বিশ্বায়নের কাল : নির্বাচনে অভিবাসন ও সাম্প্রদায়িক বিতর্ক

কামাল আহমেদ 

download (2)

এক.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে নির্বাচনী রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা বরাবরই একটা বড় ইস্যু। কিন্তু ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশ কোনো ইস্যু হয়েছে, এটা আগে তেমন শোনা যায়নি। এবার বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি ও সভাপতি রাজনাথ সিং নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তুলেছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা বিষয়ই তাঁদের বক্তব্য-বিবৃতিতে এসেছে; তা হলো কথিত অবৈধ অভিবাসন।
অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি, ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈষম্যমূলক বাধা অপসারণ, সমুদ্র ও সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির বিকাশে সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক পরিসরে অভিন্ন আঞ্চলিক স্বার্থরক্ষাসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। কিন্তু এত সব বিষয়ে অস্পষ্টতা রেখে ভারতের একমাত্র বিবেচ্য কথিত অবৈধ অভিবাসন।
বিজেপি আগেরবার ক্ষমতায় থাকার সময়ও কথিত অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিষয়টি সামনে এনেছিল। ভারতের নানা শহর থেকে শত শত বাংলাভাষীকে ধরে ধরে বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টায় সীমান্তে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল। তখন বিজেপির জোটসঙ্গী ছিলেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি অবশ্য এখন বলছেন ‘বাংলাভাষী হলেই তারা বাংলাদেশি নয়।’ গত ২১ এপ্রিল দ্য হিন্দু পত্রিকায় শুভজিৎ বাগচি এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের কারণে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বাস্তুচ্যুত মানুষের ভোটাধিকার কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি লিখেছেন যে পশ্চিমবঙ্গের দুটি জেলা মালদহ ও মুর্শিদাবাদের দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাভাষী মুসলমান। তারা ভারত বিভাগের আগে থেকেই সেখানে বসবাস করেন, অথচ অনেকেই তাদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করতে চান।
এই কথিত অবৈধ অভিবাসন বন্ধের যুক্তিতেই ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে গড়ে তুলেছে বিশ্বের দীর্ঘতম কাঁটাতারের বেড়া। পরিবারের বন্ধন, চাষাবাদের জমি, এমনকি ঘরের উঠানও কাটা পড়েছে এই কাঁটাতারের বেড়ায়। আর তাদের সীমান্তরক্ষীদের গুলি চালানোর কারণে এই সীমান্ত ‘বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্তের’ খ্যাতি পেয়েছে। বিজেপি নেতারা এখনো দাবি করে চলেছেন যে প্রায় দুই কোটি বাংলাদেশি সেখানে অবৈধভাবে অভিবাসী হয়েছে। ২০০৩ সালেও তারা এই সংখ্যাটিই বলত। কিন্তু, সংখ্যাটি যে বিভ্রান্তিমূলক, সে কথা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানিই স্বীকার করে নিয়েছেন। ভারত সরকারের পরিসংখ্যান (সূত্র: সেন্সাসইন্ডিয়া ডট গভ ডট ইন) বলছে, ২০০১ সালে সে দেশে মোট অভিবাসী ছিল ৫১ লাখ, যার মধ্যে বাংলাদেশি ৩০ লাখ, পাকিস্তানি নয় লাখ ও নেপালি পাঁচ লাখ। ভারতীয় আদমশুমারির ওই প্রতিবেদন বলছে, এসব অভিবাসীর দুই-তৃতীয়াংশ কুড়ি বছরের বেশি আগে সম্ভবত বাংলাদেশের জন্মের সময় বা ভারত বিভাজনের সময়ে দেশান্তরিত হয়েছে। ভারতের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোয় যে হারে নেপালি পাচকের দেখা মেলে, তার কিন্তু কোনো পরিসংখ্যান নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ভারত নেপালের সঙ্গে সীমান্তেও কিন্তু কোনো কাঁটাতারের বেড়া দেয়নি। কিন্তু ভারতে এবারের নির্বাচনে বিজেপির বক্তব্যে মনে হয় যেন সে দেশে অবৈধ অভিবাসনের একমাত্র উৎস বাংলাদেশ।
১৬ মের পর ভারতে অবস্থানরত কথিত সব বাংলাদেশিকে দেশত্যাগের জন্য গাঁট্টিবোঁচকা বেঁধে রাখতে বলা এবং ‘বাংলাদেশি সেটলারদের জায়গা করে দিতে আসামে গন্ডার ধ্বংস করার চক্রান্ত হচ্ছে’ বলে যেসব হুঁশিয়ারি মোদি দিয়েছেন (সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, মার্চ ৩১, ২০১৪), তা দেশটির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়।

দুই.
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে বিভেদসৃষ্টিকারী উগ্রপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থানের আশঙ্কা বৃদ্ধি শুধু ভারতেই নয়। একই ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ইউরোপেও। ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস মিলিয়ে ইউরোপের একটা বড় অংশে বর্ণবাদী হিসেবে অভিযুক্ত চরম ডানপন্থী দলগুলোর উত্থানের আলামত দেখা যাচ্ছে। এগুলো প্রধানত অভিবাসনবিরোধী, কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে সাম্প্রদায়িক।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংহতি আরও সুদৃঢ় করার মানসে ইউরোপের বিদায়ী প্রজন্মের নেতৃত্ব যে লিসবন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তা কার্যকর হওয়ার পর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রথম নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে চলতি মাসের চতুর্থ সপ্তাহে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৭৬৬টি আসনের জন্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং এই

পার্লামেন্টে যে রাজনৈতিক জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে, সেই জোটের নেতাই হবেন ইউরোপীয় কমিশনের আগামী প্রেসিডেন্ট। বিপত্তিটা সেখানেই। ইউরোপের এ ধরনের বৃহত্তর সংহতিকে অনেকেই মনে করেন ‘ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্র’ (ইউনাইটেড স্টেটস অব ইউরোপ—ইউএসই) প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগ। অনেকেই এই অভিন্ন ‘ইউরোপীয়’ পরিচয়ের চেয়ে নিজেদের জাতীয় পরিচয় ও স্বকীয়তা রক্ষার পক্ষে। ফলে, যাঁরা একে ইউরোপীয় সুপার স্টেট বা ইউএসই বলে বিবেচনা করেন এবং এতে নিজেদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে যাঁদের তীব্র আপত্তি, সেই গোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক সম্মিলন ঘটেছে এসব ডানপন্থী নতুন রাজনৈতিক দল বা জোটে।
ব্রিটেনে এই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২২ মে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও হবে সেদিনই। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য ২৮টি দেশের অধিকাংশতেই নির্বাচনটি হবে ২৫ মে। সুতরাং, ২৫ মে জানা যাবে ইউরোপ কোন পথে হাঁটবে। ব্রিটেনের জনমত জরিপগুলো বিশ্বাস করলে বলতে হবে যে ব্রিটেনের এই উভয় নির্বাচনেই বড় ধরনের বিস্ময় হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি (ইউকিপ)। তিন বছর ধরে জনমত জরিপে বিরোধী দল লেবার পার্টি ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির চেয়ে ৩ থেকে ১০ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক জরিপগুলোয় দেখা যাচ্ছে, লেবার পার্টিকেও ছাড়িয়ে প্রথম স্থানটি দখল করতে চলেছে ইউকিপ। ক্ষমতাসীন টোরিরা অভিবাসনবিরোধী; তারা বহু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ২০১৭ সালে গণভোট অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার করেও ইউকিপের উত্থান ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে হয়। ইউকিপের রাজনীতির মূল দর্শন হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে তাদের সঙ্গে আলাদা করে বাণিজ্য চুক্তি করা। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ইউরোপের কাছে ছেড়ে না দেওয়া। তারা এমনকি ইউনিয়নের অন্যান্য সদস্য, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর বাসিন্দাদের অবাধে ব্রিটেনে প্রবেশ ও অভিবাসনেরও চরম বিরোধী। বলা চলে, অভিবাসন বিরোধিতাই তাদের মূল রাজনীতি। আর জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নে খ্রিষ্টধর্মের প্রতি গুরুত্ব আরোপে তাদের প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতার আলামত মেলে। টুইটার ও ফেসবুকে দলটির একাধিক সদস্যের চরম ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের কারণেও দলটির বিরুদ্ধে বর্ণবাদিতার অভিযোগ আছে।
ফ্রান্সেও বর্ণবাদী দল মেরি লা পেনের ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল ফ্রন্ট আসন্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে চমক দেখাতে পারে বলে জনমত জরিপগুলোয় ইঙ্গিত মিলছে। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের সমাজতন্ত্রী দল ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল (ইউএমপি)—এই প্রধান দুই দলকে ছাপিয়ে তারা সবচেয়ে বেশি আসনে জিততে পারে বলে বিভিন্ন জরিপের আভাস। কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলটির অভাবনীয় সাফল্য মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেকটাই ভাবিয়ে তুলেছে। অন্তত ১১টি পৌর নির্বাচনে তারা মেয়রের পদ দখলে নিয়েছে। ফরাসি ন্যাশনাল ফ্রন্টের রাজনৈতিক সাফল্যের মূলেও রয়েছে অভিবাসন-বিরোধিতা। আর তাদের বিরুদ্ধে ইসলামবিদ্বেষের অভিযোগও নতুন কিছু নয়। ফ্রান্সের মূলধারার রাজনীতি সাংবিধানিক কারণে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করলেও দেশটি ইউরোপের বৃহত্তম মুসলিম অভিবাসীর আবাস।
নেদারল্যান্ডসের জনমত জরিপও বলছে, সেখানে ইউরোপীয় নির্বাচনে এক নম্বর হবে অভিবাসনবিরোধী বিতর্কিত রাজনীতিক গিয়ার্ট ভিল্ডার্সের দল ফ্রিডম পার্টি। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে তাঁর দলকে ভোট দেওয়ার অর্থ হবে নেদারল্যান্ডসে মরক্কোর অভিবাসীর সংখ্যা কমে যাওয়া। বর্ণবাদী বিদ্বেষ ছড়ানোর উসকানি দেওয়ার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ হাজারের বেশি অভিযোগ সরকারি কৌঁসুলির দপ্তরে জমা পড়লেও তাঁর দলের জনমত জরিপে তারা দেখেছে যে ৪৩ শতাংশ ডাচ তাঁর বক্তব্য সমর্থন করেন। ভিল্ডার্সের ইসলামবিদ্বেষী অবস্থানও সুবিদিত।
ইউরোপের অন্য দেশগুলোয়ও অভিবাসন বিরোধিতা রাজনীতির অন্যতম প্রধান বিষয়ে পরিণত হতে শুরু করেছে অনেক দিন ধরেই। তবে ২০০৮ সালে বৃহৎ বিনিয়োগ ব্যাংক লেমান ব্রাদার্সের দেউলিয়াত্বের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বে যে সর্বব্যাপী মন্দার সূচনা ঘটে, তার পরিণতিতে অভিবাসন বিরোধিতা ডানপন্থী রাজনীতির একটা প্রধান উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। মন্দের ভালো এই যে এবারের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে এই অভিবাসনবিরোধী রাজনীতির উত্থানের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের বাইরে অন্যান্য জায়গায় তা ততটা সফল হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত কম।

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

 

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend