রবীন্দ্র ছোটগল্প ও পোস্টমাস্টার:মাহমুদুল হাসান
মাহমুদুল হাসান
‘ছোটগল্প’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্রই আমাদের মনে যে নামটি ভেসে উঠে তা আর কারো না, নোবেল বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১)।
এখনো পর্যন্ত তিনিই বাংলা ছোটগল্পের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ রূপকার। বলা বাহুল্য, বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই তিনি সমগ্রপ্রসারী আর দিগন্তবিস্তারী সৃষ্টি প্রতিভা। ছোটগল্পের বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সংকীর্ণ ওবহির্বিকাশের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জীবনের তলদেশে যে নিভৃত ফল্গুধারটি তা আমাদের দেখিয়ে দিলেন। তার ছোটগল্পগুলোতে মূলত মানব জীবনের সুখ দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম ভালবাসা বিষাদময় বিচ্ছেদের এক পূর্ণ সুর উচ্ছলিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোর রচনা যে সময়টাতে আরম্ভ হয়, এবং জীবনের পর্বটিতে অধিকাংশ গল্পগুলো রচিত হয়, সেই উদ্ভব ও বিকাশের সময়ের প্রতি একটু লক্ষ্য রাখলে, তাঁর ছোটগল্পের উৎসটিকে, ধর্মটিকে, আরো ভালোভাবে বোঝা সম্ভব। তাঁর বেশিরভাগ গল্প রচিত হয়েছিল বাঙলা ১২৯৮
থেকে আরম্ভ করে ১৩১০ সালের মধ্যে। অবশ্য তার পরেও আরও কয়েকটি সুপ্রশিদ্ধ গল্প ১৩১৪ থেকে আরম্ভ করে ১৩২৫ সালের মধ্যেই বেশিমাত্রায় প্রবল। তাঁর একটি সুপ্রসিদ্ধ গল্প পোস্টমাস্টার ১২৯৮ সালে লেখা। এর কিছুদিন আগে থেকেই কবি জমিদারি দেখাশুনার ভার নিয়েছেন। তার দিন কাটে পদ্মার জলে নৌকায় ভেসে ভেসে সাজাদপুরে, শিলাইদহে। অপূ্র্ব আনন্দময়, বৈচিত্র্যে ভরপুর তার এই সময়কার জীবনযাত্রা। বাংলাদেশের একটি নির্জন প্রান্ত, তার নদীতীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুর চর, অবারিত মাঠ, ছায়া-সুনিবিড় গ্রাম, সহজ অনাড়ম্বর পল্লীজীবন, দুঃখপীড়িত অভাবে ক্লিষ্ট অথচ শান্ত সহিষ্ণু গ্রামবাসী, সবকিছুকে কবির চোখের সামনে মেলে ধরেছে, আর কবি বিমুগ্ধ বিষ্ময়ে, পুলকিত শ্রদ্ধায় ও
বিশ্বাসে তার অপরিসীম সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করছেন। এমনি ভাবে তিনি গ্রামের সহজ সরল মানুষের সাথে তিনি একাত্ত্বতা ঘোষণা করেছেন। এর মাঝেই তার ভাব-কল্পনার মধ্যে আপনা আপনি গল্পগুলো রূপ পেতে আরম্ভ করল, তুচ্ছ ক্ষুদ্র ঘটনা ও ব্যাপারকে নিয়ে বিচিত্র সুখদুঃখ অন্তরের মধ্যে মুকুলিত হতে লাগল।এ সময় সাজাদপুরে একজন পোস্টমাস্টারের আগমন উপলক্ষে পোস্টমাস্টার গল্পটির সৃষ্টি হলো।
পোস্টমাস্টার গল্পটি প্রথম দিককার গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। একটি স্বজনহারা নিঃসহায় গ্রাম্যবালিকার স্নেহলোলুপ হৃদয় আসন্ন স্নেহবিচ্যুতির আশঙ্কায় কী সকরুণ অশ্রুসজল ছায়াপাত করেছে এই গল্পটির উপর!এছাড়াও গল্পে গল্পে দুই অসম স্তরের নরনারীর হৃদয় সম্পর্কের
রহস্যকে শিল্পী উপলদ্ধি করতে চেয়েছেন। রতন যে সমাজ তথা পরিবেশ থেকে রস সঞ্চয় করে স্ফীত হয়েছে সেই পরিবেশে পোস্টমাস্টারের দশা জলের মাছকে ডাঙায় তুললে যেমন হয় তেমনি।পোস্টমাস্টার নব্য ইউরোপীয় সভ্যতাপুষ্ঠ এক যুবক আর অন্যদিকে রতন এক অনাথিনী বালিকা। রতন যেভাবে পোস্টমাস্টারকে আপন করে নিয়ে নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছে তেমনি কি পোস্টমাস্টার রতনকে পেরেছে? তবু ঘটনাক্রমে পোস্টমাস্টারের কাজের দায়িত্ব রতনের কাঁধে বর্তায়। রতন কাজ করে এবং রতনকে পোস্টমাস্টার ডাকিতেন-
রতন। রতন দ্বারে বসিয়া এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত কিন্তু এক ডাকে ঘরে আসিত না; বলিত, কি গা দাদাবাবু, কেন ডাকছ।
পোস্টমাস্টার : তুই কী করছিস।
রতন : এখনই চুলো ধরাতে যেতে হবে – হেঁশেলের
পোস্টমাস্টার একাকী হওয়ায় মাঝে মাঝে আহার, পারিবারিক বিষয়াশয় নিয়ে রতনের সাথে কথা হয়। প্রবাসে পোস্টমাস্টার তার পরিবারের মা দিদি দাদার কথা বলতেন। রতনও এক সময় পোস্টমাস্টারের ন্যায় চির পরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করত।
পোস্টমাস্টারের হাতে যখন কাজ থাকত না তখন একাকীত্বের যন্ত্রণায় বিষন্ন তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ডাকিতেন-
রতন। রতন তখন পেয়ারাতলায় পা ছাড়াইয়া দিয়া কাঁচা পেয়ারা খাইতেছেল; প্রভুর কণ্ঠস্বর শুনিয়া অবিলম্বে ছুটিয় আসিল হাপাইতে হাপাইতে বলিল ডাকছ? একদিন হঠাৎ করিয়া রতনের ডাক কমিয়া আসিল। কিন্তু রতন সেই ডাক শুনবার জন্য
দ্বারের কাছে অপেক্ষায় বসিয়া থাকত। অপেক্ষার প্রহর গুনিতে গুনিতে যখন ফিরিয়া যাইবার উপক্রম হইল তখন সহসা শুনিতে পেল, রতন। তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গিয়া দাদাবাবু ঘুমুচ্ছিলে? পোস্টমাস্টার কাতরস্বরে বলিলেন- শরীরটা ভাল বোধ হচ্ছে না। দেখ তো আমার কপালে হাত দিয়া।
এরপরই রতন আর ছোট্ট বালিকা রইল না। তখন সে জননীর পদ অধিকার করিয়া, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বাটিকা খাওয়াইল সারা রাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল আপনি পথ্য রাধিয়া দিল। এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল হাগো দাদাবাবু একটু ভাল বোধ হচ্ছে কি? সুস্থ হয়ে পোস্টমাস্টার সিদ্ধান্ত নিল হয় বদলি না হয় চাকুরী ছাড়িয়া চলে যাবে।
রতন। কোথায় যাচ্ছ দাদাবাবু পোস্টমাস্টার। বাড়ি যাচ্ছি
রতন। আবার কবে আসবে
পোস্টমাস্টার। আর আসব না।
এমনি করিয়া পোস্টমাস্টার নতুন পোস্টমাস্টারকে দায়িত্ব দিয়ে বিদায়ের উদ্যোগ নিলেন।
যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন– একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ
মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল।একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, “ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি”- কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে- এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।
গল্পে অনাথিনী রতন তার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে শাশ্বত নারী সত্তার যে পরিনতি তা অত্যান্ত প্রগাঢ় ভাবে দেখা দেয়। নারী হৃদয়ের যে কান্না তা পাঠকের হৃদয় অরণ্যে এক সুক্ষ দাগ কেটে গেছে। রতন সেই পোস্টআপিস গৃহের চারিদিকে অশ্রুজল ভাসিয়া ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে। রতনের এই অশ্রুজলের পেছনে বাস্তবে কোন সামাজিক অথবা সাংসারিক ব্যাপার ছিল না। সমস্থ বেদনার উতস কেন্দ্র হৃদয় রহস্যের গভীরে প্রোথিত। নব্য ইউরোপীয় সভ্যতা দীক্ষিত পোস্টমাস্টার সমাজ সংসার বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পারেনি অনাথিনী রতনকে তার জীবনধারায় একাকার করে দিতে।
ইউরোপীয় সভ্যতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নগর পল্লীর ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে গেছে আমাদের দেশে। এ দুইয়ের মধ্যে কোন প্রকারের হৃদয় সেতুবন্ধন সম্ভব নয়।পল্লী হৃদয়ের সঙ্গে শহরের হৃদয়ের কোন সুত্রেই বাধা পড়ে না- পোস্টমাস্টার গল্পে সেকথা আরেকটু বেশি করে মনে হয়।
তথ্যসূত্র: রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা, আনোয়ার পাশা; গল্পগুচ্ছ, ভূমিকা: রবিশঙ্কর মৈত্রী।
লেখক: সাহিত্যিক