নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি কোন দিকে : মতিয়ুল নিয়ন
মতিয়ুল নিয়ন
গুম, খুন আর অপহরণের জনপদখ্যাত নারায়ণগঞ্জ আবারো আলোচনার কেন্দ্রে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন এ নগরীতে হত্যা, ধর্ষণ বা অপহরণের ঘটনা ঘটছে না। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না এসব অপরাধ। আর সব ঘটনাই যে গণমাধ্যমে আসে এবং আমরা জানতে পারি, তা কিন্তু নয়। এছাড়া প্রশাসনের আন্তরিকতা ও সততা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
গত ১৬ এপ্রিল পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে দিন-দুপুরে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সার দেশের ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। দেশের বিশিষ্টজনরা তাকে উদ্ধারে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। ৩৫ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পর অপহরণকারীরা ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে ঢাকার মিরপুর এলাকায় তাকে ছেড়ে দেয়।
সৌভাগ্যক্রমে আবু বকর অক্ষত ফিরে এসেছেন। প্রতিদিনই ঘটছে খুন, ধর্ষণ, গুম এবং অপহরণ ও তারপর মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনা। সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে একযোগে অপহরণ করা হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় গাজীপুর থেকে নজরুলের গাড়ি উদ্ধার করে পুলিশ। আর বুধবার দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নজরুলসহ অপহৃত ছয় জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
প্রশ্ন উঠেছে, নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাস আর অপরাধ জগৎ কার নিয়ন্ত্রণে? কার এবং কোন মহলের ছত্রছায়ায় ঘটছে এসব? এটা পানির মতো পরিষ্কার যে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো অপরাধীই চলতে পারে না। তাহলে কি বহিরাগত সন্ত্রাসীরা সেখানে অবস্থান করে এসব কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে? তাহলে তারা কার প্রশ্রয়ে? এসব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সবারই জানা। হয়তো কেউ মানতে বা স্বীকার করতে চান না প্রকাশ্যে।
গত ২৭ এপ্রিল প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছিলেন শামীম ওসমান। কিন্তু কি আশ্চর্য, তার জিডির কথা কারো কাছে প্রকাশ করেনি পুলিশ। দু’দিন পর ২৯ এপ্রিল বিষয়টি জানতে পারেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান পরিবারের প্রভাব আর ক্ষমতা নিয়ে যারা ওয়াকিবহাল তারা নিশ্চয়ই ঘটনার শানেনুযুল খুঁজে পাচ্ছেন না।
স্বাধীনতার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি পরিচালিত হয়ে আসছে দুই পরিবারের রেষারেষিতে। ধারাবাহিকভাবেই এখন একদিকে আছেন সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী অপরদিকে ওসমান পরিবার। যে পরিবারের হাল ধরেছেন শামীম ওসমান, নাসিম ওসমান আর সেলিম ওসমান। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জের গডফাদার হিসেবে মানুষ শামীম ওসমানকেই বেশি সম্ভ্রম করে!
বলা বাহুল্য, রাজনীতিতে পেশীশক্তির সঙ্গে মেধার অপূর্ব সমন্বয় করতে পারলে যে কোনো নেতাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারেন। বলতে হয়, এ সমীকরণে কিছুটা পিছিয়ে শামীম ওসমান। তিনি যতটা না পেশীশক্তির অধিকারী ততটা কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তার নেই। আর সে অভাব পূরণ করছিলেন তার ভাই জাতীয় পার্টির নেতা নাসিম ওসমান। তার প্রভাবেই শামীম ওসমানের ক্ষমতা অসীম হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু কি দুর্ভাগ্য! শামীম ওসমান জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করার তিনদিনের মাথায় বুধবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন তার অভিভাবকতুল্য ভাই নাসিম ওসমান। কিছুটা অন্যভাবে বলা যেতে পারে- বাস্তব জীবনের ‘দৌড়ানি’ থেমে গেছে ওসমান পরিবারের।
ওসমান পরিবারের শক্তিশালী রাজনৈতিক খুঁটি হিসেবে চিহ্নিত নাসিম ওসমানের মৃত্যুতে শামীম ওসমান কতটা দুর্বল হবেন তার ওপরেই নির্ভর করছে আগামীর নারায়ণগঞ্জ। তবে রক্তাক্ত এ জনপদে সাধারণ মানুষকে আরো কতো অশ্রু বিসর্জন করতে হবে তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপরেই। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন শামীম ওসমান। আর বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন সেলিনা হায়াত আইভি। এর দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন শামীম ওসমান। সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকার পরও আওয়ামী লীগ বারবার শামীম ওসমানের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর এই পৃষ্ঠপোষকতা বরাবরই ব্যাখ্যাতীত থেকে গেছে। সুতরাং এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই।
সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য খ্যাত নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর ত্বকি হত্যার পর পুরো জনপদের মানুষ আবেগআপ্লুত হয়ে কেঁদেছে। জীবনের বিনিময়ে হলেও সন্ত্রাস নির্মূল করতে চেয়েছে। ত্বকির মৃত্যুতে যে দীর্ঘশ্বাস পড়েছে তা কিন্তু হতাশায় পরিণত হয়নি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বড় সাহসও নিয়ে এগিয়ে এসেছে সবাই। ত্বকি হত্যা মানুষকে পেছনে নয়, সামনে চলার প্রেরণা দিয়েছে।
আমরা সবই সহ্য করতে পারি কিন্তু আগামীর নিষ্পাপ স্বপ্ন আর সুন্দর সম্ভাবনাকে কেউ নির্মমভাবে গলাটিপে হত্যা করুক এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। ত্বকিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়াটা আমরা কোনোভাবেই মানতে পারিনি। ত্বকির বাবার জীবনবাজি রাখা সাহস তাই রক্তাক্ত ভীতসন্ত্রস্ত এ জনপদে কিছুটা হলেও আশার আলো ছড়িয়েছে।
সাধারণ মানুষের প্রবল প্রতিরোধের ভাষা অনেক বড় শক্তিকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে পারে। তেমনি সন্ত্রাস, ধর্ষণ, খুনের লীলাভূমি হিসেবে যারা নারায়ণগঞ্জকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা কিন্তু এখন প্রবল শুভশক্তিকে ভয় পেতে শুরু করেছে।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, কোনো অমানবিক শক্তি আর সন্ত্রাস মূলধারার রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে বেশিদিন টিকতে পারে না। যারা দেশপ্রেম আর জনকল্যাণে রাজনীতি করেন তাদের কখনও এমন রিজার্ভ অপশক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ আর দমাতে অকুণ্ঠ জনসমর্থন আর ভালোবাসাই একটা রাজনৈতিক দলের জন্য যথেষ্ট।
আজ যেসব রাজনৈতিক দল নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাসের লীলাভূতিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো রকমভাবেই প্রতিরোধের চেষ্টা করেনি তাদের জবাবদিহি করার সময় আসছে। রাজনীতি মানুষের জন্য, ত্বকির মতো জীবন কেড়ে নেয়া কোনো রাজনীতি হতে পারে না।
গণতন্ত্র কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ কণ্ঠের দাবিকে মেনে নেয়ার মধ্যেই নিহিত। চোখ বন্ধ করে হাজারো মানুষের চাওয়াকে উপেক্ষা করে কোনো বিশেষ মহলকে কাছে রাখা কোনো রাজনীতি হতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের এটা নতুন করে উপলব্ধি করা উচিৎ।
নারায়ণগঞ্জের দুই পরিবারের রাজনীতি এখন ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে। সেখানে কোনো মানুষই নিরাপদ নয়। হয় এ পক্ষে, নয়তো ও পক্ষে। যদি কোনো পক্ষেই তুমি না থাক, তাহলে তোমাকে মরতে হবে। এটাই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ত্বকির মতো নিষ্পাপ মেধাবী ছেলেটিকে হত্যার মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে- আগামী প্রজন্ম সেখানে নিরাপদ নয়। যারা আজ জন্ম নিচ্ছে তাদের বোনের সম্ভ্রম, ভাইয়ের রক্ত মাড়িয়ে নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে। তাদের হাঁটতে হচ্ছে নিকশ অন্ধকারের পথে।
আমরা আমজনতা জটিল রাজনীতি বুঝি না। পেশীশক্তির মূলে যে মুখোশধারী রাজনীতিকরা কলকাঠি নাড়েন সেটাও বুঝি না। তবে আমরা কিন্তু ভণ্ডামিটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারি। তাই রাজনৈতিক ভণ্ডামি নয়, আসুন মানুষের কাতারে, ঘর্মাক্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান।
নারায়ণগঞ্জের মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়। প্রকাশ্য রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া বাবা, স্বামী বা ছেলেকে শীতলক্ষ্যায় লাশ হিসেবে ফেরত পাওয়ার আশা করে না কেউ।
লেখক: সাংবাদিক