আদালতে মাহমুদুর রহমানের ‘আলোচিত’ লিখিত বক্তব্য
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্দেশ্যমূলক নোটিশের জবাব না দেয়া সংক্রান্ত মামলায় চার্জ গঠনের পর গতকাল সোমবার দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আদালতে এক লিখিত বক্তব্য পেশ করেছেন। বক্তব্যে তিনি সরকারের নানা বিষয় সমালোচনা করেন এবং বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
খবর বাংলা২৪.কম পাঠকদের জন্য বক্তব্যটি প্রকাশিত হলো।
সোমবার আদালতের চার্জ গঠনের শুনানি শেষে বিচারক বাসুদেব রায় আসামি মাহমুদুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি দোষী না নির্দোষ?’ জবাবে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমি নির্দোষ তবে আমার কিছু লিখিত বক্তব্য আছে।’ এ সময় মাহমুদুর রহমান তার লিখিত বক্তব্য আদালতে দাখিল করলে আদালত তা গ্রহণ করেন।
বক্তব্যের শুরুতেই বিচারকের উদ্দেশ্যে মাহমুদুর রহমান বলেন, আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অবশ্য চার্জ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে এ জাতীয় প্রশ্ন সম্ভবত: আইনি বাধ্যবাধকতারই অংশ। কিন্তু এটা শেখ হাসিনার সরকারের বাংলাদেশ। আমাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে চার্জ গঠন হয়ে গেলেই বা এই ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে আমার মত বন্দী, অসহায় আমজনতা কী করতে পারতাম?
সর্ববিবেচনায় [একটি অবৈধ ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট লুটেরা সরকার ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের মাধ্যমে আপনার কাঠগড়ায় আমাকে দাঁড় কারিয়েছে।] আমার বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলাটি [প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তারই কার্যালয়ের নির্দেশে দুদক সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে দায়ের করেছে।] শুরু থেকেই এই মামলা Illegal and defective ab-initio। ভোটছাড়া সরকারের অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মার্কিন মুলুকে প্রবাসীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও এদেশের বোদ্ধা নাগরিকদের কাছে দুর্নীতির বরপুত্র রূপে কুখ্যাত জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে একটি বহুজাতিক কোম্পানির নিকট হতে ৫ (পাঁচ) মিলিয়ন ডলার ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তদন্ত-সংক্রান্ত সংবাদ ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়। ক্রোধে উন্মত্ত প্রধানমন্ত্রী আমাকে শায়েস্তা করার জন্য তার কার্যালয় থেকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় আধা-সরকারি পত্র (ডিও লেটার) প্রেরণ করেন। সেই ডিও’র হুকুম মোতাবেক কথিত স্বাধীন দুদক তাদেরই আইন ভঙ্গ ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এই বানোয়াট মামলাটির কার্যক্রম আরম্ভ করে। এতেই প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিভিন্ন বানোয়াট অভিযোগে আওয়ামী সরকার ও সরকার দলীয়রা আমার বিরুদ্ধে এ যাবৎ অন্তত ৭০টি মামলা করেছে।
সিএমএম আদালতের বদান্যতায় রিমান্ডের নামে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে আমাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। দেশে ও বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর সন্ত্রাসী বাহিনী সরাসরি খুনের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে। এ সকল অপকর্মের কথা তারা গণমাধ্যমে স্বীকারও করেছে। ২০১০-১১ সালে এক নাগাড়ে ১০ মাস কারাগারে ছিলাম। গত বছর এপ্রিল থেকেও জেলে এক বছর পার হয়েছে। আটক অবস্থায় বন্দীর অধিকার ন্যুনতম চিকিৎসাও পাচ্ছি না।
একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যতটুকু আইন জানি তাতে প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক কিংবা তার কার্যালয়ের ডিও লেটারের নির্দেশানুযায়ী দেশের কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের কোনো সুযোগ দুদক আইনে নেই। আজকের মামলার ক্ষেত্রে কমিশন আইন লঙ্ঘন ছাড়াও জালিয়াতির মতো ফৌজদারি অপরাধও সংগঠিত করেছে। অতএব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হওয়াই ছিল আইনের শাসন। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, মানবাধিকার নেই, এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে কোনো জনপ্রতিনিধিত্বশীল বৈধ সরকারও নেই।
আমার বিরুদ্ধে দুদক কোনো দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। অভিযোগ এনেছে সম্পদের হিসাব না দেওয়ার। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি যে সম্পূর্ণ সততার সঙ্গে রাষ্ট্র ও জনস্বার্থে আপসহীনভাবে দায়িত্ব পালন করেছি সে ব্যাপারে দেশবাসী বিশেষভাবে অবহিত আছেন। আজকের অবৈধ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মতো আইন ও বিধি-বিধানের অপব্যাখ্যা করিনি। প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ কর্মচারী, কেবিনেট সচিব আমার জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ছিলেন। তার রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাইনি। তাকে কোনোদিন আইনবহির্ভূত কিংবা রাষ্ট্র বা জনস্বার্থক্ষুণ্নকারী নির্দেশ দেইনি। তিনি এখনও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা। আমার বক্তব্য মিথ্যা হলে তাকে সেটি খন্ডনের আহ্বান জানাচ্ছি।
খানিক আগেই উল্লেখ করেছি দুদক আমার বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। সে সম্পর্কেই এবার দু-চারটি কথা। এ বছর ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় এবং পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশে এক ভোটারবিহীন, তামাশার নির্বাচনী নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী ভারতের অনুগ্রহপুষ্ট ক্ষমতাসীনরাই আবারও মসনদ দখল করেছে।
এই লজ্জাকর প্রক্রিয়ায় জনগণ ব্যতীত অন্য সবাই যার যার মত ভূমিকা পালন করেছেন। জনগণ অবহিত আছেন যে বিশেষ লুটেরা গোষ্ঠী রাষ্ট্র ও জনগণের কী অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। ব্যাংক, বীমা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত, বিশ¡বিদ্যালয়, হাসপাতাল, সেতু, জমি, নদী, খাল-বিল, খেলার মাঠ কোনো কিছুই লুটেরাদের অপরিমেয় ক্ষুধার নিবৃতি করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর ভাতিজা ফজলে নূর তাপস রাতারাতি ৪০০ কোট টাকার মূলধনের ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। মাত্র ক’বছরে তার সম্পদ মাত্র কয়েকশ’ গুণ বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অপর আত্মীয় নিক্সন চৌধুরী পদ্মাসেতু গিলে খেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সাঙ্গ-পাঙ্গ, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা সব নতুন নতুন ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। যার এক একটির মূলধন ৪০০ কোটি টাকা। ভারতের বিশেষ স্নেহধন্য মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী গোপালগঞ্জের লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান এবং প্রধানমন্ত্রীর স্নেহভাজনরা বিদ্যুৎ সেক্টর কব্জা করে ফেলেছেন। আওয়ামীপন্থী চিহ্নিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, পরিকল্পনা মন্ত্রী মোস্তফা কামাল গং শেয়ারবাজার থেকে কমপক্ষে সাধারণ বিনিয়োগকারীর লক্ষ কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। রতনে রতন চেনে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অফিসিয়াল স্পনসর ভারতের সাহারা গ্রুপ সে দেশের শেয়ার মার্কেট লুটপাটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেই সাহারা গ্রুপের বাংলাদেশি অংশীদারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আত্মীয়ই। (সাম্রাজ্যবাদী ভারতের সাম্প্রদায়িক শাসকশ্রেণির পদতলে শায়িত সরকারের রাজনৈতিক হয়রানির হাতিয়ার দুদক কেবল আমার কাছেই নয়, বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের কাছেই হিসাব চাইবার ন্যূনতম নৈতিক কিংবা আইনগত অধিকার রাখে না।
মামলার কার্যক্রম অবশেষে যেহেতু আদালতে পরিচালিত হচ্ছে তাই সর্বশেষ আদালত সম্পর্কে সামান্য কিছু বলা প্রয়োজন। শেখ হাসিনার আজ্ঞাবাহী, রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আদালতের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গী সুবিদিত। দীর্ঘ ১৩ মাস বিনাবিচারে, অন্যায়ভাবে জেলে বন্দি থাকলেও আদালতের প্রতি আস্থা না থাকায় আজ পর্যন্ত আমি জামিনের আবেদন করিনি। বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রকে গলা টিপে মেরে ফ্যাসিবাদি, একদলীয় শাসন কায়েম ও মানবাধিকার অবলুপ্ত করে জলুমবাজ পুলিশি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এক শ্রেণির ‘মহা সম্মানিত’ বিচারপতিরাই দায়ী। এই আদালতের স্বাধীনতার কোনো অলীক কল্পনা নিয়েও আমি এখানে মামলা লড়তে আসিনি। মামলা লড়ছি প্রধানমন্ত্রীসহ এই বানোয়াট মামলায় সকল সংশ্লিষ্টদের মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াসে।
মামলা লড়ছি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং দুদক’র বিবেক বিবর্জিত ও অসৎ কর্মকর্তাদের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাংলাদেশে আইনের মুখোমুখি করবার প্রত্যাশায়। এবং এতটুকু আশা নিয়ে মামলায় আংশ নেব যে একসময় জাতির বিবেক জাগ্রত হবে ও তারা জালিমকে প্রতিহত করতে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসবেন।
আমার বিরুদ্ধে দুদক উত্থাপিত অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা, মামলার পুরো প্রক্রিয়া Illegal and defective ab-initio এবং আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আদালতের কাছে চার্জ গঠনের পরিবর্তে মামলা খারিজের আবেদন জানাচ্ছি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতেতে সংযুক্ত থাকার অপরাধে সকল সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশের প্রত্যাশা করছি।
একজন বিশ্বাসী হিসাবে আশা করি, ইহকালে তো বটেই সেই সঙ্গে পরকালে মহান আল্লাহতায়ালা এই জালিমের হিসাব গ্রহণ করবেন। বাংলাদেশে বিচার বিভাগের মান নিয়ে দেশে-বিদেশে নেতিবাচক চর্চা হচ্ছে। মাত্র কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রখ্যাত সংস্থার জরিপে বিশ্বের ৯৯টি রাষ্ট্রের মধ্যে ফৌজদারি মামলার বিচারের মান বিবেচনায় বাংলাদেশ ৯৫তম স্থান লাভ করেছে। জাতি হিসেবে এ আমাদের পরম লজ্জা।
মাননীয় আদালত, আশা করি আমার বিরুদ্ধে দুদক দায়েরকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়রানিমূলক, বানোয়াট মামলায় ন্যায়বিচারের মাধ্যমে এ দেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখবেন।
আমার মেরুদন্ডের অধিকাংশ হাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। কাঁধের ও হাড়ের একটি ছোট, অস্বাভাবিক বৃদ্ধির যন্ত্রণায় ক্রমেই কাতর হয়ে পড়ছি। দেখতেই পাচ্ছেন elbow bag লাগিয়ে আদালতে হাজির হতে হয়েছে। আপনার নির্দেশে জেল কর্তৃপক্ষ পিজিতে পাঠাতে বাধ্য হলেও সেখানকার ডাক্তার নামধারী দলবাজরা চিকিৎসা না করেই ফিরিয়ে দিয়েছে এই আশায় যে আমার ডান হাত পঙ্গু হয়ে গেলে জালিমদের অপকর্ম এবং বাংলাদেশকে ভারতীয় উপনিবেশে রূপান্তর করার প্রতিবাদে আর কলম ধরতে পারব না।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি দখলদাররাও ভিন্ন মতাবলম্বীর উপর এতটা অত্যাচার নির্যাতন চালায়নি যার শিকার আমি হয়েছি। আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার মূহূর্ত পর্যন্ত শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেও জালিম শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে প্রতিবাদ করবো, স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তুলবো, বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণকে তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দিকে আহ্বান জানাবো। আপনার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এই আমার অঙ্গীকার।
সূত্র- আমার দেশ