তিস্তা বাঁধ-বাংলাদেশের মারণফাঁদ এবং ইমাম বুখারি: গোলাম মাওলা রনি সাবেক সংসদ সদস্য

image_25373_0_2516সত্যি বলতে কি বিষয়টি সম্পর্কে আগে আমার তেমন জানা ছিল না। কিন্তু জানার পর থেকে খুবই খারাপ লাগছে। ভণ্ড দেশপ্রেমিকেরা হয়তো বলবেন Ñ আমি ভঙ ধরেছি বা তাদের  মতো সঙ সেজে ঢঙ করছি। ঘটনা কিন্তু তা নয়। যা বলছি এবং যা লিখছি তা একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতি থেকেই করছি। আর এ ব্যাপারে একমাত্র যিনি মনের খবর রাখেন তার কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছি না। সম্মানিত পাঠকেরা হয়তো প্রশ্ন করবেনÑ কেন আপনার খারাপ লাগছে; আর কী-ই বা এমন বিষয় যা আপনি আগে জানতেন না এবং হঠাৎ করেই জানলেন, অমনি আপনার খারাপ লাগা শুরু হলো।

আমার কাহিনীটি শুরু করার জন্য ছোট্ট একটু ভূমিকা দেয়া দরকার। তা না হলে আমার কলম হয়তো অক্ষম হয়ে পড়বে আসল ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে। এক বছর ধরে গবেষণাধর্মী একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখছি ‘মোগল হেরেমের দুনিয়াকাঁপানো প্রেম’ নামে। সম্প্রতি শুরু করেছি একই ধরনের আরো একটি উপন্যাসÑ নাম আরব্য রজনীর মহানায়ক। দুটো বইয়ের জন্যই আমাকে প্রতিদিন নিয়মিত পড়তে হয় অনেক কিছু। মোগল হেরেমের ২৭তম পর্বের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাকে বাংলাদেশের নদ-নদী নিয়ে অনেক কিছু পড়তে হলো এ কথা জেনে খুবই অবাক হলাম যে, দুনিয়ার সব মহান শাসক খুব ভালোভাবে জানতেন প্রধান প্রধান নদীর গতিপথ, নদীবিধৌত সমভূমির উর্বরতা এবং নদীপাড়ের সভ্যতা সম্পর্কে। নদীর সাথে মানুষের চিরন্তন সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে মনের চরিত্র যেভাবে বিকশিত হয় তারই একটি গাণিতিক এবং জ্যামিতিক রূপ রেখা দাঁড় করিয়ে শাসকেরা কোনো দেশ আক্রমণের জন্য কর্মপন্থা অবলম্বন করতেন।
দিল্লির শাসকেরা বহু যুগ ধরে চেষ্টা করে আসছিলেন বাংলার ওপর স্থায়ী আধিপত্য স্থাপন করার। কিন্তু কেউ পারেননি কেবল মোগল সম্রাট নূরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ছাড়া। সুবেদার ইসলাম খানের মাধ্যমে বাংলা জয়ের আগে সম্রাট প্রথমে বাংলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন তার বিদূষী স্ত্রী নূরজাহানের কাছ থেকে। নূরজাহান পরামর্শ দিলেন বাংলার নদ-নদী এবং বর্ষাকাল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য। সম্রাট সেই কাজটি ভালোভাবে করলেন এবং শেষমেশ বাংলা জয়ের রাজতিলকের মালিক হলেন। ইংরেজরাও একই কাজ করেছিলেন। ১৭৬৪ সালে অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের মাত্র আট বছর পর ইংরেজরা বাংলার নদ-নদীগুলো সার্ভে করার জন্য জেমস রেনেল নামে বিখ্যাত সার্ভেয়ারকে নিয়োগ দিলেন। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নদ-নদীর জরিপ সম্পন্ন করার জন্য রেনেল তার সদর দফতর স্থাপন করলেন ঢাকায়। ১৭৭৬ সালে তিনিই প্রথম এ অঞ্চলের নদ-নদীর ম্যাপ তৈরি করেছিলেন। গত প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসে এত নির্ভুল ম্যাপ আজ পর্যন্ত কেউ তৈরি করতে পারেনি। এ জন্য তাকে বলা হয় ‘ভারতবর্ষের ভূগোলের জনক’।
বাংলাদেশের নদ-নদী নিয়ে অতীতের সেসব ইতিহাস এবং ম্যাপ ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই পদ্মা এবং তিস্তা নদী সম্পর্কে আমি প্রথম বিস্তারিত তথ্য ও উপাত্ত  পেয়ে ধারণা লাভ করলাম। সারা জীবন শুনে এসেছি, পদ্মা নদীর উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের সর্বনাশ করেছে। কিন্তু কী সর্বনাশ করেছে কিংবা কিভাবে সর্বনাশ করেছে এসব ব্যাপারে বিস্তারিত না জানা এবং না বোঝার কারণে আমার মানসপটে কোনো কষ্ট বা বেদনার ছাপ পড়েনি। অন্য দিকে ভারত তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করেছে, পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং বাংলাদেশকে পানি দিচ্ছে নাÑ এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের পরিবেশবাদীরা বহু দিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আমি না জানার কিংবা না বোঝার কারণে দেশের অন্য সব অসচেতন মানুষের মতো নিরন্তর নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি আর কেবল নিজের স্বার্থে যতটুকু দরকার ততটুকু কর্ম করে ধীরে ধীরে কবরের দিকে এগোচ্ছি অনেকটা নাসির উদ্দিন হোজ্জার দুর্বল গাধাটির মতো।
এ দেশের নদ-নদী সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা যখন গর্ব করার বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তিস্তা নদীর গতিপথ, পানিপ্রবাহ এবং এর উজান থেকে পানি প্রত্যাহার হলে সম্ভাব্য কী কী ক্ষতি হতে পারে তার একটি স্পষ্ট দৃশ্য মানসপটে আঁকতে পারলাম। এ কারণে পারলাম যে, ফারাক্কা বাঁধের ভয়ানক ক্ষতি সম্পর্কে নিজের রয়েছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতি, ভুবনেশ্বর, চন্দনা, গড়াই, কুমার প্রভৃতি নদ-নদী ছাড়াও বেশ বড় কয়েকটি বিল রয়েছে। এগুলোর  নাম দোল সমুদ্র, রাসকেলীর বিল, শকুনের বিল, ঘরাধর বিল প্রভৃতি। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আমার গ্রামের প্রতিটি বর্ষাকাল সারা জীবনের স্বপ্ন হয়ে থাকবে। সাধারণ ভূমি থেকে আমাদের বাড়িসহ গ্রামের অন্যান্য বাড়ি গড়ে ১০ ফুট উঁচু ভূমির ওপর নির্মাণ করা ছিল। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমরা বর্ষার গন্ধ পেতাম এবং প্রস্তুতি নিতে থাকতাম। আষাঢ়ে তো সব কিছু টইটম্বুর। পুরো গ্রাম তলিয়ে যেত। যে বছর বন্যা হতো, সে বছর আমাদের বাড়িতেও দু-তিন ফুট পানি উঠে যেত। আমাদের মা-চাচীরা ছোট ছোট বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতেন।
আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির পুরোটাই যেন ছিল বর্ষাকেন্দ্রিক। শত শত বড় বড় মহাজনী নৌকা বাজারগুলোতে ভর করত। বাজারভর্তি পণ্যসামগ্রী। আর মাছ?  ও কথা বলতে গেলে বুক ফেটে যায়। আমি নিজে ৪০-৪৫ প্রজাতির দেশী মাছ দেখেছি, যা এখন প্রায় বিলুপ্ত। আমাদের গ্রামবাংলার খুব অল্প পরিবারই বর্ষাকালে মাছ কিনত। গোটা দুই বড়শি নিয়ে কেউ যদি উঠানে বসে যেত তাহলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চার-পাঁচজন লোকের খাওয়ার মতো মাছের সংস্থান হয়ে যেত। বর্ষাকালের ধানগাছ আর পাটগাছের অপরূপ দৃশ্য আজো ভুলতে পারছি না। পানি বাড়ার সাথে সাথে ওগুলোও পাল্লা দিয়ে বাড়ত। একেকটা পাটগাছ প্রায় ১৫-১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো এবং মোটা হতো ছোটখাটো একটি তল্লা বাঁশের মতো।
