কৃষিভূমি সংরক্ষণ : এবনে গোলাম সামাদ

আত্মপক্ষ

download (7)

এবনে গোলাম সামাদ

আমাদের এ অঞ্চলে তে ফসলের জমির পরিমাণ কমে আসছিল। কারণ মানুষ জমিতে করছিল ফলের চাষ। ফলের মধ্যে আবার বিশেষভাবে করছিল আমবাগান। কারণ একবার একটা আমবাগান গড়তে পারলে আম বিক্রি করে অনেক টাকা পাওয়া যায়। আর খাটতে হয় না তেখামারে। কিন্তু এর ফলে কমছিল খাদ্যশস্যের উৎপাদন।

এখনো ভাত আমাদের মূল খাদ্য। ধানের আবাদ কমলে আমাদের খাদ্য সমস্যার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। মাঝখানে রবি মওসুমে গোলআলুর আবাদ হচ্ছিল যথেষ্ট। মনে হচ্ছিল ইউরোপের মতো গোলআলু হয়ে উঠবে আমাদের প্রধান খাদ্য ফসল। গোলআলু সংরণের জন্য আমাদের এলাকার একাধিক হিমঘর গড়ে উঠেছে। কিন্তু আলুর ফলন এতই বেড়েছে যে, তা বিক্রি হচ্ছে না। হিমঘরে আলু পড়ে থাকছে। তিগ্রস্ত হচ্ছেন আলুচাষিরা। এক দিকে দেখা যাচ্ছে খাদ্যাভাব, অন্য দিকে আবার দেখা যাচ্ছে গোলআলু বিক্রি না হতে। এটা কেন হচ্ছে, সেটা হতে পারে কৃষিপণ্য বিপণনের সাথে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের বিশেষ বিবেচ্য। কিন্তু এখন আর একটি বিষয় বিশেষভাবে হয়ে উঠেছে খাদ্য ফসল উৎপাদনের েেত্র বড় রকমের ভাবনার কারণ। বিষয়টি হলো, অনেক ধনবান ব্যক্তি কৃষি তে আর না রেখে সেখানে খনন করছেন বিরাট দিঘি। উদ্দেশ্য, মাছের চাষ করে অধিক লাভবান হওয়া। কিন্তু এভাবে কৃষিজমির পরিমাণ কমিয়ে মাছের চাষ করতে গেলে খাদ্যশস্যের ঘাটতি যে আরো বাড়বে, সেটা সহজেই অনুমেয় হচ্ছে। দেশে দেখা দিতে পারে দুর্ভি।
আমাদের দেশ ভাত-মাছের দেশ। শুধু মাছ খেয়ে কি আমরা বাঁচতে পারব? জানি না, সরকার এ বিষয়ে অবহিত কি না। বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে বিবেচনা হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করছি। এর আগে হাইকোর্ট থেকে রুল জারি করা হয়েছিল পুকুর ভরাট করা চলবে না। কারণ তাতে মাছের আবাদ তিগ্রস্ত হবে। দেখা দিতে পারে ব্যবহার্য পানির অভাবও। কিন্তু এখন পুকুর কাটার হিড়িকে আবাদি জমির পরিমাণ হঠাৎ করেই অনেক কমে যেতে পারে। আর এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে তে ফসলের উৎপাদনের বিশেষ ঘাটতি।
আমরা আমাদের দেশে শিল্পায়নে যথেষ্ট নজর দিচ্ছি। কিন্তু পাশাপাশি খাদ্যশস্যের উৎপাদনে সেভাবে মনোযোগী হতে চাচ্ছি না। এমন একসময় ছিল যখন শিল্পপণ্য বিক্রি করে খাদ্যশস্য কেনা যেত। কিন্তু এখন খুব কম দেশেই বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপন্ন হতে পারছে। অর্থাৎ এখন আগের মতো বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য ক্রয় করে খাদ্য ঘাটতি পূরণের সুযোগ আর নেই। প্রত্যেক দেশকে তাই মনোযোগী হতে হচ্ছে খাদ্য উৎপাদনে। আগের মতো কোনো দেশই আর ভাবতে পারছে না কলকারখানার অর্থনীতি গড়ে তুলে তার জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারার কথা। তা ছাড়া আমরা বাস করছি একটা বিপজ্জনক বিশ্বে। যেকোনো সময় একটা যুদ্ধ বেধে গেলে বিদেশ থেকে খাদ্য আনা বন্ধ হতে পারে।
আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভি দেখা দিয়েছিল। এর অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল জাপান বার্মা (মিয়ানমার) দখল করে নেয়ার ফলে বার্মা থেকে বাংলাদেশে চাল আসতে না পারা। বিদেশের ওপর তাই খাদ্যশস্যের জন্য নির্ভরশীল হয়ে থাকা এখনো আমাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে যথেষ্ট বিপজ্জনক। আমাদের থাকতে হবে ন্যূনতম খাদ্য নিশ্চয়তা। যারা মাছ চাষের জন্য পুকুর কাটছেন, তারা যদি মাছ চাষ করে লাভবান না হতে পারেন তবে পুকুরগুলো পড়ে থাকবে। সেখানে অবিলম্বে আবার সম্ভব হবে না তে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় জমি গড়ে তোলা। পুকুর কাটা যত সহজ হবে, পুকুর ভরাট করা তত সহজ হবে না। ইংরেজ আমলে কৃষক পাট চাষ করে যথেষ্ট লাভবান হতেন। কৃষকেরা তাই চাইতেন ধান আবাদ না করে পাট আবাদ করতে। এতে দেখা দিচ্ছিল ধান উৎপাদনের ঘাটতি। তাই ব্রিটিশ সরকার আইন করে ধার্য করে দেয়া আরম্ভ করে দিয়েছিল কী পরিমাণ জমিতে পাট চাষ করা যাবে। গঠন করা হয়েছিল জুট রেগুলেশন বোর্ড।
মুক্তবাজার অর্থনীতি সব েেত্রই চলতে পারে না। কারণ অর্থনীতির েেত্র যদি খাদ্যশস্যের অভাব ঘটে, তবে দেশে দেখা দিতে পারে দুর্ভি। যেটা আমরা হতে দিতে পারি না। আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে তাই থাকতে হবে ভারসাম্য। মাছ চাষ করতে গিয়ে যদি ধান চাষ তিগ্রস্ত হয় তবে তার জন্য গোটা সমাজ পড়তে পারে ুধার সমস্যায়। মাছ অবশ্য আমরা উপযুক্ত পাত্রে সংরতি করে বিদেশের বাজারে বেচতে পারি। কিন্তু তাতে আমরা কী পরিমাণ লাভবান হবো, তা জানি না। আন্তর্জাতিক বাজারে সামুদ্রিক মাছের চাহিদা যতটা আছে, মিঠা পানির মাছের চাহিদা ততটা নেই। তবে আমরা আমাদের দেশে মাছ খাওয়ার মাত্রা বাড়াতে পারি; যদি আমরা অন্যভাবে বাড়াতে পারি আমাদের মাথাপিছু আয়। কেননা আমাদের মাথাপিছু আয় এখন যে হারে আছে তাকে মাছ কিনবার যথেষ্ট উপযোগী বলে ধরা যেতে পারে না। মাছের দাম খুব কম হলেও তা থাকবে বিরাটসংখ্যক মানুষেরই ক্রয়মতার বাইরে। একসময় আমাদের দেশে খাল-বিলে অনেক মাছ মানুষ ধরে খেতো। এর জন্য প্রয়োজন হতো না কোনো অর্থের। কিন্তু এখন এই ডিপ টিউবঅয়েলের যুগে অনেক জায়গায় নেই সেই আগের খাল-বিল। আমরা আমাদের একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আর একটি সমস্যা করে চলেছি। অবশ্য আমরা যে কেবল এ রকম সমস্যার সৃষ্টি করছি তা নয়, পৃথিবীর নানা দেশেই মানুষ উন্নয়ন করতে গিয়ে সৃষ্টি করছে অনেক সমস্যা। পথঘাট তৈরি করতে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে প্লাবনের মাত্রা।
কৃষি অর্থনীতি খুবই জটিল। আমি আমার ছাত্রজীবনে আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে পড়েছিলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেই সময় যদি শতকরা দুই ভাগ ভুট্টার উৎপাদন বাড়ত, তা হলে ভুট্টার বাজার দর শতকরা চার ভাগ কমে যেত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাই অনেক জমি আবাদ না করে ফেলে রাখা হয়। আর এর জন্য সরকার প্রদান করে ভর্তুকি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাজার অর্থনীতির দেশ হলেও কৃষি েেত্র সে ঠিক বাজার অর্থনীতি মেনে চলেনি। আর এখনো চলছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই কৃষি অর্থনীতি নিয়ে এ যাবৎ হয়েছে সবচেয়ে বেশি আলোচনা। কিন্তু এখনো সে দেশে কৃষিপণ্যের মূল্য যথেষ্ট সুস্থির রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবার মতো যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই। তথ্যের অভাব হয়ে আছে এ েেত্র একটি বড় সমস্যা। যেসব তথ্য আমাদের হাতে আছে তাও কতটা নির্ভরযোগ্যÑ তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। যাহোক, আমরা আলোচনা করছিলাম কৃষিভূমি খনন করে মৎস্য চাষের ব্যবস্থা নিয়ে। এ ব্যাপারে ঔদাসীন্য হয়ে উঠতে পারে নিকট ভবিষ্যতেই আমাদের জন্য যথেষ্ট তির কারণ।
আমাদের অনেক নামকরা অধ্যাপক দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ রার জন্য করছেন আন্দোলন। কৃষিভূমি আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সম্পদ। তারা যদি বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে উদ্যোগী হন, তবে সেটি দেশবাসীর পে অবশ্যই কল্যাণকর হবে। ঢাকা দেশের রাজধানী। সেখানে এ বিষয়ে আন্দোলন সরকারি নীতিনির্ধারণে যথেষ্ট সহায়ক হবে।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

(সূত্র: নয়া দিগন্ত)

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend