অপহরণ, গুম, খুন সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত
ড. মীজানূর রহমান শেলী
অপহরণ, গুম ও খুনের সংখ্যা ও ব্যাপকতা নিয়ে সম্প্রতি সারাদেশে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। মহামারির সময় যেমন হয়, তেমনি এক ভয়াবহ আতঙ্ক সচেতন ও শিক্ষিত সমাজকে বিশেষ করে নাড়া দিয়েছে। সাধারণ মানুষও যে এতে উদ্বিগ্ন নয় তা নয়। কিন্তু দরিদ্র ও দুর্বলেরা চিরকালই অসহায়। তাই তাদের ফরিয়াদ সমাজব্যাপী সরব হয়ে উঠতে পারে না। অবশ্য মুদ্রিত ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কর্মতত্পরতায় হাল আমলে অর্থনৈতিক, শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অনেকেরই কথা মানুষ জানতে পারে। সেকথা যে করুণ এবং মনকে সহজেই বিচলিত করে সে সম্বন্ধে কোনই সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যমেই যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক সকল মহলেই উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। গত এক যুগের পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে এমনটি না হওয়ার কথা নয়। দৈনিক ইত্তেফাকের গতকাল ৩০ এপ্রিলের এক প্রধান প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, “গত ১২ বছরে দেশে ১০ হাজার ১৬১ জন অপহরণ ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন। তার মধ্যে ৩০০ জনের লাশ পেয়েছে তাদের স্বজনরা। উদ্ধার হয়েছে ২৫০০ জন। বাকি প্রায় ৭০০০ হতভাগ্যের এখনো খোঁজ পায়নি তাদের স্বজনরা। এসময়ে অপহরণ ও গুমের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে গ্রেফতার হয়েছে তিন সহস্রাধিক ব্যক্তি। র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে”।
একই প্রতিবেদনে বলা হয় যে, “এসব ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা ও সাধারণ ডায়রি করে থাকেন স্বজনরা। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও স্বজনরাই এসব ঘটনায় থানাকে অবহিত করে। তবে এদেশের তুলনায় অন্যান্য দেশে এসব অপরাধের হার কম। নিরাপত্তা বাহিনীর সাফল্যের হারও বেশি। সেসব দেশে দ্রুত এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী অপহরণ, গুম কিংবা নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হচ্ছে”।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা যতই দাবি করুন না কেন যে, তাদের সাফল্যের হারও দেশজ পরিপ্রেক্ষিতে কম নয়। তাদের সার্বিক ব্যর্থতা নিয়ে সমাজ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন, সে নিয়ে সন্দেহ নেই। তাদের ব্যর্থতা ও অসাফল্যের সঙ্গে সাধারণত জড়িত থাকে সেইসব রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকার যারা তাদের তদারকি করে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কথায় বলে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সেই অর্থে যে কোন সময়ে রাজনৈতিক সরকার অপহরণ, গুম ও খুন জাতীয় মারাত্মক অপরাধের অন্তিম দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। বিশেষ করে যেখানে অপহূত বা নিহত ব্যক্তিরা বিরোধী দলের নেতা বা সদস্য, সেসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি এবং সরকারের প্রতি বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকরা সহজেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অন্যদিকে সমাজ বিশেষ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও সরকার বা সরকারি দল সরাসরি এতে জড়িত একথা বিশ্বাস না করলেও মনে করে যে, সরকার তার মূল দায়িত্ব অর্থাত্ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ও জননিরাপত্তার বিধানে অসফল। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা-তা যদি অরাজনৈতিক কারণেও হয়; ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। সেদিক থেকে আজকে যে দল পাঁচ বছরেরও বেশি এবং দুই দফায় দেশ শাসনের দায়িত্বে রয়েছে তার দায়বদ্ধতা অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, ভয়াবহ আতঙ্কময় এসব অঘটনের জন্য শুধু কী এক ধরনের বা একদলের রাজনীতিই দায়ী। অদূর অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দল নির্বিশেষে এমনকি সেনা সমর্থিত নির্দলীয় শাসন আমলেও এই ধরনের অপরাধের সংখ্যা ও পরিমাণ প্রায় একই রয়ে গেছে।
