আমিও তো সরকারি এজেন্ট

আমিও তো সরকারি এজেন্ট
মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

সরকার অত্যন্ত সফলভাবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পেরেছে। একটি বিশ্বাস প্রায় সবার মাঝে চাওড় হয়ে আছে, বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী নাকি এখন সরকারের এজেন্ট। বিএনপির অনেক বাঘা বাঘা নেতাকে সাধারণ কর্মীরা এখন বাঁকা চোখে দেখছে। ওই সব নেতার আচার-আচরণ, ভাব-সাব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের বক্তব্য এবং বক্তব্যের সঙ্গে তাদের কাজকর্মের দৃশ্যত অমিল, লোভী মনোভাব ও কার্যকলাপ, কর্মীবান্ধবহীন ও কর্মীদের কাছে বৈরী হওয়া সত্ত্বেও শীর্ষ নেতৃত্ব বা উত্তরাধিকারের বিশেষ আশীর্বাদে (!) দলের বড় বড় পদে আশীন থাকার কারণে ওই সব নেতাকে সরকারের এজেন্ট বানানো সম্ভব হয়েছে এবং তারা যে সরকারের এজেন্ট এটাও সাধারণ নেতা-কর্মীদের সুকৌশলে বোঝানো সম্ভব হয়েছে।

বিএনপি একটি প্রগতিশীল জনপ্রিয় বিশাল রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের এমন কোনো প্রত্যন্ত গ্রাম নেই যেখানে বিএনপির অস্তিত্ব নেই। বিএনপির বিশাল কর্মী বাহিনী, নেতা-কর্মী বা শুভাকাঙ্ক্ষী বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। অথচ বিএনপিতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে নিয়ে নিম্নে গ্রাম পর্যায়ে কোনো একটি কমিটির সভাপতিও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পদায়িত হন না। স্থায়ী কমিটি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটি থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিম্নপর্যায়ের কোনো একটি গ্রাম কমিটিও দলের গঠনতন্ত্র বা রাজনৈতিক নিয়মতান্ত্রিকভাবে সচরাচর গঠিত হয় না। বিএনপির সব পর্যায়ের নেতা নিয়োজিত বা কমিটি গঠিত হয় শীর্ষ নেতৃত্বের চারপাশে ঘিরে থাকা কতিপয় মুখচেনা চাটুকার দ্বারা। এই চাটুকাররা ষড়যন্ত্র করে গভীর রাতে তাদের মনমতো ব্যক্তিদের দিয়ে বিভিন্ন পদে পদায়িত করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বা তার উত্তরাধিকারের ক্ষমতার ব্যবহার বা নাম ভেঙে গভীর রাতে একটি কমিটি ঘোষণা করে দেয়। এখানে দলের গুটিকয়েক ষড়যন্ত্রকারী ও সরকারের এজেন্ট ছাড়া দলের কোন পর্যায়ের নেতাদের পক্ষে কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ নেই। শুধু দলের কমিটি গঠনই নয়, এমনকি দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও স্থায়ী কমিটির সব সদস্যের পক্ষে আলোচনা করে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দ্বিমত করা তো দূরের কথা নীরবে বা চুপ করে থাকাও কঠিন। স্থায়ী কমিটির সভায় সব সদস্যকে পূর্ব থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তকে হা হা বলে কোরাশ গাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এর নূ্যনতম ব্যত্যয় ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের পদ চলে যাবে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা তো বছরের পর বছর হয়ই না। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাস্তবায়নে জাতীয় নেতাদের ভূমিকারও তেমন কোনো সুযোগ নেই। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি দুই বছর অন্তর দলের কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের চেয়ারপারসনসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠনতান্ত্রিকভাবে গঠিত হওয়ার কথা কিন্তু দুই বছর অনেক আগে পার হয়ে গেলেও কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করার মতো সাহস কারও নেই।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ ও পারস্পরিক গ্রহণযোগ্যতা না থাকায় মহাভারতের রামের খড়মকে সিংহাসনে বসিয়ে ভরতের রাজ্য শাসনের মতো তারাও দলের শীর্ষপদে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খড়ম সদৃশ উত্তরাধিকার বানিয়ে বিএনপির চারপাশে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য ‘৭৯ সালে দেশে আরও অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দল থাকার পরও শুধু জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিএনপির একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি ছিল যার উপরে ভিত্তি করে শহীদ জিয়া বিএনপি গঠন করেন। শহীদ জিয়ার স্বপ্ন ছিল বিএনপির গঠনতন্ত্রে উলি্লখিত ১৯ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ার। তাই বিএনপির গঠনতন্ত্রে সদস্য পদের আবেদনে যে কোনো দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিকে বিএনপির সদস্য থেকে সম্পূর্ণভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। আজকে জনগণের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে বিএনপির নেতা-কর্মী হওয়া তো দূরের কথা দলের সাধারণ সদস্য হওয়ার সুযোগ আছে কি না?

বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর নামে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অভিযোগ আসছে তারা অনেকেই নাকি সরকারের এজেন্ট! সরকারের এজেন্ট কথাটি শুনতে খুবই ভাব ভাব লাগে, মনে হয় এজেন্ট ও মন্ত্রী সমার্থক শব্দ। তাই এজেন্ট হওয়ার জন্য অনেকের মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা আছে। সরকারের এজেন্ট হতে পারলে সরকারের মন্ত্রীদের মতো অনেক সুযোগ-সুবিধাও নাকি পাওয়া যায়। ব্যাংক ঋণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নেক-নজর বিশেষ করে পুলিশের কাছ থেকে খুবই মান-মর্যাদামূলক আদর-আপ্যায়ন নাকি পাওয়া যায়। এখন তো আবার বর্তমান সরকারের নতুন রাজনৈতিক ব্যাকরণে বিরোধী দল বলে কিছুই নেই। সবাই সরকারেরই অংশ। গঠনমূলক সমালোচনা করা যাবে কিন্তু সরকারের বিরোধিতা করা যাবে না। একই দলে থেকে কারও ইচ্ছা হলে মন্ত্রী হবে আবার কারও ইচ্ছা হলে সংসদে বিরোধী দলের নেতা বা নেত্রী হবে। কি মজা, আমরা সবাই রাজা আমাদের হীরক রাজার দেশে। এখন সরকার ও বিরোধী দল ভাই ভাই। তাই বিএনপির নেতারাও পিছিয়ে থাকবে কেন? তারা তো সুদূরপ্রসারী চিন্তা করেই নির্বাচন বয়কট করার নিষ্ফল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল! সরকার পালানোর পথ পাবে না বলে বাতাসে হুমকি দিয়াছিল। এখনো যে কোনো সময় সরকারকে ফেলে দেওয়ার হুমকি-ধামকি দিয়েই যাচ্ছে। এখন যদি তাদের হুমকি-ধামকিতে সরকার পড়েই যায় তাহলে আবার নতুন আরেক বিপদ দেখা দেবে! মার্কিনিরা তো একপায়ে দাঁড়িয়েই আছে। তাদের সরকার আসলে তো আবার মামু-ভাগ্নে ও গণগোষ্ঠী সবাইকে তাদের প্রথামতো প্রথমেই জেলে ঢুকাবে, বলা যায় না এবার হয়তো মেরেও ফেলতে পারে। তাছাড়া এবার প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সন্দেহভাজন অনেক মন্ত্রীকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছেন তাতে অনেকের মাঝে নতুন ভীতি সঞ্চার করেছে। বিএনপি যদি তাদের কথা অমান্য করে নির্বাচনে চলে যেত এবং খোদা না করুক (!) ওই নির্বাচনে বিএনপি যদি জিতে যেত তা হলে বিএনপির দুর্র্নীতিবাজ নেতাদের আম-ছালা দুইটাই হারাতে হতো। এখন মন্ত্রী-তন্ত্রী হতে না পারলেও সরকারের এজেন্ট তো হওয়া যাচ্ছে। এতে সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তারা সরকারকে সরকারের অনুমতি নিয়ে গালাগালি ও হুমকি-ধামকি দিতে পারছে এবং বিনিময়ে সরকারও তাদের জেলে নিতে বা প্রয়োজনে জামিন বাতিল করতে পারছে। এর ফলে সরকার যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তাদের মাঝেও সরকারি দল হওয়ার প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারছে এবং এর ফলে মাঝখান দিয়ে বিএনপির বাতিল নেতাদের জনপ্রিয়তা হুর হুর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মামলার ভয় কার না আছে। দুর্নীতিবাজ নেতাদের মহাগুরু এক সাবেক স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি তো মামলার ভয়ে প্রতিদিনই বানরের মতো ডিগবাজি খাচ্ছেন। মামলার ভয়ে সে কখন কি করে তা স্বয়ং ভগবানও বলতে পারবে না। সরকার খুব ভালোভাবেই বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তার উত্তরাধিকারীসহ অনেক বড় বড় নেতাকে মামলার রশি নাকে লাগিয়ে প্রতিদিনই ঘুরাচ্ছে। মামলার এ হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য সরকারের এজেন্ট হওয়াই তো সবচেয়ে বুদ্ধিমান রাজনীতি। আমি নিজেও ১৪টি মামলার আসামি। এখন যদি সরকারের সঙ্গে বীরত্ব দেখাই তাহলে নির্ঘাত আমাকে এই সরকারের সময়টাতে জেলেই কাটাতে হবে। রাজনৈতিকভাবে নিশ্চয় এত অপরিপক্ব নই যে এই সহজ রাজনৈতিক সমীকরণটি বুঝবো না। সরকারের এজেন্ট হয়ে রাজনীতি করব, সুখে এবং নিরাপদে থাকব, মাঝে মাঝে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে জেলে যাব বা জামিন বাতিল হবে কিন্তু তাতে জনপ্রিয়তা বাড়বে, দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ত্যাগী চরিত্র ফুটে উঠবে! সময়ে জনগণ অতীতের সব কুকর্ম ভুলে যাবে, গণতন্ত্রের মানসকন্যারা স্বৈরাচারকে রাষ্ট্রের বিশেষ দূত বানিয়ে জাতির মুখ উজ্জ্বল করার মতো নতুন আরও বড় বড় দায়িত্বও দিতে পারে! তাই জিন্দাবাদ সরকারি এজেন্ট। বিএনপির উপর থেকে নিচে সবারই এখন সরকারের এজেন্ট হয়ে যাওয়াই সর্বোত্তম রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আদর্শের কোনো স্থান নেই এবং কোনো মূল্যও নেই। রাজনীতি এখন অর্থ ও স্বার্থের। বড় দলগুলোর রাজনীতির মধ্যে আদর্শগত কোনো পার্থক্য নেই। রাজনীতি এখন অর্থ এবং বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণে। দেশের পুঁজিবাদী শক্তি, তাদের তাঁবেদার আমলাগোষ্ঠী, রক্ষাকারী পুলিশ এবং বৈধতাকারী স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা আদর্শের ও জনকল্যাণমূলক রাজনীতির সবচেয়ে বড় বাধা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদেশী প্রভাবান্বিত স্বার্থবাদী সুশীল সমাজ। এখানে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা পূরণের কোনো সুযোগ নেই। জনগণ এখানে নিমিত্ত মাত্র। দেশের এখন ভরসার স্থান হলো স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম এবং বিবেকমান সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। ওরাই শুধু দেশটাকে এবং দেশের রাজনীতির রাসটাকে সঠিক পথে টেনে রাখছে। এখন অপেক্ষা শুধু সময়ের কখন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাবে। অপেক্ষা রাত পোহাবার কত দেরি। মনে রাখতে হবে এদের- ওদের দ্বারা হবে না। চার বছর নয় মাসের মাথায় নতুন জীবন চাই- না হলে কিছুই হবে না। আমরা হয়তো থাকব না কিন্তু ওরা থাকবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী)

rtlbddhaka@yahoo.com

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend