নিজ ভূমে পরবাসী শ্রীবরদীর হরিজনরা!
রোম্মান আরা পারভীন রুমী: বৈশাখের পড়ন্ত বিকেল। পশ্চিমার বাতাসের সাথে ভেসে আসছে বিশ্রী গন্ধ। এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করতেই বলে ওঠেন, এটা মেথর বাড়ির গন্ধ। তবে ওই বস্তিটি সুইপার কলোনি নামেও পরিচিত।
তিনি অকপটে বলে যান ওই বস্তিটির আরো কিছু কথা। অবাক হয়ে শুনলাম। এ পথচারী শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার ঝগড়ারচর বাজারের বাসিন্দা শাজাহান মিয়া (৬৫)। তিনি কৃষি কাজ করেন। অনেক দিন ধরে এভাবেই দেখছেন ওদের। ওই বাড়ির কর্তা সৎনা সুইপার (৬০)। তার বাবা সীতারাম সুইপার। মারা গেছে অনেক আগেই। তিনিও শোনান তাদের জীবনের কিছু কথা। সৎনা সুইপার ওই বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক লোক। তার স্ত্রী বাসন্তী সুইপার। বাসন্তীর বাপের বাড়ি একই উপজেলার ভায়াডাঙ্গা এলাকায়। তাদের দুই ছেলে। শ্যামল বড়ুয়া ও বদুয়া সুইপার। দু’জনেই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। এখন তার নাতী নাতনী হয়েছে। ওদের একমাত্র পেশা বাজার আর অফিস ঝাড়ু দেয়া। এ থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে।
তিনি বলেন, `আমাদের কেউ দেহেনা। বাপদাদারা এইহানে ছিল। আমরাও আছি। এ জমিডাও সরহারি (সরকারি)।
সরহার যদি খেদাইয়া দেয়, তয় আমগোর আর থাহার জায়গা নাই।`
তিনি আরো বলেন, `আমরা আগে বুঝি নাই। তাই পোলা পানগরে লেহাপড়া করাইতে পারি নাই। অহন বুঝতে পারছি। এর লাইগা নাতী আর নাতনীগোরে লেহা পড়া করাইতাছি। ওরা লেহা পড়া কইরা মানুষ অইবো।`
তার স্ত্রী বাসন্তী সুইপার বলেন, `আমরা সরহারের কাছে কিছুই চাইনা। আমগরে থাকবার জায়গাডা যেন কাইড়া না নেয়।`
এমনি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা শোনালেন একই বাড়ির লঙ্গণ সুইপার (৪০)।
তার স্ত্রী সুদী সইপার (৩৫)।
তার দুই ছেলে এক মেয়ে। তার ভাই ভজন সুইপার (৩৫)।
তার স্ত্রী রেমা সুইপার। রেমা সুইপার বলেন, `আমরা যে মানুষ তা মনেই অয়না। সারাদিন বাজারে ঝাড়ু দেই। বিকালে দুই তিন ট্যাহা করে চেয়ে নেই। এইডা দিয়ে আমগোরে সংসার চলে। মাঝে মধ্যে ভাত দিয়ে দারু বানাই। আত্মীয় ন্বজন আইলে তা পরিবেশন করি। এ ছাড়া আমাগোর আর কোনো আনন্দ নাই।`
তবে তিনিও শোনালেন আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা কথা। তার ছেলে মেয়েকে পড়া লেখা করাবে। তারা বড় হয়ে চাকরি করবে। সেদিন হয়তো জীবনের পরিবর্তন আসবে। এ গল্পটি সুবিধা বঞ্চিত ঝগড়ারচর বাজারের হরিজনদের।
তাদের থাকার মতো নিজস্ব কোনো জমি নেই। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষাসহ মৌলিক সুবিধা বঞ্চিত এই হরিজনরা। পিছিয়ে পড়তে পড়তে এখন ওরা একেবারেই পিছেয়ে পড়া একটি জনগোষ্ঠী।
সম্প্রতি অনুসন্ধানে গেলে তাদের ও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজনের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, শ্রীবরদী উপজেলার ভেলুয়া ইউনিয়নের ঝগড়ারচর বাজারের হরিজন পল্লীতে চারটি পরিবার রয়েছে। তারা স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই সেখানেই বসবাস করে আসছে। অথচ তাদের নামে এক খন্ড জমি নেই। সরকারের খাস খতিয়ানের জমিতে ওদের বসবাস। সেখানেও থাকতে হয় চাপাচাপি করে। ওদের কেউ অসুস্থ হলে অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারে না।
বাপ দাদার আমল থেকে ওদের একমাত্র পেশা সুইপারের কাজ করা। কিন্তু এখানেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ওদের দিন চলে অতি কষ্টে। হরিজন বস্তিটি নিচু এলাকা। তাই বৃষ্টি হলে ঘরে পানি ঢুকে। যে ক’দিন বৃষ্টি থাকে সে ক’দিনই থাকতে হয় স্যাতস্যাতে ঘরটিতে। তখন ওদের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ওদের বাড়িতে নেইে কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা। এখনো খোলা আকাশের নিচে পায়খানা করতে হয় ওদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুইপার জানান, চেয়ারম্যান মেম্বাররা তেমন কিছু দেয়না। শুধু ভোটের সময় খবর নেয়। পরে আর কেউ খোঁজ নেয় না। ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্কভাতাসহ নানা সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
এছাড়াও সচেতনতার অভাবে পড়ে আছেন অন্ধকারে। এখনো ওদের বাড়িতে চলে দারু বা চুলাই মদের পরিবেশন। বিয়ে বা ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠানে এ মাদক পরিবেশনের মাত্রা বেড়ে যায়। যার ফলে অনেক ছেলে মেয়ে হয় বিপথগামী। এতে ওদের ছেলে মেয়েরা সমাজ থেকে ক্রমাগত সড়ে পড়ে অনেক দূরে। এছাড়াও ওদের মধ্যে যৌতুক প্রথাটা যেন বেড়েই চলেছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আরজু মিয়া বলেন, ওদের ঘরবাড়িগুলো সরকারি জায়গাতে। কিন্তু কেউ ওদেরকে কিছু বলবেনা। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওদেরকে আমরা নানা ধরণের সুবিধা দিয়ে আসছি। যাতে ওরা আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।
ভেলুয়া ইউপি চেয়ারম্যান শাজাহান মিয়া খবর বাংলা২৪ কে জানান, ওরা আসলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তাই ওদের জন্য সব সময় সরকারি সুবিধা বেশি দেবার চেষ্টা করি।