ইত্তেফাকের ৩০ এপ্রিলের প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০০২ সালে ১০৪০ জন এবং পরবর্তী সালগুলোতে গড়ে ৮০০ জন হারে এধরনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে প্রলম্বিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ হার ছিল যথাক্রমে ৭৭৪ ও ৮১৭ জন। আবার নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫৮তে, প্রায় সমান সংখ্যক ঘটনা ঘটে পরবর্তী ৪ বছরে অর্থাত্ ২০১৩ পর্যন্ত।
এ অবস্থায় ধারণা হয় যে, দেশে নির্বাচিত বা অনির্বাচিত যে সরকারই থাকুক না কেন, অবস্থার হেরফের হয় না। রাজা যায়, রাজা আসে, আসে না শুধু প্রজা সাধারণের নিরাপত্তা এবং সুষম সমৃদ্ধি। এটি একটি বিশাল জাতীয় ব্যর্থতা, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ব্যর্থতা কী কেবলই রাজনৈতিক, না তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোন বিশাল সামাজিক অক্ষমতা ও ত্রুটি।
প্রশ্নটি করাই যথেষ্ট নয়। সুচিন্তিত ও সক্রিয়ভাবে এর উত্তরও খোঁজা প্রয়োজন। যেখানে সরকার বদল জনগণের ভাগ্য বদল আনে না, সেখানে সংশয় থাকে। আর সে সংশয়টি রাজনৈতিক শ্রেণি বা political class-এর পরিপ্রেক্ষিত ও পটভূমি সম্পর্কে। সমাজ কোন খণ্ড-বিখণ্ড বা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এটি একটি সম্পূর্ণাঙ্গ একক। সমাজ বিজ্ঞানী ম্যাকাইভার যথার্থই বলেন, “The society is an organic and integrated whole, its various parts are interrelated like that of a clock. Pathology in one causes pathology in others”, উদ্ধৃতিটি স্মৃতি থেকে নেয়া। সুতরাং, খুঁটিনাটি ভুল থাকতেই পারে, তবে মূল বক্তব্যের নির্যাস হলো “সমাজ একটি এক সূত্রে গাঁথা জৈবিক একক। এর অংশগুলো ঘড়ির যন্ত্রাংশের মতই পারস্পরিকভাবে সমন্বিত। তাই এর এক অংশের পীড়া অন্যসব অংশকে রোগাক্রান্ত করে”।
আমাদের সমাজ এই সূত্রের ব্যতিক্রম নয়। এখানেও একটি অংশ সারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একক কিছু নয়। পরস্পর নির্ভর সমাজে শিক্ষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবহার অন্যসব অংশের দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য।
আসলে আমাদের সমাজের যে শাশ্বত মূল্যবোধ তার শুধু অবক্ষয়ই ঘটেনি, ঘটেছে প্রায় অপসারণ বা অবসান। ভালো-মন্দের বিচার প্রায় অবলুপ্ত হতে বসেছে। ইতিহাসের এক অজানা মোড়ে, আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মূল্যবোধের কথা আমাদের সমাজে এক সক্রিয়, অগ্রণী এবং অর্থ-সম্পদ অর্জনে সকল অংশের জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন তেন প্রকারে জাগতিক উন্নতি এবং তার সঙ্গে আত্মিক অবক্ষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের মূলমন্ত্র। এর ফলে দুর্নীতি ব্যাপক ও বিশালভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এমনকি প্রেম-ভালোবাসাও ক্ষেত্র বিশেষে হয়েছে পণ্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষারও ঘটছে বাণিজ্যকরণ। এই অবস্থায় রাজনীতিও যে অর্থ ও সম্পদের কাছে পণ-বন্দী হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর রাজনীতি যদি পণ্যে পরিণত হয়, তবে প্রশাসন তো ব্যাধিগ্রস্ত হতে বাধ্য। এই পটভূমিতে যে দুর্নীতি এতোদিন আড়ালে-আবডালে গোপনে চলাচল করতো তা আজ প্রকাশ্য রাজপথে বুক ফুলিয়ে চলে। নিয়োগ বাণিজ্য প্রশাসনের এক বড় অংশকে পরিণত করে পথভ্রান্ত, মূল্যবোধহীন এক বিকৃত ঠিকাদারে।
এমনই আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে সেই বিষবৃক্ষ যার বিষাক্ত ফল প্রতিকারহীন অপহরণ, গুম, খুন ও নিখোঁজ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা। এই বিষাক্ত স্রোতধারা রোধ করার একমাত্র উপায় সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শীর্ষ শ্রেণীকে এই বিষাক্ত ছোবল থেকে সুরক্ষা করা। চিকিত্সকের চিকিত্সা না হলে রোগীর চিকিত্সা কে করবে?
লেখক :চিন্তাবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিডিআরবি)-র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং আর্থ-সামাজিক ত্রৈমাসিক ‘এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের’ সম্পাদক।