দাসত্বের স্বরূপ : আলমগীর মহিউদ্দিন
দাসত্বের স্বরূপ
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন এক অভূতপূর্ব বিস্ময়কর সময়ে বাস করছে। বহুমুখী সঙ্কট, সঙ্ঘাত, নিবর্তন, নির্যাতন ও নিয়ন্ত্রণ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে যেন এটাই স্বাভাবিক। সবাইকে মানতে হবে, সইতে হবে ও গ্রহণ করতে হবে। কোনো প্রশ্ন নয়, আলোচনা নয়, প্রতিবাদ নয়। কোনো যুক্তিই গ্রহণীয় নয়। এমনটি নানা আকারে গত দু’ যুগ ধরে চলছে। এখন তা তুঙ্গে পৌঁছেছে।
সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও একটি ুদ্র গোষ্ঠী আবার পুরো অবস্থাকে উপভোগ করছে এবং এর সুযোগে আর্থিক-ক্ষমতায় উদ্বেলিত হয়ে উঠছে। ক্ষমতাহীন শাসিত গরিষ্ঠের সামান্য প্রতিবাদকেও নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হচ্ছে। নানা অপবাদ দিয়ে নির্মূল করা হচ্ছে। তাই যন্ত্রণাকাতর মানুষ স্তব্ধ।
নাটের গুরুরা কখনো কখনো অবস্থায় বহুমুখিতা আরোপ করে তাদের অনাচারের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাইছে। বিখ্যাত মার্কিন লেখক এরিক পিটারসের মতে এরা ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ (Authoritarian) ব্যক্তি শক্তি যাদের ঘিরে থাকে একদল শকুন যারা শুধু ক্ষমতা ব্যবহার করতে ভালোবাসে। এরা কখনো সত্যিকারের আলোচনা, যুক্তি বা অন্যের অধিকার স্বীকার করে না।
এরা যা ভাবে, করে বা বোঝে সেটাই শুধু গ্রহণযোগ্য। অন্য কোনো আলোচনা বা যুক্তি নয়। তা রাজনৈতিক, সামাজিক বা পারিবারিক বিষয় হলেও। তাই সঙ্কটের ইতি হচ্ছে না। উইনচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক গাই কাকসটন (Guy Claxton) বলেছেন, ‘ক্ষমতাবানরা অধিকাংশ সময় আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ তারা তাদের অধীনস্থদের দাস ভাবতে ভালোবাসে।’ আর সাসেক্স (Sussex) বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জ্যামি ওয়ার্ড (Jamie Ward) বলেছেন, ‘এমন ব্যক্তিরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার শক্তি (Empathy) হারিয়ে ফেলে। কেউ কেউ হত্যা-রক্তপাত ইত্যাদি কর্মকান্ডেই আনন্দ লাভ করে। এরা একধরনের মানসিক রোগগ্রস্ত যাকে বলা হয় এনপিডি (Narcissistic Personality disorder)।’ নারসিসিজমের অর্থ আত্মরতি বা আত্মপ্রেম। এরা অভিনয় করে যেন সবাইকে তারা ভালোবাসে অথচ এদের ছত্রচ্ছায়া সবচেয়ে বেশি অনাচার ঘটে থাকে। এদের ড. ওয়ার্ড সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং বিপদজ্জনক গোষ্ঠী বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এমন ক্ষমতাবানরা প্রায়ই দাবি করবে, এমন শান্তির জীবন কেউই দিতে পারেনি। যারা এর সমালোচনা করছে এবং প্রতিবাদ করছে, তারাই সমাজে ও রাষ্ট্র জীবনে অনাসৃষ্টিকারী।’
এ অবস্থা ভয়ঙ্কর হয় যখন সংবাদ মাধ্যম বা (অধুনা প্রচলিত শব্দ) সুশীল সমাজ নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হয় অথবা বাধ্য করা হয়। কাকসটন বা ওয়ার্ড যেন বাংলাদেশের অবস্থাই মনশ্চক্ষে দেখেছিলেন।
যেহেতু এরা যা ভাবে, করে বা বোঝে সেটাই শুধু গ্রহণযোগ্য তাই আলোচনা নিরর্থক হয়ে পড়ছে। সুবিবেচিত আলোচনা তো নয়ই। এরা এক গ্রিক ব্যামোতে ভুগছে বলে সন্দেহ নেই। এ রোগের জার্মান নাম ‘শাডনফ্রয়াড’ (Sehadenfreude), অর্থাৎ পরের দুর্দশায় আনন্দ। এরা প্রায়ই শাষকগোষ্ঠী হয়, অথবা সমাজের অত্যাচারী বিত্তবানেরা। যেহেতু শাসিত ও নিপীড়িতরা কখনো ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না বা হতে দেয়া হয় না, তাই এ দুর্দশার কোনো শেষ থাকে না। এরাই নির্ধারণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবন ধারণের পদ্ধতি।
এই কর্তৃত্বপরায়ণ গোষ্ঠীর একটি প্রিয় বিষয় হলো, ‘স্বাধীনতা’।
তাদের দাবি তারা যা ভাবে, অনুভব করে সেটাই স্বাধীনতা। এর বাইরের প্রতিবাদী বক্তব্য অগ্রহণীয় এবং সে বক্তব্য প্রদানকারী নির্মূলযোগ্য। কারণ তারা স্বাধীনতাবিরোধী। উল্লেখযোগ্য এই কর্তৃত্বপরায়ণদের মনোভাব বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান।
অবশ্য স্বাধীনতা বিষয়টি মানব ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এর অর্থ ও ব্যবহারও বহুমাত্রিক। কারণ বিষয়টি প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই কর্তৃত্বপরায়ণেরা এ বিষয়ে এত সজাগ। তারা তাদের কর্মকাণ্ডকে স্বাধীনতার প্রধান স্তম্ভ বলে দাবি করছে, অপর পক্ষে নিয়ন্ত্রিতরা একে নিয়ন্ত্রণ ও অত্যাচারের হাতিয়ার বলে অভিহিত করছে। এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ক্ষমতাহীন। ঐতিহাসিকভাবে সত্যিকারের ক্ষমতা ভোগ করে থাকে এক ুদ্র গোষ্ঠী। এরা সুচতুর এবং সমাজের বৃহদংশকে নানা বর্ণিল অনুষ্ঠান, কর্মকাণ্ড চালিয়ে এক ঘোরের মধ্যে রাখে। এরা মেগালোম্যানিয়ায় (Megalomania) ভোগে। নিজেদের সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হিসেবে ভেবে অন্যদের ওপর অনাচার-অবিচারের স্টিমরোলার চালায়। হিটলার ছিল এমন এক ব্যক্তি। এরা বিশ্বাস করে হত্যা, রক্তপাত ছাড়া ক্ষমতা রক্ষা সম্ভব নয়। আবার দেখা যায়, এরা ক্ষমতাসীন থাকলে সর্বস্তরে অভিনয়ের উৎকর্ষতা ঘটে। যেমন এরা নিজেদের দয়ার সাগর, মানবতার প্রতিভু হিসেবে জাহির করে আর মিষ্টি হাসি মুখে লেগেই থাকে।
টেকসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক অধ্যাপক জন মিলার এর নাম দিয়েছেন, ‘ঘৃণার রাজনীতি’ (Politics of Hate)। এই নামে তিনি সম্প্রতি তিনটি নিবদ্ধ লিখেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ‘আজকের (তথাকথিত) প্রগতিবাদী আন্দোলনের উদ্গাতা বামপন্থীরা হলেও, এখন এটাকে দক্ষিণপন্থীরা সমভাবে ব্যবহার করে প্রতিবাদ, বিশেষ করে জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সীমিত বা ছিনতাই করতে।’
তবে সব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য একটিই। প্রভু ও দাসের সৃষ্টি। ক্ষমতাসীনেরা শাসিতদের দাসের চেয়ে অন্য কিছু মনে করতে পারে না। দাসের যেমন কোনো কিছুর অধিকার থাকে না, এমনকি তার মনের ওপর, তেমনি সাধারণ নাগরিকরা শুধুমাত্র দাস। সমাজে বিচরণের জন্যও তাকে পরিচয়পত্র নিয়ে চলতে হয়। ক্ষমতাবানেরা তার গৃহ বা ঘর বাঁধার অধিকারটিও নিয়ে নেয়। তার সন্তান কিভাবে মানুষ হবে, সে অধিকারটুকুও।
কর্তৃত্বপরায়ণেরা বিশ্বাস করে তাদের অধীনস্থদের সব কিছু নিয়ন্ত্রণের অধিকার। এ অধিকারটুকু অন্যেরা ছাড়তে রাজি না হলে, তাদের গৃহহীন থেকে রাষ্ট্রে বসবাসের অধিকারটুকু কেড়ে নেয়া হয়। কারণ স্বাধীনতার ধারক, বাহক, রক্ষক এবং সংজ্ঞাও কর্তৃত্বপরায়ণেরাই নির্ধারণ করে। তাদের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যই শুধু বৈধ। অন্য কিছু অগ্রহণযোগ্য। এর ব্যত্যয় হলে তার জন্য শাস্তি পেতে হবে। তা মৃত্যুও হতে পারে।
কর্তৃত্বপরায়ণেরা তাদের ইচ্ছার প্রতিফলনের জন্য শক্তির ব্যবহার করা তাদের একান্ত অধিকার মনে করে। নানা বর্ণনা ও নাম দিয়ে এর ব্যবহার করা হয়। যেমন এনকাউন্টার করা। লক্ষণীয় এইসব এনকাউন্টারে শুধু প্রতিবাদীরাই নির্মূল হয়। কদাচিৎ কর্তৃত্বপরায়ণদের মানুষেরা আহত হয়। কথিত আছে এগুলোও নাটকের একাংশ। যত দিন এরা ক্ষমতাসীন থাকে তাদের বক্তব্য, কর্মকাণ্ডই কেবল বৈধ। অন্যদেরটা নয়। বলা হয় এ অবস্থা সর্বযুগে, বিশেষ করে অতীতেও ছিল। কথাটি সত্যি। তবে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এর তীব্রতা বেড়েছে। জটিল হয়েছে কর্মকাণ্ডগুলো। যেমন অতীতে শাসকগোষ্ঠীর কোনো নাগরিকের জীবন নিয়ে ভাবতে হতো না। এখন একই কাণ্ড অন্য ঢঙে করতে হয়। ‘জুডিসিয়াল হত্যা’ বলে একটি কথা এখন সুপ্রচলিত। ক্ষমতাবানেরা আদালতকে হুকুম দেয় বিচারের রায়ে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকতে হবে। সম্প্রতি মিসরের উচ্চ আদালত হাজার হাজার মানুষকে ফাঁসি দেয়ার হুকুম দেয় তাদের কোনো বক্তব্য না শুনেই। এমনি ঘটনা তৃতীয় বিশ্বে সাধারণ ব্যাপার। বিশেষ করে নির্বাচিত স্বৈরাচারী শাসনে। এই গোষ্ঠী সবচেয়ে ঘৃণা করে বা নির্মূল করতে চায় নানা কৌশলে ধর্মকে, বিশ্বাস-নির্মিত জীবন ব্যবস্থাকে। কারণ এ ব্যবস্থায় সবাই দাস সেই সৃষ্টিকর্তার। কর্তৃত্বপরায়ণ বলে কোনো অস্তিত্বের স্বীকৃতি এখানে নেই। আর সবার মধ্যে মেলবন্ধনের ভিত্তি হিসেবে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নিয়ম বলে দেয়া হয়েছে। যত দিন সমাজবদ্ধ মানুষগুলো এই ভিত্তির ওপর ঋজু থাকে তাদের জীবনধারণ সহজ, সুন্দর ও আনন্দময় হয়। নিরাপত্তা থাকে নিশ্চিত। সবার মাঝে সম্পর্ক হয় সুদৃঢ়। এ নিয়মে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না, কেউ কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করে না, ছিনিয়ে নেয় না। সন্তান তার পিতামাতা-ভাইবোনের প্রতি ভালোবাসা, কর্তব্যে অবহেলা করে না। নিয়ম ভাঙা (দুর্নীতি) অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তাই অনাচার-অবিচার, নিপীড়ন, অত্যাচার ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়। সেখানে স্থান নেয় নিঃস্বার্থ, সহানুভূতি, সত্যবাদিতা, উদারতা, বদান্যতা। ফলে সমাজবদ্ধ সবার জন্য বয়ে আনে শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা। আর এমন সমাজ জীবন নির্মাণ করে শুধুমাত্র ধর্ম। ইতিহাস তার সাক্ষী। এ জন্যই ধর্ম কর্তৃত্বপরায়ণদের এত ঘৃণার ও আক্রমণের লক্ষ্য।
যুগে যুগে কর্তৃত্বপরায়ণেরা ধর্মকে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে না পারলে একে বিদায় বা নির্মূলের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কখনো প্রগতির নামে, কখনো অন্য কোনো নামে। এখন যেমন মৌলবাদ শব্দটি চালু হয়েছে। কর্তৃত্বপরায়ণরা কেন বিশ্বাসকে ঘৃণা করে? এক কথায়, তাদের নিয়ন্ত্রণকে বিশ্বাস বড় বাধা দেয় বলে।
তবে সব বিশ্বাসকে এরা কখনো একত্রে আক্রমণ করে না। এখন যেমন এককভাবে ইসলামকে এরা প্রতিহত বা নির্মূলের চেষ্টা করছে। এর একটি কারণ এমন হতে পারে। সুন্দর জীবন যাপনের স্পষ্ট চিত্র এখানে যেমন নির্ণিত তেমনটি আর কোথাও নেই। এর ব্যতিক্রমে জীবনটা কত অসুন্দর হতে পারে তা-ও বলে দেয়া আছে। কর্তৃত্বপরায়ণেরা এই চিত্রটি যেন মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারে এবং তারা জীবনে এর অনুশীলন না করতে পারে সে তার চেষ্টায় ইসলামের ওপর এই আক্রমণ।
সবচেয়ে মজার কথা হলো যারা নিজেদের কর্তৃত্বপরায়ণ হিসেবে দেখছে আর অনাচার-অবিচার-অত্যাচার দিয়ে অন্যদের দাস বানাতে চাইছে। তারা নিজেরাও অন্যের দাস। সে দাসত্বের যন্ত্রণা আরো গভীর। তার স্বরূপ শুধু তাদের জানা। তাই ইতিহাসে দেখা যায় এমন কর্তৃত্বপরায়ণেরা নির্মূল হয়েছে নিজেদের বিশ্বস্তদের দ্বারা, প্রায়ই অত্যন্ত করুণভাবে। একপর্যায়ে তারা স্মৃতির অন্তরালেও চলে যায়। তখন দাসত্বের স্বরূপ প্রকাশ হলেও কোনো সাহায্যে আসে না। তবে এর মধ্যে তারা সাধারণ মানুষ, সৃষ্টির শৃঙ্খলা, ধারাবাহিকতায় সাময়িক ছেদ, ছন্দপতন ঘটায়। তাই সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকতে হবে এমন সব ষড়যন্ত্রর বিরুদ্ধে। সকল দাসত্ব বানানোর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছিল কারণ সেখানে মাত্র দু’টি শ্রেণী ছিল- দাস ও প্রভু। এদের মধ্যে আত্মিক বন্ধন না থাকায় সমাজ ভেঙে পড়ে আর বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করতে অক্ষম হয়। এখন যেন বিশ্ব এমনি একটি অবস্থার জন্য প্রস্তুত। আর নির্বাচিত স্বৈরশাসক চালিত দেশগুলিতে এর কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে।
(সূত্র: নয়া দিগন্ত)