আজ সময়ের বিবর্তনে আমাদের গ্রামে বর্ষাকালে এক ফুট পানিও হয় না। নদীগুলো সব মরে গেছেÑ একটি বিলও অবশিষ্ট নেই। আর মাছের কথা না-ই বা বললাম। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এবং মাছ ধরার পেশায় শূন্যতা নেমে এসেছে। লোকজন সব বিদেশে থাকেÑ বউরা থাকে বাড়িতে। নীতিনৈতিকতা, যে কোথায় গিয়ে নেমেছে, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। কর্তারা বিদেশ থেকে টাকা পাঠায় আর তাদের আত্মীয়স্বজন সেই টাকা দিয়ে প্রথমে ঋণ শোধ করে। তারপর একটি ঘর বানায় এবং সেই ঘরে বসে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আমদানি করা ফার্মের মুরগি, মাছ ও তরকারি খায়। কর্তা যখন চার-পাঁচ পর বছর দেশে ফেরেন তখন দেখেন সব কিছু কেমন যেন আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে।  মনের দুঃখে তিনি আবার চলে যান মরুভূমির দেশে। তার কাছে মরুভূমির দিকে অগ্রসরমান পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের তুলনায় সাহারার তপ্ত বালুর উত্তাপই বোধ হয় ভালো লাগে।
ফরিদপুরসহ পদ্মাবিধৌত সমগ্র জনপদের আজ একই দৃশ্যÑ একই হাহাকার। পদ্মায় পানি নেইÑ চলনবিলে কিছু নেই ।  চার দিকে কেবল ধুধু  বালুরাশি আর সেই বালুতটের বিবর্ণ জনপদের হাহাকার ছাড়া আপনার চোখে কিছুই পড়বে না, যদি আপনি ওই সব অঞ্চল দেখে থাকেন ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে। এসব কিছুই হয়েছে কেবল একটি বাঁধের কারণে আর তা হলো ফারাক্কা বাঁধ। আমাদের পরম বন্ধু ভারত এই বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছিল ১৯৬১ সালে। ১৯৬৯ সালেই এটি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তারা সেটি চালু করতে পারেনি। স্বাধীনতা লাভের পর ভারত সরকার নানামুখী চাপ প্রয়োগ করার পরও বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ফারাক্কা প্রকল্প ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এপ্রিল মাসে মাত্র ১৫ দিনের জন্য পরীক্ষামূলক চালু করার কথা বলে উত্তরের দাদা বাবুরা সেই যে সর্বনাশা খেলা শুরু করলেন, তা কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা আল্লাহই মালুম!
একটি নদীর ওপর অপরিকল্পিত অত্যাচার করার কারণে পাঞ্জাবের হরপ্পা সভ্যতা বিলীন হয়ে গিয়েছিল। বিস্তীর্ণ নদীর বিশাল অববাহিকা পরিণত হয়েছিল মরুভূমিতে। এটা তো বেশি দিন আগের ঘটনাও নয়। মাত্র ৪০০০ বছর আগেকার। ভারতে তখন তাম্রযুগ চলছে। পাকিস্তান-আফগানিস্তান এবং ইরাকের মেসোপটেমীয় সভ্যতার সমসাময়িক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যমুনার শাখা ঘাগর নদীর তীরে। অপরিকল্পিতভাবে উজানে খাল কেটে পানি প্রত্যাহার করার কারণে নদীটি শুকিয়ে যায় এবং তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল মরুভূমিতে রূপ নেয়। ভারতের বিখ্যাত থর মরুভূমিই হলো প্রকৃতির সেই অভিশাপের ফসল। আপনারা কি জানেন থর মরুভূমি কোথায় এবং কেমন? এটি ভারতের সবচেয়ে বড় মরুভূমি, যা রাজস্থানে অবস্থিত। এর আয়তন দুই লাখ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়েও বড়। যে জাতি নিজ দেশে এত্ত বড় একটি মরুভূমি সৃষ্টি করেছিল নিজেদের কুকর্ম দ্বারা, তাদের পক্ষে অন্য একটি দেশকে মরুভূমি বানানো যে কোনো ব্যাপারই নয়Ñ এ কথাটি উপলব্ধির পর থেকেই আমার খুবই খারাপ লাগছে।
আজকের লেখার শিরোনামÑ ‘তিস্তা বাঁধ এবং মারণফাঁদ’ এই অংশটুকু নিয়ে কিছু বলার আগে বলে নেই ইমাম বুখারি সম্পর্কে। এই ভদ্রলোক হলেন দিল্লি শাহি মসজিদের প্রধান ইমাম। তামাম দুনিয়ার অত্যাচারিত মুজাহিদরা তাকে জানেন একজন সাহসী মানুষ হিসেবে। ছোটখাটো একজন মানুষÑ অথচ ইমাম ও একিনের মর্যাদায় যিনি ইদানীংকালে হিমালয়ের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। ভালো নাম সৈয়দ আহমদ বুখারি। তিস্তা বাঁধের মারণফাঁদ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে তার নাম কেন এলো সেই প্রসঙ্গে বলব এই লেখার শেষ অংশে। এখন বলছি তিস্তা বাঁধের ইতিবৃত্ত।
হিমালয়ের সিকিম অংশের পাহুনরি পর্বতশৃঙ্গ থেকে তিস্তার উৎপত্তি। এটিই পৃথিবীর একমাত্র নদী, যা কিনা সবচেয়ে উঁচু স্থান থেকে নেমে এসে সমভূমিতে পড়েছে। হিমালয়ের ২৩ হাজার ১৮৯ ফুট উঁচু থেকে সিকিম পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী, রংপুর জেলা হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে পড়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য মাত্র ১৯২ মাইল, যার বেশির ভাগই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ফলে এর অববাহিকায় সমভূমি খুব কম, মাত্র ১২ হাজার ৫৪০ বর্গকিলোমিটার। ২৩ হাজার ১৮৯ ফুট উঁচু থেকে কোনো নদী খুব বেশি পথ অতিক্রম না করে যদি সমভূমিতে পতিত হয়, তাহলে সমতলের নরম মাটি নদীটির তীব্র স্রোত ধারণ করতে পারে না। তিস্তার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। শিলিগুড়ির ১৪ মাইল উত্তরের শিভোকিতে এসে তিস্তা যখন  সমভূমির স্বাদ পেল, তখন তার প্রচণ্ড গতিময় স্রোতের তাড়নায় নদীর জলধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। করতোয়া চলে গেল পূর্ব দিকে, পশ্চিম দিকে গেল পুনর্ভবা এবং মাঝখান দিয়ে বয়ে চলল আত্রাই।
মহানন্দা পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া দিয়ে একবার বাংলাদেশে ঢুকল এবং দুই মাইল প্রবাহিত হওয়ার পর দিনাজপুরের উত্তরাংশ দিয়ে আবার ভারতে প্রবেশ করল। এরপর ভারতের কিষাণগঞ্জ ও কাটিহার জেলা হয়ে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাশে গোদাগাড়ি এসে পদ্মা নদীতে মিশে গেল। অন্য দিকে করতোয়া গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা হয়ে যমুনেশ্বরীতে গিয়ে মিশল। আর আত্রাই নদীও মহানন্দার মতো দিনাজপুর জেলা দিয়ে একবার ঢুকে আবার ভারতে চলে গেল। আবার ভারত থেকে ফিরে এসে দিনাজপুর জেলার দক্ষিণ অংশের কুমারগঞ্জ ও বালুরঘাট এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এলো। বাংলাদেশে এসে এটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গাবুরা ও কানকারা নদী নামে চলনবিলে পতিত হলো।
তিস্তা নদীর জলধারার ওপরই উত্তরবঙ্গের সব নদী, খাল, বিলের জীবন ধারা নির্ভর করে। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনাÑ এই তিনটি নদীর জীবনও তিস্তার স্রোতধারার ওপর নির্ভর করে আছে। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর সব পানির উৎসমুখের প্রধান দুটি ঝরনাধারার একটি হলো ফারাক্কা পয়েন্ট, যা ইতোমধ্যে ভারত শতভাগ দখল করে বাংলাদেশের সর্বনাশ করে ফেলেছে। অন্য দিকে তিস্তার পানি পাঁচটি বাঁধ এবং দু’টি ব্যারাজের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে এ দেশের পানিপ্রবাহের প্রধান ধারাটি চিরতরে বন্ধ করতে যাচ্ছে। ফারাক্কার মাধ্যমে আমাদের দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তিস্তার মাধ্যমে সেই ক্ষতি হবে এর কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি। কারণ গঙ্গা থেকে ফারাক্কা পয়েন্ট হয়ে পদ্মায় যতটুকু পানি আসত, তার চেয়ে অনেক বেশি পানি আসত তিস্তার তিনটি শাখা নদী দিয়ে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো । তিস্তার দুটি পানিপ্রবাহ রয়েছে। একটি হলো ভূপৃষ্ঠের  ওপরের জলধারা এবং দ্বিতীয়টি একই সমান্তরালে প্রবাহিত হওয়া ভূগর্ভস্থ জলধারা।
ভারত তিস্তানদীর সুতীব্র স্রোতকে ব্যবহার করে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। চীন তার নিজ দেশে ইয়াংসি নদীর ওপর তিনটি ব্যারাজ নির্মাণ করেও এত বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারেনি। অন্য দিকে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই নয়, তিস্তার পানি বিকল্প খালের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে পশ্চিমবঙ্গসহ আশপাশের এলাকায় সবুজ বিপ্লব  ঘটিয়ে ফেলেছে ভারত। অন্য দিকে পুরো হুমকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অস্তিত্ব। এখন প্রশ্ন হলো, ভারত এসব করতে পারে কি না। আমি বলবÑ অবশ্যই নয়, কোনো আইনবলেই তারা এসব করতে পারে না। তবে কিভাবে করল? করেছে এ দেশে তাদের নিয়োজিত এজেন্ট, দালাল ও খয়ের খাঁদের মাধ্যমে। এখানে কূটনীতি এবং খামখেয়ালিপনা ছাড়া তাদের আর কিছুই করতে হয়নি।
ইতিহাসের কোনো কালেই আমাদের এই ভূখণ্ড ধনে, জ্ঞানে-শক্তিতে ভারতের চেয়ে কম ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ভারতকে অতীতের মতো ছাড়িয়ে গেছে বহুলাংশে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সীমান্ত রক্ষা এবং স্থলযুদ্ধে ভারত এখনো বাংলাদেশের সমপর্যায়ের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এ কথা আমাদের চেয়ে ভারত জানে অনেক বেশি। তাই তো সব কাজ করিয়ে নেয় মীরজাফরী কিংবা জগৎশেঠী কূটকৌশলের মাধ্যমে। আমাদের দেশের বিশ্বাসঘাতকেরা সব কিছু থাকা সত্ত্বেও এ জাতিকে কাঙালের সাজে ভিুক বানিয়ে সীমান্ত ঈগলের কাছে সমর্পণ করার জন্য দিবানিশি যে কসরৎ করে যাচ্ছে, তারই ভয়াল থাবার হিংস্র প্রতিচ্ছবিগুলো ফুটে উঠেছে তিস্তা নদীর বাঁধের মারণফাঁদের মাধ্যমে। ফারাক্কা ও তিস্তা প্রসঙ্গে এ দেশীয় মীরজাফরদের কথাবার্তা শুনে আমার বার বার মনে পড়ছে ইমাম সৈয়দ আহমদ বোখারির কথা।
ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুরা পবিত্র কোরআন শরিফ আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করার জন্য পাঁয়তারা আরম্ভ করল। ইমাম বুখারি গর্জে উঠলেন সিংহের মতো। বললেন, ‘আমি শুধু দিল্লি শাহী মসজিদের ইমাম নই, ভারতের ২৫ কোটি মুসলমানের ইমাম। এই ভারতের সব সাহিত্য, সভ্যতা আর ঐতিহাসিক ইমারতের বেশির ভাগ মুসলমানদের নির্মাণ। এই লালকেল্লা, কুতুবমিনার, তাজমহল এবং দিল্লি আমরা নির্মাণ করেছি। এই ভারতের একীভূত ভূখণ্ডকে ৮০০ বছর ধরে একত্র করে রেখেছি আমরা! সেই ভারতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি কোরআনের বিরুদ্ধে আইন করার জন্য একটি অক্ষরও লেখেÑ তাহলে আমি আহমদ বোখারি ওই রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর গলায় পা রেখে তার জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলব।’ ব্যক্তিগত জীবনে আমি কাপুরুষদের হদ্দ। তবে নিজে বীর না হলেও বীরদেরকে পছন্দ করি। ইমাম বুখারির মতো অমন করে বলার সাহস বা হিম্মত আমার নেই। তবে আল্লাহর কোনো বান্দা যদি এ দেশীয় মীরজাফরদের বিরুদ্ধে অমন একটি হুঙ্কার তুলতে পারত, তবে এই অধম সেই বীরকে এবং বীরপ্রসূ জননীকে পা ছুঁয়ে সালাম করে আসতাম!

লেখক: গোলাম মাওলা রনি সাবেক সংসদ সদস্য

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend