রেম সফল করা, সন্তান জন্মানো, স্বামীবশীকরণসহ মনোষ্কামনা পূরণের নামে ভোগ করা, ভক্তদের বশকরে টাকা কামানো এবং দরবার নির্মানের নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় স্মারকলিটিতে।
এছাড়াও ভণ্ডবাবা ফিরোজ কবীরের বিরুদ্ধে নিজের মৃত্যুর তারিখ হিসেবে ২০৩৪ সালের ১১ আগস্ট সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে ৬৬ বছর বয়সে ঘোষণা করা। মৃত্যুর পর লাশ কবর না দিতে নসিত করা এবং ৬ অথবা ৮ মাস কফিনে রাখার পর কফিন খুলে মৃতদেহ না পচে গেলে তা দিয়ে মাজার তৈরি করা সংক্রান্ত অভিযোগও রয়েছে ভক্ত ও এলাকাবাসীর।
শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে প্রতি মাসের ১১ তারিখে ওরসের নামে গরু খাসি একসাথে জবেহ করে রান্নার পর খিচুরি প্রথমে দরবার শরীফের কুকুরকে খাওয়ানো, তারপর দরবারের অগ্নিপূজার জন্য ব্যবহৃত অগ্নিকুণ্ডে খিচুরির প্যাকেট দেয়া, এরপর দরবারের পূর্বপার্শ্বের বটিকাটা পুকুর, তারপাশের এনাম দেওয়ানীর বাড়ির ভগ্ন ইটগাঁথা ঢিবি এবং এরসামান্য দুরে শ্মশানে খিচুরির প্যাকেট অর্পন করা শেষে খিচুরিগুলো উপস্থিত ভক্ত, আগুন্তক ও এলাকাবাসীর মধ্যে বিতরণ করারও অভিযোগ রয়েছে।
ফিরোজ কবীরের বিরুদ্ধে তার নির্দেশ মানলে নামাজ রোজা হজ জাকাত ছাড়াই মানুষ বেহেশতে যেতে পারবে। তার পায়ে সেজদা দিলেই পরকালের আজাব থেকে মুক্তি মিলবে। আয়ু বাড়বে।
এমনকি যাকে খুশি দয়াল বাবা আয়ু বৃদ্ধি ও হরণ করতে পারার বিষয়েও অখিযোগ আছে। ফিরোজ কবির পবিত্র কোরআন শরিফকে শুধুমাত্র আরবি ভাষার একটি বই হিসেবে দাবি করতেন।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নের জনৈক তৈয়বুর রহমানের পুত্র ফিরোজ কবির(৪৩) বিমান বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়ে প্রথমে লালমনিরহাটের হাড়াঠি ইউনিয়নের শাহ আহম্মেদ কবির(র) এর নামে শহরের মিশন মোড়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজেকে পীর বলে দাবি করেন।
সেখানে অনৈসলামিক কর্মকান্ড ও অপকর্মের জন্য এলাকাবাসী ২০১০ সালে ফিরোজ কবীরকে স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর মোস্তফার নেতৃত্বে আটক করে গণধোলাই দিয়ে থানায় সোপর্দ করে।
সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি রংপুর মহানগরীর শালবনে এসে বসবাস শুরু করেন। এরপর ২০১১ সালের ১১ আগস্ট রংপুর মহানগরীর স্টেশন রোডের শাহী মসজিদের পাশে একটি তিনতলা ভবনের তৃতীয় তলায় আস্তানা গেড়ে আবারো পীরগিরি শুরু করেন।
এসময় তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে হযরত শাহ ফিরোজ কবীর(রহ) ওরফে দয়াল বাবা রাখেন। সেখানে নিজস্ব কিছু লোকজনের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই শহরের নামীদামী বিভিন্ন স্তরের লোকজনকে ভক্ত বানান। এরপর ২০১২ সালের ১ লা মে রংপুর মহানগরীর সেন্ট্রাল রোডের ৯৬ নম্বর বাসা ভাড়া নিয়ে শাহানশাহ কবীরিয়া নামে দরবার শরিফের কার্যক্রম শুরু করেন।
এক পর্যায়ে মাহিগঞ্জের বড় হাজরায় মাহিগঞ্জের এক হিন্দু ব্যাক্তির ২৪ শতক জমি ক্রয় করে সেখানে গড়ে তোলেন শাহানশাহ কবীরিয়া নামের দরবার শরীফ। ২০১৩ সালের ১১ মার্চ দরবারটি ভক্তদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উম্মুক্ত করে দেয়া হয়।
গত বছর প্রথম কবীরিয়া দরবার শরিফের ভণ্ডবাবা ফিরোজ কবীরের বিরুদ্ধে এধরনের অপকর্ম ও অনৈসলামিক কর্মকান্ডের বিষয়ে প্রথম বিরোধিতা করে দরবার শরীফের সভাপতি হাফিজুর রহমান হাফিজ, সেক্রেটারী জিয়াউল হায়দার খান টিপু সদস্য সাদেকুল আলম বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, ডিসি, এসপি, র্যা বসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে সব অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে লিখিতভাবে আবেদন করেন।
আবেদন পত্রে তারা উল্লেখ করেন, সরল বিশ্বাসে দয়াল বাবার কথায় রাজি হয়ে তার সাথে উঠাবসা ও তার আদেশ পালন করার পর যখন দেখি ফিরোজ কবির আল্লাহ, রাসুল ও ইসলাম সম্পর্কে আপত্তিকর কথাবার্তা বলছে। তখন আমরা তার এমন কর্মকান্ডের বিরোধিতা করলে আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। আমরা বিষয়টি নিজেদের মধ্যে এনালাইসেস করে ভুল বুঝতে পেরে তার কাছ থেকে বেরিয়ে এসে তওবা করি এবং আমাদের মতো যেন কেউ আর ভন্ড বাবার খপ্পড়ে পরে ঈমান আকিদা নষ্ট না করেন সেজন্য লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
পরবর্তীতে তাদেরকে অস্বীকার করে ফিরোজ কবির ভুয়া লোকের স্বাক্ষর দিয়ে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে এসপির কাছে পাল্টা লিখিত অভিযোগ করেন। এনিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে তৎকালীন মাহিগঞ্জ পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ এসআই আফওয়াজুল ইসলামকে তদন্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে এসআই আফওয়াজুল ফিরোজ কবিরের বিরুদ্ধে ইসলাম, নবী রাসুল আল্লাহ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর উক্তি এবং তার অগ্নিপূজাসহ বিভিন্ন অনৈসলামিক কাজের সত্যতা পেয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এরপর ফিরোজ কবির প্রশাসনের মধ্যে থাকা তার ভক্তদের দিয়ে তদন্ত রিপোর্টটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।
ইতিমধ্যেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তারা ভণ্ড দয়ালবাবার এধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঈমান আকিদা সংরক্ষণ কমিটির ব্যানারে আগামী সোমবার দুপুরে সিটি বাজারের সামনে সমাবেশ ও ডিসি এসপির কাছে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি দেন।
কর্মসূচির ৩৬ ঘন্টা আগে শুক্রবার বিকেলে স্থানীয় ঘরোয়া হোটেলে ভণ্ডবাবা ফিরোজ কবির সাংবাদিক সম্মেলন করে দরবার বন্ধের ঘোষণা দেন। কিন্তু ঈমাদ আকিদা সংরক্ষণ কমিটি ভণ্ডবাবাকে গ্রেফতার ও তার দরবারের সম্পতি বাজেয়াপ্তের দাবিতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বহাল রেখেই দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।