আইনশৃঙ্খলা: স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর গোলমেলে কথাবার্তা
মশিউল আলম
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের জ্ঞাতসারেই চার সহযোগীসহ খুন হয়ে গেলেন নারায়ণগঞ্জের সিটি কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম। খুন হওয়ার আগে তিনি অপহূত হয়েছেন। তারও দুই সপ্তাহ আগে তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, তাঁকে হত্যা করা হবে। যারা তাঁকে হত্যা করতে চায়, তাদের নামও তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে বলেছিলেন।
আহা! বেচারা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী! তিনি এখন নজরুলের বৃদ্ধ মা ও ছেলেমেয়েগুলোকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন? কোনো সান্ত্বনা কি আছে? না, নেই। যাদের হাতে নজরুলের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, তাদের কাছে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ক্ষমতা নির্দয়ভাবে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে; তারা তাঁর অসহায়ত্ব দেশবাসীর সামনে প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। সাত ব্যক্তির অপহরণের পর প্রতিমন্ত্রী পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে ফোন করে পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন। কিন্তু তার কোনো ফল ফলেনি। সাত অপহূতের লাশ ভেসে উঠেছে শীতলক্ষ্যার বুকে। ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটল যেন সবার চোখের সামনেই সাতজন মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হলো, কারোরই কিছু করার থাকল না।
জনগণের নিরাপত্তা বিধান ও আইন প্রয়োগ ব্যবস্থার অকার্যকারিতা প্রতিমন্ত্রীর নিজের বক্তব্যেও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সাত ব্যক্তির অপহরণ ও হত্যার পর আসামিদের ধরার ব্যাপারে সরকারের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। শুরু থেকেই বিষয়টিকে নাকি অনেক গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য কিছু সূত্রে সংবাদমাধ্যম জানতে পেরেছে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তিনি অপেক্ষা করছিলেন ‘ওপরের নির্দেশনা’র। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বারবার বলছিলেন যে তিনি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছেন না। তারপর, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গণভবন থেকে বেরিয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। দু-এক দিনের মধ্যেই ‘বড় একটা কিছু হবে’।
কিন্তু এক সপ্তাহেও সেই ‘বড় একটা কিছু’ ঘটল না। এর মধ্যেই নারায়ণগঞ্জে অপহূত হলেন আরও এক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম এবং ২৪ ঘণ্টা পর তিনি ফিরে এলেন। এটা নিশ্চয়ই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বর্ণিত সেই ‘বড় একটা কিছু’ নয়। এবং এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গোয়েন্দাদের কোনো কৃতিত্ব নেই; কারণ যারা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল, তারাই তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। এমন নয় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছে, কিংবা অপহরণকারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে।
অপহরণ, খুন ও গুম থেকে মানুষকে বাঁচানো দূরের কথা; এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা আরও দূরের কথা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোনো ঘটনারই কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনের অপহরণ ও হত্যার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও খুনি অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করা দূরে থাক, এ ঘটনার কোনো কূলকিনারাই করতে পারেনি প্রশাসন। এই অবস্থায় আরও আজব আজব কথা বলছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। যেমন, শুক্রবার তিনি বললেন, পরিস্থিতি শান্ত না হলে কোনো আসামিকেই গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। এই কথার মানে কী? ‘পরিস্থিতি’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন তিনি? একের পর এক অপহরণ, খুন ও গুমের ঘটনায় দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই কি তিনি বোঝাতে চাইছেন? তা-ই যদি বোঝাতে চান, তাহলে এই পরিস্থিতি শান্ত হবে কীভাবে? কে কোথা থেকে এসে তা শান্ত করে দিয়ে যাবে? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কি বলতে চাইছেন, যারা অপহরণ-খুন-গুমের মচ্ছবে নেমেছে তারা আপনা-আপনি থেমে যাবে এবং পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে? আর কেবল তখনই
আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে? তিনি ও তাঁর মন্ত্রণালয় কি এভাবেই ‘পরিস্থিতি শান্ত’ হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে? নাকি এই ‘পরিস্থিতি’ অন্য কোনো পরিস্থিতি? সরকারের ভেতরের পরিস্থিতি, যার কারণে খুনি-অপহরণকারীদের কেশাগ্র স্পর্শ করা যাচ্ছে না?
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও দারুণ কথা বলেছেন: আমরা যাদের গ্রেপ্তার করতে চাচ্ছি, তারা তো এখন আর জনসমক্ষে নেই, আত্মগোপনে চলে গেছে। তাঁর কথায় মনে হয়, তিনি এমন প্রত্যাশা করেন যে খুনি-অপহরণকারীরা অপরাধ সেরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সামনে ঘুরে বেড়াবে, যেন তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়! আসলে নারায়ণগঞ্জে অন্তত একজন আসামি সে রকম সুযোগ দিন দুয়েক বহাল রেখেছিলেন। কাউন্সিলর নজরুল তাঁর চার সহযোগীসহ অপহূত হন ২৭ এপ্রিল রোববার দুপুরে। এ ঘটনায় তাঁর পরিবার আরেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা নূর হোসেনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে। সেদিন ও তার পরদিন সোমবার নূর হোসেন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। কিন্তু তখন তাঁকে স্পর্শ করা হয়নি। সাত অপহরণ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলে নূর হোসেন আত্মগোপনে চলে গেলেন। তারপর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন, এখন তাঁরা আসামি ধরবেন কীভাবে?
কিছুদিন আগে পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে আসছিলেন, অপহরণ, খুন ও গুমের ঘটনা গত বছরের তুলনায় এখনো কম। এটা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। আর বিরোধী দল যখন সরকারের বিরুদ্ধে তাদের লোকজনকে গুম করার অভিযোগ করছিল, তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী মামলার আসামি, তাঁরা গ্রেপ্তারের ভয়ে নিজেরাই আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন, বিরোধী দল সেটাকেই গুম বলে দাবি করছে। এর মধ্যে দেশজুড়ে লেগে গেল অপহরণ, খুন ও গুমের মচ্ছব। গত এক সপ্তাহেই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি, লাশ পাওয়া গেছে আটজনের। এখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন, এসব করছে বিরোধী দলের লোকজন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই কথা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রতিধ্বনি: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ মে গাজীপুরের সমাবেশে এমন কথাই বলেছেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে বিরোধী দল কই? অপহরণের পর খুনের শিকার কাউন্সিলর নজরুল ও তাঁর খুনি হিসেবে অভিযুক্ত আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন উভয়েই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে আওয়ামী লীগের লোকজনের জুড়ি নেই।
অপহরণ, খুন ও গুমের মচ্ছব লাগিয়ে দেশজুড়ে যারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তারা যেই হোক, তাদের এমন ভয়ংকর দৌরাত্ম্যের মধ্য দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ রকম অবস্থায় তাঁর বিদায় নেওয়া উচিত কি না, প্রথম আলোর প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন. ‘আমাদের পদত্যাগ কেউ চায়, তা আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম।’
সভ্য কোনো দেশে এ রকম হয় না; জনগণ পদত্যাগ দাবি করার আগেই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরা বিদায় নেন। বাংলাদেশ সে রকম দেশ নয়; এখানে জনগণকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হয় সরকারের ব্যর্থতার পাহাড় কত দূর পর্যন্ত বেড়ে উঠতে পারে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।