প্রাথমিক শিক্ষা : ওরা কেন পড়বে? কেন শিখবে? মুনির হাসান
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।’
রাজা শুধাইলেন, ‘ও কি আর লাফায়।’
ভাগিনা বলিল, ‘আরে রাম!’
‘আর কি ওড়ে।’
‘না।’
‘আর কি গান গায়।’
‘না।’
‘দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়।’
‘না।’
রাজা বলিলেন, ‘একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।’
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হু করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল।
[তোতা কাহিনী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।]
২০০৯ সালে কোনোরকম গবেষণা, সম্ভাব্যতা এবং ফলাফলের তোয়াক্কা না করে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ওপর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী নামে একটি অদ্ভুত পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, এর ফলে শিক্ষার শনৈঃশনৈঃ উন্নতি হবে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল যখন ছাপা হয়, তখনই আমরা জানতে পারি আমাদের প্রায় সব শিক্ষার্থীর মেধা আর মননের প্রভূত উন্নতি হচ্ছে। প্রতিবছরই জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে বৈকি। তবে শিক্ষার সামগ্রিক উদ্দেশ্য তো কেবল জিপিএ-৫ পাওয়া নয়। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের ভিত্তি মজবুত হচ্ছে তো? বিশ্বগ্রামের নাগরিক হিসেবে তারা তাদের বৈশ্বিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারবে তো?
প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের তথ্য দেখে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের শিখনফলের ওপর বিশ্বব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যাদির ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো, গত ৯ মার্চ ২০১৪ তারিখে। ‘প্রাথমিকে ৭৫% শিক্ষার্থী ভালোভাবে শিখছে না’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভেদে শতকরা ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী ভালোভাবে শিখছে না। তার পরও অনেকে ওপরের শ্রেণীতে উঠে যাচ্ছে। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বাংলাও ভালোভাবে পড়তে পারে না। গণিত ও ইংরেজির অবস্থা আরও খারাপ। এ কারণে শিশুদের ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মূল্যায়ন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন এবং একাধিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রাথমিক শিক্ষার এই চিত্র অজানা নয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার সুবাদে আমি প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল কম্পিউটারায়ন ও প্রকাশের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলাম। তখনো প্রাথমিক শিক্ষার এই করুণ চিত্র দেখেছি। ভেবেছিলাম সরকার বাহাদুর যখন নতুন পরীক্ষাপদ্ধতি প্রচলন করেছে, তাহলে নিশ্চয়ই সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। পরিস্থিতি যে আরও খারাপ হয়েছে, সেটা খোদ প্রাথমিক শিক্ষারমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট। প্রথম আলোর একই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কম্পিউটার কাউন্সিল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, তিনি তাঁর এলাকার কয়েকটি বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে পারেন, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে অথচ ইংরেজি বইয়ের নাম বানান করে বলতে পারে না একাধিক শিশু।’
প্রাথমিক শিক্ষার এই করুণ দশার অনেক কারণ আছে। তবে নতুন যে উৎপাতটি এই হারকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, সেটির নাম প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। পঞ্চম শ্রেণীর কোমলমতি শিশুদের অন্য স্কুলে পাঠিয়ে তারা কতটা মুখস্থ করতে পারছে, সেটি দেখার একটি অদরকারি পদ্ধতির নাম হলো প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার সব উদ্দেশ্য এখন এসে দাঁড়িয়েছে ওই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার মধ্যে। গণিত অলিম্পিয়াডের কারণে সারা দেশে ঘুরে আমি যে চিত্রটি দেখি তা হলো তৃতীয় শ্রেণী থেকেই অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে উঠেপড়ে লাগেন। শুধু যে অভিভাবকেরা বা শিক্ষকেরা এই যুদ্ধে নেমে পড়েছেন, তা নয়। এখন আমাদের দেশের প্রায় সব মুদ্রিত সংবাদপত্রে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য আলাদা শিক্ষা পাতা প্রকাশ করে। সব পত্রিকা জানুয়ারি মাস থেকেই পাতাজুড়ে ছাপতে থাকে—প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা প্রস্তুতি!!! যেন বা পরীক্ষায় ভালো করাটাই শিক্ষার্থীর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য! আর আমাদের স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাগুলোতে কেবল শিক্ষার্থীর লিখে প্রকাশ করার ব্যাপারটাই মুখ্য। অন্যান্য দক্ষতার কোনো খোঁজ নেওয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীদের শেখা বা জানার কোনো আগ্রহ তৈরি হয় না, তাদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা হয় না। শিক্ষাবছরের শুরু থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর মাথায় ঢোকানোর জন্য নানা কসরত করানো হয় মাত্র।
প্রতিবেদনে যেসব শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ করা হয়েছে, তাদের সবারই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর ফলাফল অসাধারণই হওয়ার কথা। কারণ, ফলাফলে চমৎকার উন্নতি তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার ভিত্তি। সেখানে ফাঁকি দিলে সামনের দিনগুলো মোটেই ভালো হয় না। ওই প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাথমিকের এ দুর্বলতা মাধ্যমিকে গিয়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অষ্টম শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে (যথাক্রমে ৫৬, ৫৬ ও ৬৫ শতাংশ) নির্ধারিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, গণিতে খারাপ হওয়ার কারণে অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশ্বব্যাপী গবেষণায়ও দেখা গেছে, পনেরো বছর বা এর চেয়ে বেশি বয়সের স্কুল পাস করাদের অঙ্কের পারদর্শিতার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃত্তির ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে।”
মাতৃভাষা, আন্তর্জাতিক ভাষা আর বিজ্ঞানের ভাষা—তিন-তিনটিতেই দুর্বলতা নিয়ে আমাদের উত্তর প্রজন্ম কীভাবে বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা হয়ে উঠবে? সারা বিশ্বের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এখন হয়ে উঠেছে জ্ঞান, নলেজ। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে তাই জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। আর কেবল মানসম্মত শিক্ষাই সেটি নিশ্চিত করতে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে সমাদৃত শিক্ষাব্যবস্থার একটি হলো ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো পাবলিক পরীক্ষায় বসতেই হয় না। চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষায় চরম সাফল্যের বৈতরণি পার হয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তখন তাদের মাথায় কেবল পরীক্ষাই ঘুরতে থাকে। সেমিস্টারের প্রথম দিন সিলেবাস, সহায়ক বই আর অ্যাসাইনমেন্টের বিষয়গুলো বোঝানোর পর যখন শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না, তখন তারা সমস্বরে জানতে চায়, ‘স্যার, পরীক্ষার প্রশ্ন কেমন হবে?’
অহেতুক পরীক্ষার এই প্রবল সংস্কৃতি থেকে যত দিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করা যাবে না, তত দিন জ্ঞানভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
মুনির হাসান: যুব কর্মসূচি সমন্বয়কারী, প্রথম আলো ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।