মুনতারিনের মৃত্যু নানা প্রশ্ন

21520_f2খবর বাংলা ডেক্সঃ ফরিদপুর-৪ আসনের (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) এমপি নিক্সন চৌধুরীর স্ত্রী মুনতারিনের মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তার মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে বিভিন্ন রকম তথ্য। কেউ বলছেন ছাদ থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে, কেউ বলছেন চারতলার বাসার বেলকনি থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। আবার কেউ বলছেন স্ট্রোক করেছিল তার। মুনতারিনের মৃত্যুর সময় নিয়েও দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি। প্রতিবেশীরা সন্ধ্যার দিকে উপর থেকে পড়ার খবর শুনলেও স্বজনরা অনেকেই বলেছেন রাত ৯টার দিকে তিনি পড়ে যান। তবে মুনতারিনের মৃত্যু নিয়ে সরাসরি মুখ খুলছেন না পরিবারের কেউ। স্ত্রীকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন নিক্সন চৌধুরী। অসুস্থ হয়ে নিজ বাসাতেই শুয়ে আছেন তিনি। স্বজনরা বলছেন, তাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো অবস্থায় রাখা হয়েছে। এই অবস্থায় কারও সঙ্গেই কথা বলছেন না তিনি। অপরদিকে মুনতারিনের লাশ রাখা হয়েছে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের মরচুয়ারিতে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, কয়েক তলা উপর থেকে পড়ে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে ময়নাতদন্ত হলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছায় লাশ মরচুয়ারিতে রাখা হয়েছে। নিহত মুনতারিনের পরিবারের সদস্যরা কানাডায় থাকেন। সেখান থেকে পরিবারের সদস্যরা এলেই তাকে দাফন করা হবে। গতকাল সরজমিন গুলশান-২ নম্বরের ৭৬ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর বাসার সামনে গিয়ে দেখা যায়, সামনে নিক্সন চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকা থেকে আসা নেতাকর্মীদের ভিড়। সবাই এমপি’র স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়ে বাসার সামনে জড়ো হয়েছেন। এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ভেতরে ঢোকার সুযোগ পান। তবে মুনতারিনের মৃত্যু বিষয়ে কেউ কোন কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না। দুপুরে নিক্সন চৌধুরীর পরিবারের বন্ধু পরিচয়ে এক ব্যক্তি বলেন, রাত পৌনে ৯টার দিকে মুনতারিন ভাবী বেলকনিতে গাছের পরিচর্যা করছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে মেয়ে তাজু ও গৃহকর্মী ছিল। ঝড়ের কারণে বেলকনি পিচ্ছিল থাকায় তিনি পা পিছলে নিচে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তবে নিক্সন চৌধুরীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ছয় তলা বাসার ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন মুনতারিন চৌধুরী। এ সময় এমপি সাহেব বাসাতেই ছিলেন। এটি আত্মহত্যা নয় দাবি করে তিনি বলেন, পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এদিকে একাধিক নেতাকর্মী বলেন, তারা শুনেছেন মুনতারিন হার্ট অ্যাটাকের কারণে মারা গেছেন। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একাধিকবার চেষ্টা করেও নিক্সন চৌধুরীর বাসায় সাংবাদিকেরা কেউ প্রবেশ করতে পারেননি। ছয়তলা ভবনের চার তলার এ-৪ পূর্ব-উত্তর কোণের ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন নিক্সন চৌধুরী। স্বজনদের দাবি, ওই ফ্ল্যাটের সামনের দিকে যে বেলকনি সেখান থেকেই মুনতারিন পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সরজমিন দেখা যায়, ওই বেলকনিতে অন্তত ৪ ফুট উঁচু লোহার রেলিং রয়েছে। সেখানে কোন গাছ বা ফুলের কোন টব দেখা যায়নি। ইউনাইটেড হাসপাতাল সূত্র জানান, রাত ৮টা ৩৮ মিনিটে মুনতারিনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসার পরপরই তাকে ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ইউনাইটেড হাসপাতালের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড অ্যাডমিন) বি.জে. (অব.) শহিদুল ইসলাম বলেন, রাতে হাসপাতালে আনার কিছুক্ষণ পরই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর কারণ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছায় লাশ মরচুয়ারিতে রাখা হয়েছে। লাশ হস্তান্তরের আগে তারা পুলিশের পরামর্শ নেবেন বলে তিনি জানান। পুলিশের কোন সিদ্ধান্ত ছাড়া তারা লাশ হস্তান্তর করবেন না বলে তিনি জানিয়েছেন। এদিকে মুনতারিনের মৃত্যু নিয়ে পুলিশের ভূমিকাও রহস্যজনক মনে হয়েছে। অপঘাতে মৃত্যু হলেও পুলিসের ওই বাসায় না যাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে নিক্সন পরিবারের সম্পর্ক থাকায় বিষয়টি নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করছে না। পুলিশও এ কারণে পরিবারের কথামতোই ময়নাতদন্ত বা অন্য কোন প্রক্রিয়ার পদক্ষেপ নেয়নি। পুলিশের গুলশান জোনের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবীর বলেন, এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। তাই পুলিশ কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তবে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর থেকেই ইউনাইটেড হাসপাতালে ছুটে যান গুলশান ও বনানী থানার পুলিশসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সকাল থেকে হাসপাতালে সাদা পোশাকের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের উপস্থিতিও দেখা যায়।
এক স্বজন জানান, দীর্ঘ ১৮ বছর আগে ১৯৯৬ সালে ভালবেসে মুনতারিনকে বিয়ে করেন নিক্সন চৌধুরী। বিয়ের সময় মুনতারিন অষ্টম শ্রেণীতে লেখাপড়া করতেন। তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল মধুর। একে অপরকে গভীর ভালবাসতেন তারা। তাদের একমাত্র কন্যা তাজু। ২০০১ সালে তার জন্ম হয়। বর্তমানে সে সানবীম স্কুলে পড়ছে। ওই স্বজন জানান, সাম্প্রতিক সময়ে নিক্সন-মুনতারিন দম্পতির মধুর দাম্পত্য সম্পর্কে ভাটা পড়ে। পারিবারিক নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মাঝে-মধ্যেই ঝগড়াঝাঁটি হতো।
গুলশানের ওই বাসার নিরাপত্তাকর্মী মাসুদ জানান, ঘটনার সময় তিনি বাসার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন না। সে সময় রবিউল নামে আরেক নিরাপত্তাকর্মী দায়িত্বে ছিল। রবিউলের কাছে সে ম্যাডামের (মুনতারিন) পড়ে যাওয়ার কথা জানতে পারেন। পাশের বাসার এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার সময় তারা এমপি সাহেবের স্ত্রীর উপর থেকে পড়ে যাওয়ার কথা শুনতে পান। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নিক্সনের গুলশানের বাসার কেয়ারটেকার আবদুল মান্নান জানান, ঘটনার সময় আমি গেটের একটু বাইরে ছিলাম। রাত ৮টার কিছু পরে ফ্ল্যাটে হৈচৈয়ের শব্দ শুনে এগিয়ে যাই। শুনতে পাই ভাবী (মুনতারিন) পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন। এর একটু পরেই ভাবীকে কয়েকজন ধরাধরি করে কাছেই হাসপাতালে নিয়ে যান। তাদের কাছেই শুনি তিনি চারতলা থেকে পড়ে গেছেন। হাসপাতালে নেয়ার সময় ভাবী সংজ্ঞাহীন ও রক্তাক্ত ছিলেন। কিছুক্ষণ পর শুনি তিনি মারা গেছেন। মান্নান বলেন, ১লা মে তাদের বনানীর নতুন বাসায় ওঠার কথা ছিল। বাসার কাজও প্রায় শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু আসবাব ও মালামালও গুলশানের বাসা থেকে বনানীর বাসায় স্থানান্তর করা হয়েছে। ভাবী নিজেও নতুন বাসার নির্মাণ কাজের খোঁজ-খবর প্রতিদিনই নিতেন। ঘটনার ৫-৬ দিন আগেও তিনি বনানীর বাসা দেখে এসেছেন। বাসার সাজ-সজ্জার বিষয়ে কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু তার নতুন বাসায় আর ওঠা হলো না। গতকাল বিকালে বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের ব্লক বি’র ১৪/এ নম্বর বাসায় গিয়ে দেখা যায় নিক্সনের সাদা রঙের ১০ তলা বিশাল অট্টালিকার নির্মাণকাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এখন চলছে নিচ তলার দরজা ও জানালায় শেষ মুহূর্তের ঘষামাজা। সুদৃশ্য এই ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে তার বড় দু’বোন তিন মাস আগে থেকেই বসবাস করছেন। বাসার দারোয়ান আবদুল বাসেত ও তত্ত্বাবধানকারী জর্ডস জানান, ১লা মে থেকে নিক্সনের এ বাসায় ওঠার কথা। সেজন্য কিছু আসবাব এবং মালামালও ইতিমধ্যে আনা হয়েছে। এর বেশি কিছু তারা জানেন না বলে জানান। এছাড়া বনানীর সড়ক নম্বর ১৮, ব্লক জে’র ৬২ নম্বর বাসা নিক্সনের ব্যক্তিগত অফিসে গিয়ে দেখা যায় সেখানে তেমন কেউ নেই। এখানকার একজন কর্মচারী জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিক্সন ভাই এখানে এসে বসেন। স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মী ও এলাকার লোকজনের সঙ্গে আড্ডা দেন। সপ্তাহে দু’-একদিন ফরিদপুরে তার নির্বাচনী এলাকায় যান।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend