জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকায় ভারতীয় বন্য হাতির সঙ্গে বাংলাদেশি সীমান্তবাসীর লড়াই চলছেই। সীমান্তবাসী তাদের ফসল বাঁচাতে জীবন বাজী রেখে হাতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত এ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এই বন্য হাতি তাড়াতে ওয়ার্ল্ডভিশনের হাতি বিশেষজ্ঞদের পাটের আঁশে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে প্রতিরোধের পরামর্শ, বিগত জোট সরকারের সময় সাবেক হুইপ প্রয়াত জাহেদ আলী চৌধুরীর মৌমাছি প্রকল্প, বিগত মহাজোট এবং বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর বেত প্রকল্প, জেলা কৃষি বিভাগের সাবেক উপ-পরিচালক প্রয়াত বানেজ আলী মিয়ার সীমান্ত এলাকায় বরই গাছ লাগানো প্রকল্প, ‘হাতি-মানুষের সহাবস্থান’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার কোনটিই কাজে লাগেনি হাতির কবল থেকে সীমান্তবাসীকে বাঁচাতে।
সর্বশেষ গত প্রায় ৪ বছর আগে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. নাসিরুজ্জামানের সীমান্তে হাতির অভয়াশ্রম নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে সেটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। বরঞ্চ হাতি আসছে হাতির মতোই। তাদের ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে অব্যাহতভাবে। মানুষ মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে, ঘর-বাড়ি হারাচ্ছে, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ পতিত হয়ে পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর।
সম্প্রতি সরকারের ঘোষিত বন্য প্রাণীর আক্রমণে নিহত হলে ১ লাখ, আহত ৫০ হাজার এবং ফসল ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্তরা ২৫ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণায় সন্তুষ্ট নয় সীমান্তবাসী। তারা সাহায্য বা জীবনের মূল্য নয়, তারা চায় হাতির কবল থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি।
সর্বশেষ গত ৭দিনে শেরপুরের নালিতাবাড়ি ও ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী প্রায় ১০টি গ্রামে হামলা চালিয়ে উঠতি বোরো ফসল এবং স্থানীয় কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলের বাগানে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এতে প্রায় ২শ একর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে স্থানীয়রা জানায়। ভারতীয় ওই বন্য হাতির আক্রমণে জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি ওইসব সীমান্ত এলাকায় শতাধিক পরিবার পৈত্রিক ভিটে-মাটি ও আবাদি জমা ফেলে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
বিগত প্রায় ২০ বছরে সরকারি হিসেবে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ ব্যক্তির প্রাণহানির খবর পাওয়া গেলেও স্থানীয় সূত্রে মৃতের ঘটনা প্রায় শতাধিক হবে বলে জানা গেছে। সেইসঙ্গে পঙ্গু ও আহত হয়েছে দুই শতাধিক ব্যক্তি। ভিটে-মাটি ছাড়ার কারণে সীমান্তের অনেক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষীরা বেকার ও দিন মজুর হয়ে গেছে। ফলে ওই সব এলাকার প্রায় ১০ হাজার একর আবাদি জমি বছর জুড়ে অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকে।
বন্যহাতির আক্রমণে বিগত এক যুগে ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল, আম-কাঁঠাল ও বিভিন্ন ফলের বাগান, গোলার ধানসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে।
সরেজমিনে সীমান্তে গিয়ে দেখা গেছে, ভারত তাদের দেশে হাতির উপদ্রপ থেকে বাঁচতে তাদের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা বিশাল গেট খুলে দিয়েছে। যাতে ভারত সীমান্তের হাতিগুলো অনায়াসে বাংলাদেশ সীমান্তে চলে আসতে পারে। কারণ ভারত সীমান্তবাসী যখন হাতি দ্বারা অত্যাচারিত হতে থাকে তখন তারা সীমান্তরক্ষী বিএসএফের সহযোগিতায় হাতিগুলোকে বাংলাদেশের দিকে তাড়া করে। তখন ওই হাতির দল ভারতীয়দের তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে এবং এদেশের সীমান্তবর্তী কৃষকের বিভিন্ন ফসল, গাছপালা এমনকি গোলার ধান পর্যন্ত খেয়ে সাবার করে আবার সীমান্তের ওপার চলে যাচ্ছে। অনেক সময় ভারতের ওই পাড়ের বিভিন্ন গ্রামে হাতির উপদ্রপ বেড়ে গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ এবং সীমান্তের মানুষ হাতির ওপর গুলি চালিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দেয়। গত ২০১২ সালের ৯ জুন নালিতাবাড়ি উপজেলা সীমান্ত দিয়ে একটি হাতি গুলি খেয়ে আহত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে ২ দিন পর পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার সীমান্ত এলাকার বানাই চিরিঙ্গিপাড়া গ্রামে মারা যায়।
প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের সীমান্তবর্তী জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী ৪০টি গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বন্যহাতির ভয়ে আতঙ্কিত জীবন যাপন করছে। ওইসব এলাকার একাধিক গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সীমান্তের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মশাল আর ভোগা বাতি (বাঁশ ও পাট দিয়ে তৈরি মশাল) তৈরি করে রেখে দিয়েছে এবং পাহাড়ের টিলা এবং শাল-গজারি বাগানের ফাঁকে ফাঁকে আবাদি জমির উপর গ্রামবাসী ডেরা তৈরি করে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাত জেগে পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত শুকনো বাঁশের মশাল জ্বালিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে বাঙালি ও উপজাতি কৃষকরা। ফসলের মওসুমে প্রতি ডেরায় ৫ থেকে ৬ জন করে ছোট ছোট গ্রুপ ক্ষেতের চারপাশে অবস্থান নেয়। যেদল প্রথমে হাতির উপস্থিতি টের পায় সে দল চিৎকার করে উঠে। এ সময় আশপাশের সকল দলের সদস্যরা ছুটে আসে হাতি তাড়াতে।
সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীরা জানায়, এই সীমান্ত এলাকায় সর্ব প্রথম ৯০ দশকের পর দুই একটি হাতির দেখা পাওয়া যায় এবং পরবর্তীতে ভারতে খাদ্য সংকটের কারণে ২০০০ সালের শেষ দিকে ২০ থেকে ২৫টি বন্য হাতি ভারত থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে নেমে আসে এবং সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। এক পর্যায়ে হাতিগুলো বাংলাদেশের সীমানার গহীন অরণ্যে অবস্থান করে এবং বাড়ি-ঘড় ও ফসলের ক্ষেতে হামলা চালায়। এ সময় তারা বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আবার ভারত সীমান্তে চলে যায়। এতে হতাহত হয় সীমান্তের মনুষ এবং ক্ষতি হয় ফসলের। হাতির দল শুধু ফসলই নয় পাহাড়ি চারাগাছ, ফলমূল, কাঁঠাল, আনারস, কলা, বাঁশসহ ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র তছনছ করে দিয়ে যায়। ফলে এসব এলাকায় জনসাধারণ বর্তমানে সম্পূর্ণ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সারারাত এরা হাতির পিছনে দৌঁড়ায়। দিনে কোনো কাজ করতে পারে না। চাল কেনার পয়সা দিয়ে মশাল জ্বালানোর কেরোসিন কিনতে হয়। জংলি আলু ও কচু খেয়ে এদের জীবন ধারণ করতে হয়।
সীমান্তবাসীরা জানান, গত এক সপ্তাহ থেকে গারো পাহাড়ের নালিতাবাড়ি উপজেলার খলচন্দা, পানিহাটা, মায়াঘাশি, বারোমারি, বুরুঙ্গা, নাকুগাঁও, দাওধারা কাটাবাড়ি, সমুচ্চুড়া এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার নাকসি, হালচাটি, বড় গজনি, ছোট গজনি, সন্ধ্যাকূড়া গ্রামে হাতির উপদ্রব শুরু হয়েছে।
তারা জানিয়েছে, বর্তমানে মাঠে পাকা ধান থাকায় হাতিদের নজর পরেছে ওই ধানের ওপর। এছাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন গাছের নতুন পাতা গজানোর কারণে সেই কঁচি পাতাও খেতে আসে তারা। তাই প্রায় প্রতি রাতেই সীমান্তের কোনো না কোনো গ্রামে হাতির দল হামলা চালাচ্ছে।
বিগত মহাজোট সরকারের সময় বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী জিএম কাদের শেরপুরের সীমান্তবর্তী গজনী গারো পাহাড় এলাকায় পরিদর্শনে এলে শেরপুরের জেলা প্রশাসক হাতির আক্রমণ থেকে সীমান্তবর্তী মানুষকে বাঁচাতে হাতি-মানুষের সহাবস্থান ও হাতির অভয়াশ্রম এবং পর্যটকদের জন্য ওয়াচ টাওয়ার তৈরির পরিকল্পনার কথা জানায়। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় তিন বছর ধরে সে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি হয়ে পরে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ পরিকল্পনায় জানানো হয়, জেলার নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি ও শ্রবরর্দী উপজেলার সীমান্ত জুড়ে বিশেষ করে যেসব এলাকায় হাতির বিচরণ সেসব এলাকা জুড়ে শক্ত লোহার গ্রিল বা বেড়া নির্মাণ এবং গ্রিল সংলগ্ন পেছনে কলাগাছসহ হাতির খাবারের গাছ লাগানো হবে। যাতে হাতিগুলো সীমান্তবাসীর কোনো ক্ষতি না করে। সেই সঙ্গে ওই গ্রিলের বেড়া সংলগ্ন পর্যটকদের জন্য ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হলে ওই ওয়াচ টাওয়ার থেকে আয় করে হাতির খাদ্যে তৈরির যোগান দেয়া হবে। এতে হাতি গুলো খাদ্য পেয়ে যেমন মানুষের ক্ষতি করবেনা তেমনি এখানেই তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। ফলে পর্যটকরাও বছর জুড়ে হাতি দেখতে পাবে।
এছাড়া শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ি উপজেলার নন্নী ইউনিয়নের গারো পাহাড় এলাকার মধূটিলায় ‘ইকোপার্ক’ এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের গজনি এলাকায় ‘অবকাশ’ নামে পৃথক দুটি পর্যটন কেন্দ্র বা পিকনিক স্পট থাকায় এমনিতেই শীত মওসুমসহ বছর জুড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগোনা রয়েছে।
হাতির অভয়াশ্রম তৈরিতে সবার আগে এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন এবং তাদের সচেতনাতামূলক প্রচারণাসহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এর আগে গত ২০০৯ সালের ২৭ জুন ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া জু আউটরিচ অর্গানাইজেশনের যৌথ উদ্যোগে শেরপুর জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে ৩ দিনব্যাপী কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলংকার হাতি ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। গারো পাহড়ে মানুষ ও বন্যহাতি সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য এ কর্মশালার গুরুত্বারোপ করা হয়।
এছাড়া বন্য হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে ওই বছরের ১৪ মার্চ ঝিনাইগাতি উপজেলায় স্থানীয় সামাজিক সংগঠন স্টেকনেক কমিটির উদ্যোগে শতশত উপজাতি-বাঙালি, নারী- পুরুষ শহরে মানব বন্ধন, র্যালি ও ইউএনওর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। সেচ্ছাসেবী সংগঠন পিদিমসহ আরো কয়েকটি সংগঠন এ কর্মসূচি পালন করেন।
এছাড়া জেলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এনজিও ও সরকারিভাবে হাতির আক্রমণ থেকে সীমান্তবাসীকে বাঁচাতে নানা সেমিনার ও ওয়ার্কসপের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ওইসব কর্মসূচির কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন খবর বাংলা২৪ কে জানান, সীমান্তের হাতির আক্রমণে হতাহতদের ব্যাপারে সম্প্রতি সরকার ঘোষিত ক্ষতিপূরণ শেরপুর সীমান্তে অনেকেই পেয়েছেন। হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সীমান্ত এলাকায় বিদ্যুতায়নের প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কারণ হাতি আলো বা আগুন দেখে ভয় পায়। ইতোমধ্যে সীমান্ত এলাকায় হাতির মোকাবেলা বা তাড়াতে নালিতাবাড়ি ও ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসন থেকে শতাধিক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন টর্চলাইট বিতরণ করা হয়েছে। ঝিনাইগাতী উপজেলায় একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে সোলার প্যানেল সরবরাহ করা হয়েছে সীমান্তবাসীর মাঝে।
এছাড়া তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পূর্বের জেলা প্রশাসকের পাঠানো হাতির অভয়াশ্রমের বিষয়ে বলেন, ‘প্রকল্পটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আশা করি সরকার সবদিক বিবেচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।’