ভূরাজনীতি ভারতের পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতি

ভূরাজনীতি  ভারতের পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতি

যশবন্ত সিং

ইনডিয়া গেট

এ মাসেই শেষ হবে ভারতের ম্যারাথন নির্বাচন। মাসের শেষের দিকে একটি নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। নির্বাচন নিয়ে যেসব জনমত জরিপ করা হয়েছে, সেগুলো সঠিক হলে সেই সরকারের নেতৃত্ব দেবে বিজেপি, আর বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলেন নরেন্দ্র মোদি।
নির্বাচনী প্রচারণায় ভারতের অর্থনৈতিক মন্দা প্রাধান্য পেয়েছে। নতুন সরকারের কেমন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা উচিত, এ প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। এ ক্ষেত্রে একটি পরিষ্কার তাগিদ হলো, ভারতকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জোটনিরপেক্ষ কূটনীতি থেকে যে সমস্যা তৈরি হয়, তার একটা উত্তম প্রতিফলন ঘটেছে সম্প্রতি রাশিয়ার ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তকরণের পক্ষে ভারতের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের ছদ্ম-অনুমোদনের ঘটনায়। চীনও যে ভারতীয় ভূখণ্ড পেতে চায়, এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও তাঁর সরকার দৃশ্যত উপেক্ষা করে। রাশিয়া ক্রিমিয়া নিয়ে নেওয়ায় চীন হয়তো খুশি হয়েছে, কারণ এর মধ্য দিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো যে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিবেশী দেশের ভূখণ্ড কেড়ে নিতে পারে। সেই ১৯৮০-র দশক থেকে ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি যেন একটা অটোপাইলটের সাহায্যে চলছে, যখন ভারত প্রায় সব সময়ই রাশিয়াপন্থী অবস্থান নিয়েছে।

সত্য হলো, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে ভারত কখনোই দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। ১৯৬২, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধই তার প্রমাণ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে ভারতের জন্য যে শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে জোটনিরপেক্ষ কূটনীতি কোনো কাজে লাগেনি; কাজে লেগেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন। একইভাবে ১৯৯৯ সালে কারগিলে পাকিস্তানের আগ্রাসনের অবসান ঘটাতেও জোটনিরপেক্ষ কূটনীতি কোনো কাজে লাগেনি, সে জন্য ভারতকে নির্ভর করতে হয়েছে আমেরিকার হস্তক্ষেপের ওপর।

জোটনিরপেক্ষ কূটনীতির এই যখন ইতিহাস, তখন কীভাবে আশা করা যায় যে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সেই পুরোনো কূটনীতিই কাজে লাগবে? বিশেষত যখন ভারতকে ঠেকাতে চীন ও পাকিস্তান একজোট হচ্ছে?

ভারতের শান্তি-স্থিতিশীলতার প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি রয়েছে তার সীমান্তগুলোয়, বিশেষত হিমালয় অঞ্চলে চীনের সঙ্গে সীমান্তে। এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম বিরোধপূর্ণ সীমান্ত। সেখানকার অনিশ্চয়তা সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলোর প্রবেশের ক্ষেত্রে সহায়ক হচ্ছে, যারা ভারতে ভূখণ্ডগত ঐক্যহানি ঘটাতে চায়; জাতিগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-বিরোধের বীজ বপনও চলছে। পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভারতকে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করে আসতে হচ্ছে; কিন্তু এখন এই সমস্যা প্রভাবিত করছে আফগানিস্তান, চীন, পাকিস্তানসহ পুরো অঞ্চলকেই।

আর ইসলামি জঙ্গিবাদ যখন ভারতীয় সীমান্তের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আরব বিশ্বের বিপর্যয় মোকাবিলার দায়িত্ব অন্যদের ওপর ছেড়ে দিয়ে ভারত আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না। বরং সেখানে ভারতকে অবশ্যই একটি সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। এর অর্থ, ভারতকে নতুন নতুন কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তুলতে হবে। সন্ত্রাসবাদীরা যেমন বহুমুখী আক্রমণের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, তেমনই তাদের মোকাবিলা করার জন্য যেসব দেশ তাদের দিক থেকে হুমকির মুখে আছে, তাদেরও বহুমুখী প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে হবে।

ভারতকে প্রথমত যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কে বরফ গলাকে স্বাগত জানাতে হবে এবং তা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। ওই দুটি দেশই যেহেতু ভারতের বন্ধু এবং যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ভারতের অনেক অভিন্ন কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে, সেহেতু কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সহযোগিতার দুয়ার খুলতে প্রয়োজন ভারতে একটি করিতকর্মা সরকার।

ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ভিয়েতনামের সমন্বয়ে একটি কৌশলগত জোট সহজেই গঠন করা যায়। এর কোনো শরিকের জন্য চীন বা অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি না করেই এ জোট গঠন করা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নবায়নের জন্যও ভারতের সক্রিয়ভাবে কাজ করা উচিত, এ অঞ্চলকে চীনের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না।

পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ইসলামি জঙ্গিবাদের যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সে ব্যাপারে ভারতকে অবশ্যই চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কৌশলগত বোঝাপড়া গড়ে তুলতে হবে। এই বোঝাপড়ায় পৌঁছানো অবশ্যই কঠিন, কারণ আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারত, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। তা সত্ত্বেও একধরনের বোঝাপড়া সম্ভব এবং তা জরুরিও বটে; কারণ, আফগানিস্তানে আবার গৃহযুদ্ধ বেধে যাক কিংবা দেশটি আবারও সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিতে পরিণত হোক—এটা কেউই চায় না, এমনকি পাকিস্তানও নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা ও অংশীদারত্বও এগিয়ে নিতে হবে ভারতের পরবর্তী সরকারকে। সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ভারত-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পরিচালিত হয়ে এসেছে ট্রান্স-আটলান্টিক ও ট্রান্স-ইউরেশিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে; ট্রান্স-প্যাসিফিক দৃষ্টিকোণ উপেক্ষিত হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমে পাকিস্তান দ্বারা রুদ্ধ ভারত বাণিজ্যিক ও কৌশলগত অংশীদারত্বের লক্ষ্যে ক্রমেই বেশি করে পূর্বমুখী হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা অন্বেষণের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত মধ্য এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে এক অভিন্ন অবস্থান খুঁজে পেতে কাজ করতে পারে।

পাকিস্তানের ব্যাপারে বলতে হয়, ভারতের জোটনিরপেক্ষ কূটনীতি-তাড়িত নিষ্ক্রিয়তার কারণে ভারতকে কৌশলগতভাবে বিচ্ছিন্ন করতে তার এই প্রতিপক্ষ দেশটির সুবিধা হয়েছে। এটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার, কারণ এ অঞ্চলের সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান এবং দুঃখজনকভাবে দেশটি এখন নিজের পেটে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদীদের শিকার।

আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে চলে গেলে এই পুরো অঞ্চলের জন্যই সমস্যা সৃষ্টি হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার স্থলবাহিনী ফেরত নিয়ে গেলেও ইসলামি জঙ্গিবাদের দিক থেকে আমেরিকার ওপর যে হুমকি আছে, সেটা উপেক্ষা করতে পারবে না। সে কারণেই বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমননীতির ক্ষেত্রে সাফল্য নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই আরও বেশি করে ভারতের মতো দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল হবে। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্ব সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের থেকে অনেক অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে সামরিক, শিল্পগত ও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি (মহাশূন্য প্রযুক্তিসহ) হস্তান্তরের পরিষ্কার পন্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মার্কিন-ভারত সহযোগিতার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সব পদক্ষেপেই থাকতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমাদর। লক্ষ্যগুলো হতে হবে দ্ব্যর্থহীন, বাস্তবসম্মত ও অর্জনযোগ্য। উভয় সরকার যদি পরস্পরের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও শ্রম ব্যয় করে, তাহলে পৃথিবীর বৃহত্তম দুই গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে এমন সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়া ও এর বাইরেও শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম।

ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

যশবন্ত সিং: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী; জিন্নাহ: ইন্ডিয়া—পার্টিশন-ইন্ডিপেন্ডেন্স গ্রন্থেরলেখক।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend