শ্রমিক আন্দোলনকে সুবিধাবাদী-চাঁদাবাজ মুক্ত করতে হবে : মনজুরুল আহসান খান
প্রবীণ শ্রমিক নেতা মনজুরুল আহসান খান বলেছেন, মহান মে দিবসের আসল দাবি_ ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রামের বিষয়টি আজো বাংলাদেশে উপেক্ষিত। দেশবাসীকে মহান মে দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির এই উপদেষ্টা বলেছেন, শ্রমিক আন্দোলনকে আত্দশুদ্ধি করে সংগ্রামী ধারায় অগ্রসর হতে হবে। এ জন্য শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে দালাল, সুবিধাবাদ ও চাঁদাবাজদের খপ্পর থেকে মুক্ত করতে হবে। ১৯৬৯ সালে গণঅভুত্থানের মধ্য দিয়ে একবার এই ধরনের দালালদের উৎখাত করা হয়েছিল। আজকের মে দিবসে সৎ-সুস্থ ধারার দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক ও উন্নয়ন সহায়ক বিপ্লবী ধারার ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে শ্রমিকদের শপথ নিতে হবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মনজুরুল আহসান খান আরও বলেন, আজকে ১২৮ বছর পর মে দিবসে দাঁড়িয়ে দেখছি, বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ ১৮৮৬ সালে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আমেরিকা এবং শিকাগো শহরের শ্রমিকরা আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন। রক্ত দিয়েছেন। শ্রমিক আন্দোলনের শুরু থেকেই সারা বিশ্বের শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দাবি ছিল-৮ ঘণ্টা কাজের। মে দিবসের বহু আগে ১৮৬২ সালে কলকাতার হাওড়া রেল স্টেশনের কর্মচারীরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বহুকাল আগে থেকেই আইন অনুসারে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো নিষিদ্ধ। কিন্তু বড় বড় শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলো সড়ক পরিবহন, পোশাকশিল্প, দিনমজুর, ক্ষেতমজুর, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান-কর্মচারী, গৃহস্থালীসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কাজে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টার অনেক বেশি কাজ করতে বাধ্য করানো হয়। এ জন্য বিধান থাকলেও মালিকদের কোনো শাস্তি দেওয়া হয় না। পোশাক শিল্পসহ বেশ কিছু শিল্পে ৮ ঘণ্টা কাজ করার নিয়ম থাকলেও তাদের মজুরি এত কম যে, শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে ওভারটাইম করেন। সিপিবির সাবেক এই সভাপতি বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সব সামরিক-বেসামরিক ও সরকারি কর্মচারীরা মে দিবসে সবেতনে ছুটি পেলেও অধিকাংশ শ্রমিক সবেতন থেকে বঞ্চিত। শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণার এর চেয়ে দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? দেশের শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ৮ ঘণ্টা কাজ, বিশ্রাম, সাপ্তাহিক ছুটি, চাকরির নিরাপত্তা, দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ, নূ্যনতম মজুরিসহ সব কিছুরই বিধান আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। আইন বাস্তবায়নের জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করলে, তাদের ওপর গুলি, হামলা, মামলা, ছাঁটাই ও বরখাস্তের খড়গ নেমে এলেও আইন অমান্যকারী মালিকদের কোনো সাজা হয় না। মনজুরুল আহসান খান বলেন, রানা প্লাজা, তাজরীন, স্পেকট্রাম প্রভৃতি পোশাকশিল্পে যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ হয়ে গেল, সেটা দেশের মানুষ-বিশ্বের মানুষ বুঝতে পারছে যে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কী ধরনের মানবেতর ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে জীবন-যাপন করছে। রানা প্লাজার শ্রমিকদের অনেকেই এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসা পায়নি। পুনর্বাসন তো দূরের কথা। অথচ পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচার করা হচ্ছে, দেশ-বিদেশের অনেকেই শ্রমিকদের জন্য সব কিছু উজাড় করে দিচ্ছেন। কোটি কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হচ্ছে। দেওয়া হয়েছে কথাটা মিথ্যা নয়। প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, পোশাক শিল্পের মালিক সমিতিগুলো দিয়েছে, যেসব বিদেশি কোম্পানি রানা প্লাজার পোশাক কারখানা থেকে পণ্য কিনত তাদের কেউ কেউ এবং কিছু এনজিও (বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা) টাকা দিয়েছে। কিন্তু কে, কোন শ্রমিককে, কী বাবদ, কত টাকা দিল তার কোনো হিসাব নেই। রানা প্লাজা তহবিলে কে কত টাকা তুলেছে, তার কোনো হিসাব নেই। তিনি আরও বলেন, রানা প্লাজা গার্মেন্ট শ্রমিক ইউনিয়ন এবং অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। শ্রমিকরা দাবি করেছে, শ্রমিকদের তালিকায় কাকে কত দেওয়া হয়েছে, তার হিসাব গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হোক। রানা প্লাজা ধসে আসামিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত চার্জশিট দাখিল করা হয়নি। এভাবেই আজ মালিকপক্ষ-সরকার-বিদেশি কোম্পানি ও কিছু দালাল এবং সুবিধাবাদী শ্রমিক নেতা শ্রমিকদের বঞ্চিত করছে। প্রতারণা করছে। সব মিলিয়ে এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, মালিক বা সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ না করে ট্রেড ইউনিয়ন করার উপায় নেই। কিন্তু এসব দালাল দিয়ে প্রকৃত শ্রমিক আন্দোলন হবে না। প্রকৃত শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য শ্রমিকদের সংগঠিত করতে প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন তিনি।