ভারতের নির্বাচন ও বিজেপির আক্রমণাত্মক ভূমিকা

উল্লেখ্য, বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সমর্থিত বিজেপি এবং তার মুখপাত্র নরেন্দ্র মোদি যে নির্বাচনে ভালো ফল করবে বলে প্রচারিত হয়েছে তা সফল হলে ভারতের গণতন্ত্র বিপন্ন হবে; সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়বে এবং মুসলমানদের ওপর নির্দয়তা প্রচ-বেগে নেমে আসবে

image_820_119374

আবুল হাসানাত 

উড়োজাহাজে চড়ে নির্বাচনী প্রচার কাজ সম্পন্ন করাই হোক আর প্রচার মাধ্যমে ৫০০০ কোটি রুপি খরচ করার জন্যই হোক, মুসলমানদের বিরুদ্ধে টাইরেড চালানোর জন্যই হোক, হিন্দুত্ববাদের পুনরুত্থানের জন্যই হোক, নরেন্দ্র মোদি যে দিলি্লর সিংহাসনে বসছেন তাতে কোনো ভুল নেই। মোদি ঢেউ অস্বীকার করে লাভ নেই এবং লক্ষণীয় গুজরাটের মুসলিম নিধনের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী তো দূরের কথা, ‘দুঃখিত’ও তিনি বলেননি।

মুসলমান কমবেশি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের অধিকাংশই গরিব, অশিক্ষিত ও নিরক্ষর। তারা কোনো শক্তিশালী দলের দ্বারা পরিচালিত হন না। তারা মোটামুটিভাবে কংগ্রেসকেই ভোট দিয়ে থাকে। শিক্ষিত শ্রেণি কংগ্রেসের দলে। বহু মুসলমান শিক্ষিত, বিজেপির দলে রয়েছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বিখ্যাত সাংবাদিক এম জে আকবর কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগদান করেছেন। তিনি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত কলামে লিখেছেন কংগ্রেসের অযোগ্যতার কথা, দুর্নীতির কথা। অবশ্য মুসলমানরা যে দ্বিধাবিভক্ত, তাও সত্য। প্রত্যাশা মেটেনি দশ বছরের কংগ্রেস শাসনে। তাই তাদের একটা বিরাট অংশ সুযোগ-সুবিধের জন্য বিজেপির সমর্থক। বিজেপি জিতবে এবং আঞ্চলিক কয়েকটি দল নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিজেপি হিন্দুত্ববাদের ঊধর্ে্ব উঠতে পারবে এমন তো মনে হয় না। 
অষ্টম শতকে আরবরা সিন্ধু দেশ জয় করে সেখানে তাদের শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তুর্কি আক্রমণ ভারতে ঘটে ১০২১ সালে। তারপর ক্রমান্বয়ে জয়ের ধারাবাহিকতায় একদিন ভারত মুসলমানদের অধীনে এসে যায়। তাই মোটা দাগে বলা যায়, হাজার বছর ধরে ভারতে মুসলমান বাস করছেন, হিন্দুর সঙ্গে, শিখের সঙ্গে। হিন্দু-মুসলমান কোনোদিনই মিল খায়নি বলে রমেশচন্দ্রের মতো ইতিহাসবিদ বলুন না কেন, মিলেমিশেই তারা আছে_ যতই দাঙ্গা বিভিন্ন সময় হোক না কেন। গভীর অর্থনৈতিক সমস্যা ধর্মীয় সমস্যা বলে মনে করে গান্ধী-নেহরু-জিন্নাহরা ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ভারত ভাগ করেছিলেন হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের জন্য, তা বাস্তবে হয়নি, হতে পারে না। সমস্যা আরো প্রবল হয়েছে। জাতিতে জাতিতে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে। এরপরও হিন্দু যতই চলে যাক পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে, মুসলমান যতই চলে আসুক বিহার, উত্তর প্রদেশ ও বাংলা থেকে, অন্তর্নিহিত স্রোত একটাই_ হিন্দু-মুসলমান বাস করছে তিন দেশেই। ভারত বড় দেশ। তাই সেখানে ১৫ কোটি মুসলমান। তারা ওই দেশেই থাকবে_ মোদি আসুন বা রাহুল গান্ধী আসুন। এটা ইতিহাসের সত্য।
আজ ২০১৪ সালে তাই ইতিহাসের চাকাকে পাল্টে দেবে বিজেপি তা অসম্ভব। তাই হিন্দুরা মুসলিম হত্যা করলেও গুজরাট থেকে এবং সম্প্রতি মোজাফফর নগর থেকে পালিয়ে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে আশ্রয় নেননি।
নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি মাধ্যম। এটাই গণতন্ত্রের শেষ কথা নয়। তাই মোদি বলেছেন, তিনি ভারত শাসন করবেন সংবিধান অনুসারে। আরএসএসের নির্দেশনায় নয়। কিন্তু এটা সম্ভব নয় তার পক্ষে। কারণ মোদিকে মনোনয়ন দিয়েছে আরএসএস এবং এই আরএসএসই আদভানিকে সংসদের নেতা থেকে অপসারণ করেছে। আদভানি ও বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী পদে মোদির মনোনয়নে সম্মতি দেননি, যদিও বরফ গলাতে মোদি তাদের সঙ্গে দরবার করেছিলেন। তারা বিশেষ কারণে তার মনোনয়ন মেনে নিয়েছিলেন। ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট প্রফুল্ল বিদবাই জানাচ্ছেন (দ্য ডেইলি স্টার এপ্রিল ১৪, ২০১৪)। এমন কী বিজেপি প্রেসিডেন্ট রাজনাথ সিংহ তার এ পদের জন্য আরএসএসের প্রতি কৃতজ্ঞ। উপরন্তু আরএসএস বিজেপির ১২ সদস্য বিশিষ্ট সংসদীয় বোর্ড ও ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নির্বাচক কমিটি গঠন করে। তাই বলা যায়, হিন্দুত্ববাদের বিষাক্ত বৃত্তেই বিজেপি বন্দি। দৈনন্দিন কার্যকলাপও নিয়ন্ত্রিত করে থাকে আরএসএস এবং সাংগঠনিক নিয়োগ ও টিকিট বিতরণও। এটা আগে ঘটেনি।
মোদির দক্ষিণ হস্ত বলে বিবেচিত অমিত শাহ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি শ্যামলি ও মুজফফরনগরে প্রতিশোধ নেবেন, যেখানে গত সেপ্টেম্বরে মুসলমানবিরোধী দাঙ্গায় ৬০ জন মারা গেছেন এবং হাজার হাজার ব্যক্তি গৃহহারা হয়েছিলেন।
আজ মোদির প্রয়োজন বিজেপি ও অবিজেপি আঞ্চলিক নেতাদের_ ভোটের জন্য এবং মৈত্রী গঠনের জন্য। কিন্তু ‘হি উহল ট্রিট দেম, লাইক ডার্ট ওয়ান্স দে হ্যাভ সার্বভ দেয়ার পারপাস, মি. মোদি ইজ ইনকিউবেবলি অথারেটেরিয়ান অ্যান্ড ব্রুকস নো ডিসেন্ট’ (ওই)। শুধু তাই নয়, এই দলের আরেক নেতা খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত স্থান চেয়েছেন। ফলে বিজেপির দিলি্ল মসনদে সমাসীনের আশঙ্কায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কী রকম হবে তা বলা মুশকিল। কংগ্রেসের সঙ্গে হাসিনা সরকারের মহব্বত থাকা সত্ত্বেও তিস্তার পানি আমরা এখনো পাইনি। ফারাক্কা সমস্যাও রয়েছে। সামুদ্রিক সীমানা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। ছিটমহল পাওয়া_না পাওয়ার মীমাংসা হয়নি। অসম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বলে কথিত কংগ্রেসের কাছ থেকেই যখন এ ব্যবহার বাংলাদেশ পেয়েছে, তখন হিন্দুত্ববাদী চরম প্রতিক্রিয়াশীল বিজেপি এবং আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি এবং তার মনোনীত প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়।
অবশ্য ভারতে অনেকেই বলছেন_ ‘চিন্তাশীল ব্যক্তি, কলাম লেখক, সাংবাদিক যে ভারতের অবস্থাটি ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিস্ট’ এবং এই স্বাধীনতার পর ৬৬ বছরে ভারতে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং সামাজিক অবস্থান_ বিভিন্ন শ্রেণির, বর্ণের, গোত্রের, জাতপাতের, হিন্দু, মুসলমান, শিখ, পার্সি_ ইত্যাদির যে সেখানে সামাজিক ভিত ও গণতান্ত্রিক অবস্থান নড়বড়ে করে দেয়া খুব কঠিন। গদিনশিন না হয়ে ব্যক্তি বিশেষ বহু কথা যা যুক্তিহীন ও উস্কানিমূলক বলা যায়। বা নির্বাচনে বলে থাকে_ ভোট টানার জন্য নির্বাচন হয়ে গেলে গদিনশিন হয়ে গেল দল বা ব্যক্তিবিশেষ বৃহত্তর কোনো ক্ষতি দেশের জনগণের বিরুদ্ধে করতে পারেন না। পারা সম্ভব নয়। 
এ কথার মধ্যে যুক্তি আছে। কিন্তু সম্পূর্ণ আস্থা ভারতের জনগণ পোষণ করেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বিশেষ করে ভারতের মুসলমান সমাজের একটি বিরাট অংশ বিজেপির আগের শাসনে এবং বর্তমানে নির্বাচনকালীন বক্তব্যে ভীত হয়ে পড়েছে_ কারণ, বক্তব্য মুসলমানবিরোধী, মুসলিম স্বার্থবিরোধী এবং উত্তেজনাকর উস্কানিমূলক।
অবশ্য সমগ্র বিষয়টি নির্ভর করছে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। বিপুল ভোটে বিজেপি নির্বাচিত হলে এক রকম ফল; অন্য আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগিতায় জয়লাভ করলে অন্যরকম ফল। নির্বাচনী ফলের ওপর নেতৃত্বের কর্মসূচির নির্ভরশীল।
বিশ্ব এখন ছোট হয়ে এসেছে। বিশ্বায়নের এ যুগে কোনো দেশ বা রাষ্ট্র বা সরকার চোখ বুজে অন্ধ হয়ে থাকতে পারে না_ অন্য দেশের রাজনৈতিক অবস্থা তাকে উদ্বিগ্ন বা হর্ষোৎফুল্ল করতে পারে। তাই বাংলাদেশের মানুষ কিঞ্চিৎ উৎসুক হবে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ প্রায় চারদিকে বেষ্টিত ভারতের সীমানায় বাংলাদেশের অবস্থান। তাই বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ভারতের নির্বাচনের বিভিন্ন খবরাখবর প্রতিদিন প্রকাশিত হয়ে থাকে। এতে ভারতের দিকে যে আমাদের বিশেষ দৃষ্টিনিবদ্ধ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ট্র্যাজেডি এখানে, আমরা যতই কংগ্রেস বা বামপন্থীশাসিত ভারত_সরকার দেখতে চাই, বাস্তবে এ বছর বিজেপির নরেন্দ্র মোদি ও আরএসএস নিয়ন্ত্রিত নরেন্দ্র মোদিই সরকারপ্রধান হবেন। এটা রাজনৈতিক বাস্তবতা-পছন্দ হোক বা না হোক। 
লক্ষণীয়, আরএসএসের উৎসমূলে রয়েছে ইতালির মুসোলিনীর আত্মা। ১৯২০ থেকে এর সূত্রপাত। ১৯৩১ সালে আরএসএস নেতা বি এম মূনজে ইউরোপে ভ্রমণ করেন এবং মুসোলিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতে ফিরে এসে তিনি ইতালিও ফ্যাসিবাদী লাইনে আরএসএসকে গড়ে তোলেন এই আশায়, ভারত স্বায়ত্তশাসন অর্জন করবে মুসোলিনী বা হিটলারের মতো একজন হিন্দু ডিক্টেটরের অধীনে এবং এরাই গান্ধীকে হত্যা করেন ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে। ফলে আরএসএস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এখন যে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তুলে ধরেছে আরএসএস যার বিভিন্ন সংস্থা মিলে পরিচিত সংঘ পরিবার হিসেবে, সেই মোদি গুজরাটে কী করেছিলেন। নির্বাচনে বারবার গুজরাট মডেল তুলে ধরা হয়েছে। এর নাম উন্নয়ন মডেল। মজার কথা হচ্ছে গুজরাটের উন্নতির সূচনা মোদির আগমনের বহু আগে থেকে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়ন কমে গেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে। চাকরির ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে, গ্রোথ হ্যাজ বিন ব্রট বাই গিফটিং হিউজ সাবসিডিজ, ল্যান্ড অ্যাট থ্র অ্যাওয়ে প্রাইসেস অ্যান্ড ফ্রি ইলেকট্রিসিটি টু বিগ বিজিনেস, ডেমলিটং ইন দ্য হাটেন্ট লেবেল অব পার কেপিটা ডেট অব অল স্টেটস ইন ইন্ডিয়া এ লেবেল দ্যাট উড বি ডাইসেক্টারাস ইফ এক্সটেন্ডেড টু দ্য হোল অব ইন্ডিয়া (হলিডে ২৫/৪/২০১৪)।
উল্লেখ্য, বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সমর্থিত বিজেপি এবং তার মুখপাত্র নরেন্দ্র মোদি যে নির্বাচনে ভালো ফল করবে বলে প্রচারিত হয়েছে তা সফল হলে ভারতের গণতন্ত্র বিপন্ন হবে; সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়বে এবং মুসলমানদের ওপর নির্দয়তা প্রচ-বেগে নেমে আসবে।

আবুল হাসানাত: গবেষক ও কথাশিল্পী

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend