আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি

অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা এবং অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের জানমাল নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হলে তা সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়।

রেজাউল করিম খোকন

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে যে কোনো সচেতন নাগরিকই উদ্বিগ্ন হয়েছেন। বেশ কয়েকদিন ধরে পত্রিকার পাতা ওল্টালেই হত্যা, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, ডাকাতি গুম, মৃতদেহ উদ্ধারের খবর চোখে পড়ছে। যা আমাদের সবাইকে স্বাভাবিকভাবে আলোড়িত করছে। একই দিনে রাজবাড়ীর পাংশা থেকে তিনটি মৃতদেহ উদ্ধার এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে নিজেদের ঘরে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার পাশাপাশি দেশের বিভিন্নস্থান থেকে মোট ১৭টি মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনা নিশ্চয়ই নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। নড়াইল, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে যে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে তা স্বাভাবিক মৃত্যুর সাক্ষ্য দিচ্ছে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে খুনের বহু ঘটনা ঘটছে। ডাকাতি, ছিনতাই, লুটতরাজের ঘটনা বাড়ছে। মুক্তিপণের জন্য অপহরণের ঘটনা যেন নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক ও পারিবারিক কলহ থেকেও খুনের ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে রাজনৈতিক সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা।

সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা নির্বাচনের নামে যা হয়েছে তা আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, সংঘর্ষ, বোমা, আগুন, প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারদের মারধর, প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা, লুটপাট, অগি্নসংযোগ, ভাংচুর, ধর্ষণ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব সহিংসতায় অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। অগণিত মানুষ আহত হয়েছেন। ভোট গ্রহণের দিনই শুধু নয়, ভোটের আগে-পরে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। হিংসা শুধু হিংসাকেই ডেকে আনে, সহিংসতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাল্টা সহিংসতার ঘটনাই ঘটে। নির্বাচন শেষ হলেও উপজেলাগুলোয় সহিংসতার রেশ ও আমেজ রয়ে গেছে। কিন্তু এর কি কোনো শেষ নেই? এবারের উপজেলা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং সহিংসতা দমনে সরকারের কি কিছুই করার ছিল না? উপজেলা নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত থাকলেও তাদের নাকের ডগায় ভোটকেন্দ্র দখল, পোলিং ও প্রিসাইডিং অফিসারদের লাঞ্ছিত ও মারধরের ঘটনা, প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা, ভোটারদের ভোটদানে বাধা দেয়াসহ ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যথাযথ ভূমিকা পালন না করার এক পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। যার মন্দ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গোটা বাংলাদেশের সব জেলায়, উপজেলায়। হত্যা, খুন, গুম, চুরি, ডাকাতি অপহরণ সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটা অন্যতম একটি কারণ। অপরাধীচক্র, দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা-পয়সা লুট করতে দ্বিধা করছে না। দেশের আইন-কানুন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। সাধারণ মানুষের ঘর-বাড়িতে চুরি-ডাকাতি লুটপাটের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় জনমনে নিরাপত্তাহীনতা ভয়ভীতির সঞ্চার হয়েছে। কেউ এখন ঘরে তালা লাগিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে দুদ- নিশ্চিন্তে কাটাতে পারছে না। তাদের মনে শঙ্কা, বাড়ি ফিরে হয়তো দেখা যাবে তালা কিংবা ঘরের জানালা ভেঙে দুর্বৃত্ত, ডাকাত দল টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান সবকিছু নিয়ে গেছে, রাজনৈতিক সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার সুযোগ একটি চক্র ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দেশজুড়ে তা-ব শুরু করেছে, তাদের বেপরোয়া কর্মকা-ে হত্যা, খুন, গুম অপহরণ চুরি-ডাকাতি সন্ত্রাসের মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। বাড়ির বাইরে নয়_ নিজের ঘরেও আজ কেউ নিরাপদ নন। অনেককে ঘর থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে অজ্ঞাত পরিচিত লোকজন। পরদিন তাদের মৃতদেহ নদীতে ডোবায় কিংবা রাস্তার পাশে পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে মা-মেয়ের খুনের ঘটনা ঘটেছে তাদের বাসায়। কাজেই দেশের গ্রামাঞ্চলের রাস্তা কিংবা নিজেদের বাসা এখন আর নিরাপদ নয়। দিন ও রাতের যে কোনো সময় নিরাপত্তাহীন। দেশজুড়ে আবারো বেড়ে গেছে নৃশংস খুনের ঘটনা। তুচ্ছ কারণে মানুষ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন। মানুষের জীবনের কোনো মূল্যই নেই। চট্টগ্রাম শহরে মা ও মেয়ের জোড়া খুনের ঘটনাটি যে কারোর হৃদয়ে স্পর্শ করবে। এখন মানুষ এমন নিষ্ঠুর আর নৃশংস হয়ে উঠেছে যে প্রেমান্ধ যুবকও হন্তারকে পরিণত হয়েছে। একজন মানুষের পক্ষে কী করে এমন নিষ্ঠুর ও নৃশংস হওয়া সম্ভব? কেনই বা এমনভাবে পাল্টে যাচ্ছে দেশের যুবসমাজ? মানুষ অবলীলায় হত্যা করছে সন্তানসম ছোট শিশুকে পর্যন্ত। নৈতিকতার এ অবক্ষয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। শুধু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে নয়, মানুষ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে তুচ্ছ ও অর্থহীন কারণেও। প্রতিটি ঘটনাই প্রমাণ করছে দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি প্রশ্নে আলোচনা-সমালোচনা চলছে এবং চলবে। উদার নীতি, কঠোর নীতি নিয়েও কথা হবে। তত্ত্ব দর্শন নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা কম। সাধারণ মানুষ চায় জানমালের নিরাপত্তা। তা না থাকলে বা না দিতে পারলে অন্য কথা বলে খুশি করা যাবে না। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে হলে নাগরিকদের জানমালক রক্ষার ব্যাপারটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখার জন্য যা কিছু করণীয় সবই করতে হবে। কারণ এই একটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে অন্যান্য ক্ষেত্রের সাফল্য মস্নান হয়ে যাবে। সরকারকে অবশ্যই বুঝতে হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তার প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতি সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর। যে সাধারণ মানুষটির সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান সম্পদ এক রাতে ডাকাত দল অস্ত্রের মুখে লুট করে নিয়ে গেল সে কি বাকি জীবনে তা আর জোটাতে পারবে, যে লোকটি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ২ লাখ টাকা খোয়াল সে কি তার ক্ষুদ্র ব্যবসা নিয়ে টিকে থাকতে পারবে? এই বিপদের সময়ে কে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে? এমনিতেই যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তাদের ওপর নীরব চাঁদাবাজির একটা চাপ বরাবর পড়ে আসছে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতার কারণে সামগ্রিক অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি হয়েছে গত কয়েক বছরে। বিশেষ করে গত বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে ক্রমাগত হরতাল-অবরোধ জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির ফলে অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রায় স্থবির হয়েছিল। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর হরতাল-অবরোধ জ্বালা-পোড়াও কর্মসূচির আপাত অবসান হয়েছে। যে কারণে মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, হত্যা খুন, গুম অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুটের ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সবার মনে নতুন আতঙ্ক চেপে বসেছে।
সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- যে জনগণের জন্য সেই জনগণ যদি নিরাপদ জীবনযাপন করতে না পারে, যদি তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি না থাকে যদি নিজের বাড়িতে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা শতভাগ শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার দোলাচলের মধ্যে থাকে তাহলে সব উন্নয়ন অগ্রগতির সাফল্য, কৃতিত্ব মুহূর্তেই মস্নান হয়ে যায়, সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- অনেক সময় মানসম্মত হতে পারে না টেন্ডারবাজির কারণে। যারা রাজনীতি করেন তাদের একথা উপলব্ধি করতে হবে যে আইনের শাসন ছাড়া আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটানো যায় না। আর আইনের প্রয়োগের সঙ্গে পুলিশ ও কোর্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সহনীয় মাত্রার মধ্যে রাখতে সমাজের প্রত্যেককে এ ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। ভয় পেয়ে গর্তের মধ্যে লুকালে চলবে না বরং সাহসী হতে হবে এবং সম্মিলিতভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি রোধ করতে হবে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। প্রতিটি থানায় ও ডিবি কার্যালয়ে সৎ লোক নিয়োগ দিয়ে দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করে অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা এবং অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের জানমাল নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হলে তা সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তিই অপরাধ দমনের অন্যতম উপায়। সরকার যতই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং উন্নয়নের দাবি করুক না কেন বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে অহেতুক কৃতিত্ব দাবি করার ফলাফল কোনো সময়েই ভালো হয় না। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশের সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এখন সবার প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে। জনগণের এ দাবি পূরণে সরকারের সর্বোচ্চ মহল অবশ্যই মনোযোগী এবং সচেষ্ট হবেন_ মনেপ্রাণে প্রত্যাশা করেন সবাই।

রেজাউল করিম খোকন: ব্যাংকার, অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend