মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা : ক্রেস্টের স্বর্ণ ১৬ আনাই মিছে!
খবর বাংলা২৪ ডেক্স: বিদেশি বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা স্মারক হিসেবে দেওয়া একটি ক্রেস্ট পরীক্ষা করে তাতে কোনো স্বর্ণই পায়নি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। পাওয়া যায়নি কোনো রুপাও।
নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সরকার স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে সাত পর্বে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু স্বনামধন্য ৩৩৮ বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে সম্মাননা দেয়। ক্রেস্টগুলোর মধ্যে ৬০টি বাদে বাকি সবগুলো সরবরাহ করে এমিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
এর আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) একটি ক্রেস্ট পরীক্ষা করে প্রতিটিতে মাত্র সোয়া তিন আনা স্বর্ণের অস্তিত্ব পেয়েছিল। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ শিরোনামে গত ৬ এপ্রিল প্রথম আলোতে মূল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর সরকার এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তের অংশ হিসেবে কমিটি বাংলাদেশে কর্মরত যুক্তরাজ্যের নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা স্মারক হিসেবে দেওয়া ক্রেস্টটি সংগ্রহ করে পরীক্ষা করায়।
এর আগে বিএসটিআই-এর করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। ১২ আনার স্বর্ণই নেই। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তা পাওয়া গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গত ৯ এপ্রিল ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার জিল্লার রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মজিবর রহমান আল মামুন ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব বণিক লাল।
তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, তদন্তের স্বার্থে কমিটি পরীক্ষার জন্য একটি ক্রেস্ট চেয়ে সম্মাননাপ্রাপ্ত কয়েকজনকে চিঠি দিয়েছিল। এ অবস্থায় গত ১৮ এপ্রিল ‘সেই স্বর্ণপদক এখনো জ্বলজ্বল করছে’ শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা পাওয়া জুলিয়ান ফ্রান্সিসের একটি লেখা প্রকাশিত হয় প্রথম আলোতে। লেখাটি পড়ে কমিটি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্রেস্টটি পরীক্ষার জন্য কমিটির কাছে পাঠানোর অনুরোধ করে। জুলিয়ান ওই দিনই তা কমিটিকে পৌঁছে দিয়েছেন।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস তাঁর লেখায় বলেছেন, ‘যে স্বীকৃতি আমাদের দেওয়া হয়েছে, সেটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। এমনকি এর জন্য যদি শুধু একটি সার্টিফিকেটই আমাদের দেওয়া হতো, তা-ও হতো অতীব সম্মানের এবং খুবই বিশেষ রকমের।…এখানে সুস্পষ্টভাবেই দুর্নীতির ব্যাপার ঘটেছে। যে অভিযোগ উঠেছে, আইনের অধীনে তাকে শক্ত হাতে দেখতে হবে। বাংলাদেশ মান ও পরীক্ষণ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা এ উন্মোচন সঠিক হলে তা বাংলাদেশ সরকারের জন্য খুবই বিব্রতকর ব্যাপার। এর বিরুদ্ধে যাতে সঠিক ও কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হয়, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তা দেখবেন।’
তাঁর ক্রেস্টটি পরীক্ষা করে কোনো স্বর্ণ না পাওয়ার তথ্য জানিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে গতকাল শনিবার জুলিয়ান ফ্রান্সিস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বিস্মিত! এটা খুবই দুঃখজনক। এটা সরকারের ভাবমূর্তির প্রশ্ন। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে এ ক্রেস্ট দিয়েছিলেন। আমি আর কী বলব? আমি মনে করি, যারা এটা করেছে তারা বড় ধরনের অপরাধ করেছে। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। কারণ, এটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জার।’
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান জিল্লার রহমানপ্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদন প্রকাশের আগে আমরা কোনো মন্তব্য করব না। তবে আমরা এ বিষয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’
প্রসঙ্গত, নীতিমালায় ক্রেস্টে এক ভরি স্বর্ণ থাকার কথা থাকলেও ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া একটি বিলে দেখা গেছে, একটি ক্রেস্টের জন্য অন্যান্য খরচের সঙ্গে দুই ভরির বেশি (২৩ দশমিক ৫ গ্রাম) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি (বিলে লেখা গ্রাম, কিন্তু দাম ভরির) রুপার দাম পরিশোধ করা হয়েছে।
উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়া এ ক্রেস্ট কেনা হয়েছিল। ক্রয় কমিটিতে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) গোলাম মোস্তফা, উপসচিব এনামুল কাদের খান ও জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব বাবুল মিয়া। এদের মধ্যে আবুল কাসেমকে ওএসডি করা হয়েছে। আর বাবুল মিয়া এখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও এ-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলামের একান্ত সচিব। ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির ঘটনার সময় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তাজুল ইসলাম।