মামুন ম. আজিজের গল্প: পলাতক
এক.
নদীটা কালো রঙ ধারণ করেছে। তবুও মিষ্টি বাতাস এখনও তাকে ত্যাগ করেনি। সবুজ গাছের সারিটাও ওপাশে এখনও নদীকে আঁকড়ে আছে। যদিও নদীটা মরে যাচ্ছে। সেই শৈশব হতে এ নদীর সাথে আমার সখ্যতা। তখন জল পরিষ্কার ছিলো, আমরা কলোনীর ছেলেরা মিলে নদীর জল ছুতাম আর নদী ছুতো আমাদের গা। এখন আর শখে কেউ কাউকে ছোঁয় না। ঘন কালো জল, নদীটাকে আমরা নোংরা বানিয়েছি, আমার কিন্তু ভালোলাগাটা রয়ে গেছে। নদী দেয় ভালোবেসে হিমেল বাতাস আর আমি দেই কষ্ট মাখা মুগ্ধ দৃষ্টি। কারণ ও মরে যাচ্ছে তিলে তিলে, আর যত কষ্টের মাঝে নদীর আমার খুব আপন কষ্ট এক। ঠিক যেমন লিপি। নদীর দিক থেকে একটা চোখ বারবার লিপিদের বারান্দায় চলে যাচ্ছে। একটু পরপরই। যদি একটু আসত বারান্দায়। একটি বার। আমি তো মোবাইলে রিং দেব না। কথা আমাকে আটকাবে। নদীও আটকাতে পারে। মায়া বড্ড চুম্বক ধর্মী। খালি আটকে দেয়।
আর মাত্র একমিনিট অপেক্ষা করেই নেমে গেলাম ছাদ থেকে। পাঁচতলা বিল্ডিং কলোনীর প্রতিটি। আমাদের বাসা চারতলায়। ভেজানো দরজাটা খুলে সোজা আমার ঘরে চলে গেলাম। দুপুর তিনটে বাজে মাত্র। এই অসময়েও শিপু পড়ছে। আমার ছোট ভাই। কাল ওর ফাইনাল পরীক্ষা। আমি অনেকটা ক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে মনে বললাম, ভাইরে আমিও একটা কঠিন পরীক্ষা দিতে বাধ্য হচ্ছি। তারপরই ভাবলাম এতো আসলে পরীক্ষা নয়, কাউকে বলতে পারছি না। কাউকে বলাও যাবে না। এতো পরীক্ষার চেয়ে অনেক বেশি। এতো ফলাফল। যাবার আগে লিপিকে একবার বলবো নাকি বারান্দায় চলে আসতে। কল দিলেই ও চলে আসবে। আমি আর কী ভালোবাসি। বাসেতো ওই। কিন্তু যদি তার মিষ্টি হাসিটা আমাকে আটকে দেয়। মায়া! না থাক। মা বাবাকেই বলবো না যেখানে। লিপিতো আর প্রকৃতপক্ষে কেউ না। ভালোবাসায় যে সম্পর্ক হয় তার আবার ভিত্তি কী? কিন্তু তবুও যে লিপি কাঁদবে। মা কাঁদবে। যখন উভয়েই কাঁদবে তখন নিশ্চয় দুটোই কোন না কোন সম্পর্কের মাধ্যমে সম্পর্কিত। কিন্তু কাঁদুক। ও কান্নাই ওর জন্য ভালো।কান্না সাথে মনের বেদনা নিষ্কাশিত হবে, তারপর একদিন ভুলে যাবে। নতুন মানুষ আসবে।সংসার হবে। হবে ছেলেপুলে। অনেকদূর দেখে নিলাম দিব্য চোখে। আচ্ছা মা-তো কাঁদবে, কিন্তু কোনদিন কি ভুলবে? তাই কি হয়?
না আর ভাববো না। যা ভাবার তো ভেবেছিই। বাবা-মা ঘুমাচ্ছেন। শুক্রবার আজ। ছুটির দিন। উঁকি মেরে দু’জনের চেহারা দেখে নিলাম। তারপর হন হন করে হেঁটে মূল দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। সিঁড়িগুলো ভাঙতেও সময় লাগলো না। ভেবেছিলাম লিপিদের বাসার দিকে তাকবো না। ওরা সামনের বিল্ডিংয়ে তিন তলায় থাকে। যাক- কেউ নেই। রাস্তাতেও তেমন কোন পরিচিতজন চোখে পড়লো না। এর চেয়ে উত্তম সুযোগ আর হয় না। আমাকে এই মুহূর্তেই পালাতে হবে। ওরাও এই সময়টা বেছে নিতে বলেছিলো।
দুই.
আমি পালাতে বাধ্য হয়েছিলাম। ওরা হ্যাপিকে আটকে রেখেছিল। লিপির ছোট বোন হ্যাপি। অনার্সে ভর্তির কোচিং করছে। বেশ ভালো সে লেখাপড়ায়। লক্ষ্মী একটা মেয়ে। সকাল ১১টা নাগাদ আমার মোবাইলে ওরা একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছিলো এমএমএস করে। মাত্র দশ সেকেন্ডের ভিডিও। হ্যাপির চোখ বাঁধা ছিল তারই ওড়না দিয়ে। সকালে আমি হ্যাপিকে বাসা থেকে বের হতে দেখেছিলাম। এই ওড়নাই ছিল ওর গায়। চোখ থেকে ক্যামেরা নামছিল নিচে। এ তো হ্যাপি। চিনতে ভুল হলো না পুরো মুখটা দেখে। থুতনীর বামে স্পষ্ট দৃশ্যমান তিলটা ওকে শতভাগ চিহ্ণিত করার জন্য যথেষ্ট। আমি উৎকণ্ঠায় ওর ঠোঁটের ভাষাটা ধরতে ভুলে গেলাম। ক্যামেরা তারপর আরও নামছিল। গলা থেকে আরেকটু নামতেই ভিডিও থেমে গেলো, কোন কাপড় নেই ওর গায়। আমি শিহরিত না হয়ে তখন আর কি উপায়। তারপর একটা কল এসেছিল। একটাই দাবী ছিল তাদের- আমাকে পালিয়ে যেতে হবে, হারিয়ে যেতে হবে। না হলে ছাড়বে না হ্যাপিকে। ভিডিও দেখে যে ভয় পেয়েছি সেটা ওরা বাস্তব করে দেবে। তারপর পুরো রেপ দৃশ্যের ভিডিও ছড়িয়ে দেবে তারা অনলাইনে। আমি প্রচন্ড ভীত হয়েছিলাম। কোন বন্ধুকেও বলব সাহস পেলাম না। আর সাহস দেখানোর ওখানে কিছু নেই।
লিপির বাবার কাছে আমি আজন্ম ঋনী। তখন আমি ডিগ্রী ফাইনালের ছাত্র। বছর চারেক আগের কথা। বড় বাজারে শিপনের সাথে পার্টারশীপে ফলের দোকানটা তখনও শুরু করিনি। ওটা দিয়েছি বছর দুই হয়েছে। ফরমালিন আর কার্বাইড মুক্ত রাখতে গিয়ে ওটাও লাভের মুখ দেখছে না তেমন আজকাল। শিপনও আর আমার সাথে ব্যবসা করতেও চায় না আজকাল। ওর কি দোষ। ওতো আর সবার মতই লাভ চায়, সে লাভের জন্য কার্বাইড আর ফরমালিন কেন, আরও কিছু যদি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়-সে করতে চায়। আমি বুঝিয়ে বাধা দিয়ে রেখেছি। শিপন বুঝতে চায় না। ওর ছোট ভাইটাও তো ফল খায়, তারপর ওর ভাগ্নে । ওদের কি হবে। ও সেসব মানতে চায় না। সবাইতো করছে। এভাবেই এ দেশ চলছে। গডডালিকা প্রবাহ যাকে বলে। হয়তো ব্যবসাটা আর থাকবে না। বাবাকে একটু সহায়তা করতে চেয়েছিলাম, উল্টো বাবার থেকে গতমাসে টাকা নিয়ে দোকান ভাড়া দিতে হয়েছে। সে যাক। যা বলছিলাম। লিপির বাবা আরমান চাচা আর আমার বাবা সেই স্কুল জীবন থেকে বন্ধু। এই কাপড়ের মিলে দু’জন একসাথে একাউন্টটেন্ট এর চাকুরী পেয়েছিলেন। সেও এক মজার ঘটনা। ইন্টারভিউতে দু’জন এক সাথে ঢুকেছিলেন। মালিকতো তাদের সোনায় সোহাগা ভাব দেখে এক সাথে নিয়েই নিলেন। সেই থেকে এই কলোনীতে এত গুলো বছর কেটে গেছে দুই বন্ধুর। এক বিল্ডিংয়েও বাসা নেননি কেবল সামনা সামনি থাকার জন্য। আমারও কপাল এমন এক চাচার মেয়ের প্রেমে মজেছি। আমারও সোনায় সোহাগা হবার কথা। কিন্তু কার যে নজর লাগলো?
চারবছার আগে বাবার কলোন ক্যানসার ধরা পড়লো । গরীবের ঘোড়া রোগ। কপাল ভালো ধরা পড়েছিল প্রাইমারি স্টেজে। বাবা আমার শৌখিন মানুষ। টাকা জমানোর ধাতে নেই। কেমোর জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। ছিল না কাছে। আমি কেবল কাঁদতাম। অকর্মন্য ছেলে। অযোগ্য। লিপির বাবা এগিয়ে এলেন। চাচা বেশ বৈষয়িক। টাকা জমিয়ে গ্রামে বেশ জমিও কিনেছেন। ওনার কথা হলো তার দুই মেয়ে। বিয়ে দিতে তো টাকা লাগবে। এই জমি বেঁচেই সে সময় টাকা জোগাড় হবে। আর বাবার চিন্তা উল্টো, তার দুই ছেলে নিজেরাই কামাই করে নেবে। ওতো ভাবার কি আছে। আরমান চাচা গ্রামে এক বিঘা জমি বেঁচে দিয়েছিলেন কেবল বাবার চিকিৎসার জন্য। এই ঋণ আমি কেমনে শোধ করি। তরপর তার মেয়েকে ভালোবেসেছি। যদি রাজী না হন। সে আরেক কেলেংকারী।
হ্যাপির এই বিপদ। আমি সব করতে পারি। হারিয়ে যাওয়াতো খুবই তুচ্ছ। খুবই ক্ষুদ্র। আমার আর ঐ মুহূর্তে কিই বা করার ছিলো। ওরা বলছিলো যত তাড়াতাড়ি বের হব তত তাড়াতাড়ি হ্যাপি ছাড়া পাবে। মিলের গেইট পেরিয়ে রাস্তার ধার ঘেষে হেঁটে গেলেই সামনে একটা বড় কড়ই গাছ। ডানে বড় রাস্তার মোড়। গছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওরা বলেছিল, গাছের সামনে থেকে কোন একটা লোকাল বাসে উঠলেই হ্যাপিকে ছেড়ে দেবে। আমি বাসে ওঠার আগে কল দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, হ্যাপিকে না দেখে আমি যাব না। ওরা বললো সীমটা খুলে ড্রেনে ফেলে দিয়ে মিলের গেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে, হ্যাপিকে দেখলেই আমি যেন বাসে উঠে পড়ি। এখানে একটু পরে পরেই বাস থামে। পাঁচ মিনিট পরেই দেখলাম। ঐ তো হ্যাপি। একটা ছেলে তার হাত ধরে মিলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। হ্যাপি মাথা নিচু করে আছে। দূর থেকে ছেলেটাকে চিনতে পারলাম না। অবশ্য সে ক্যাপ পরে চেহারা আড়াল করে রেখেছিল। আমিও মুহূর্তে বাসে উঠে হারিয়ে গেলাম। আমাকে যে হারাতেই হবে।
তিন.
আজ আমার হারিয়ে যাবার তৃতীয় দিন। আমি ঢাকার মহাখালী গিয়ে সেখান থেকে বাসে উঠে চলে গেছি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আমাদের দেশের বাড়ী মাদারীপুর। সে কারণেই অন্যদিকে চলে গেলাম। কেউ চিনবে না। একটা হোটেলে উঠেছি। হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে বের হয়েছিলাম। এই টাকায় বেশি দিন যাবে না। এখানে আমি এক ফল ব্যবসায়ীকে চিনি। কেরামত আলী। মূলত তার ভরসাতেই এসেছি। খুবই ভালো মানুষ। বিশ্বাসী। কখনও আমাকে বিষ মানে কেমিক্যাল দেয়া আম সে পাঠায়নি। তাকে খুঁজে বের করতে পেরেছি। সব খুলে বললাম। সে পরহেজগার মানুষ। আশা করলাম সে আমার কাছে এই সব কথা কাউকে না বলার জন্য যে ওয়াদা করেছ তা সে রাখবে। সেও আমাকে বিশ্বাস করে। জানে কখনও ব্যবসায় আমি ভেজাল কিছু করি না। তার সাথে কাজ করা জন্য আমাকে অনুরোধ করল। আমিতো তাই চাই। তবে শিপনকে না জানানোর জন্য বলে দিলাম। শিপন আর আমি ক’দিন আগেই কেরামতের কাছ থেকে হাজার দশেক টাকার আম নিয়েছিলাম। সে টাকাটা এখনও কেরামত পায়। একই সাথে আরও দশহাজার টাকার আম পাঠানোর অর্ডারও দিয়েছিলাম। বললাম শিপনের সাথে যোগাযোগ করেন। আপনার তো টাকাটা পাওয়া দরকার।
শিপনতো কেরামতের ফোনই ধরে না। ঘন্টাখানেক পরে অন্য মোবাইল থেকে করার পর ফোন ধরল বটে। কিন্তু সে খুব হতাশাজনক কথা জানলো। কেরামত ভাইকে বলেছে, আমি দোকানের সব টাকা মেরে পালিয়ে গেছি। এখন দোকানে কোন মাল নেই। এই মহূর্তে সে টাকা দিতে পারছে না। দোকান বেঁচে টাকা দিতে হবে। সময় লাগবে। আর কোন আম পাঠানোর দরকার নেই বলেছে। ব্যবসা সে একা আর করবে না। খুব কষ্ট হলো শিপনের জন্য। না জানি মা, বাবা, লিপিকেও কত কষ্ট দিলাম। কিন্তু দুটো পরিবারকে মান সম্মান খোয়া থেকে তো বাঁচালাম। এই প্রশান্তি আমাকে শান্তি দিচেছ। আম বাগান আমার খুব পছন্দ। চাপাই আগে কখনও আসিনি। এমন বিস্তৃত আম বাগান, সবুজের সমুদ্র আগে কখনও দেখিনি। মুগ্ধ হয়ে দেখছি কদিন ধরে। কেরামত ভাই এমন বড় একটা আম বাগানের সব আম কিনেছে। সেখানে থেকেই ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় আম পাঠায়। আমাকে তার সাথে সরবারাহে কাজে সহায়তা করতে বলেছে। বিনিময়ে তিনবেলা খাওয়া আর থাকার জায়গা হয়েছে তার বাড়িতে আপাতত।
আজ আমার হারিয়ে যাবার পঞ্চম দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কেরামত ভাইয়ের বাসার উঠোনে একটা বড় আমা গাছ তলায় বসে ছিলাম। হঠাৎ কেরামত ভাইয়ের ছেলেটা ছুটে এল। বয়স পাঁচ। বলল, চাচ্চু ও চাচ্চু তোমাকে টিভিতে দেখাচ্ছে। দৌড়ে গেলাম। হুম ঠিক। খবরের মাঝে আমার ছবি দেখাচ্ছে। মা-র কান্নার দৃশ্য। খুব কষ্ট হচ্ছে মাকে ঐ অবস্থায় দেখে। তারপরের দৃশ্যে শিপনের দিকে একটা মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিচ্ছে দেখলাম সাংবাদিক মেয়েটা। আমাদের দোকানের সামনের দৃশ্য। দোকান ভর্তি ফল আর ফল। একটু কান্না জড়ানো কণ্ঠে শিপন জানালো আমাকে নিশ্চিত গুম করা হয়েছে। কাউকে সন্দেহ করে কিনা এমন প্রশ্নে সে জানলো- আমার মত ছেলেই হয় না, সৎ নিরীহ। আমার আবার কে শত্রু থাকবে। তবে কেমিক্যাল মুক্ত ফল না বিক্রির জন্য আমি যে নাকি একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম তর জন্য কেউ কেউ কুনজরে দেখছিলো। সত্য। চেষ্টা করেছিলাম। আন্দোলন নয়। একটা লিফলেট বিলি করেছিলাম। শিপনও তো সেটার বিরোধীতা করেছিলো বরং অন্যদের চেয়ে বেশি। বাকীরা আমাকে অতোটা পাত্তা দেয়নি। শিপন বললো, যাদের বিরাগভাজন হয়েছি তারা কেউ গুম করতে পারে।
দোকানের ভেতর ঘুরে এল একবার ক্যামেরা। ফল দেখেই চিনলাম। এসব ফল তো আমার দোকানে ছিল না। যেসব আড়তের সিল প্যাকেটে তারা সব কেমিক্যাল ব্যবহার করে ফলে। এতো এতো ফল দোকানো আর কেরামত ভাইয়ের কাছের কাছে বলেছে অন্য কথা। হঠাৎ আমার মাথা যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল। খুলে গেলো বন্ধ একটা জানালা।
চার.
টিভির সামনে থেকে আম গাছ তলায় ফিরে গেলাম। একটা টুল টেনে বসলাম। গায় আম পাতার ঝিরিঝিরি বাতাস লাগছে। নদীর কথা মনে পড়ছে, পাতার ফাঁক দিয়ে কচি রোদও ফালি ফালি হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার মাথা খুলছে। মা-র কান্নার দৃশ্য কষ্ট দিছে খুব। তবুও মাথা খুলছে। কেরামত ভাই, ও কেরামত ভাই বলে জোরে ডাকলাম দুবার। কেরামত ভাই ছুটে এল। মোবাইলটা দিতে বললাম।
মোবাইল হাতে নিয়ে লিপির নম্বরটা মনে করে আঙ্গুলে চেপে নিলাম। অচেনা নম্বর ও ধরার কথা নয়। তবে আমি গুম, যেকোন খবর আসতে পারে। আমার বিশ্বাস ও ধরবে। দুবারেই বিশ্বাস ফলে গেলো। আমার লিপি ফোন ধরল।
হ্যালো। কেমন আছ?
কে? কে? সোহান…কোথায় তুমি, কোথায় বল, বল না প্লিজ।
স্থির হও। সব বলব। আগে আমার কথাগুলো শোন। মন দিয়ে শোন।
কি কথা। তুমি কোথায় আগে বল না। তোমার মোবাইল কই?
আহা! আমাদের বিপদ। অনেক বড় বিপদ। চিৎকার করো না। চুপচাপ। কাউকে বলো না আমি কল দিয়েছি। আমি আসব, কালক্ইে ফিরে আসব। কিন্তু একদম চুপ। আমি ফোন করেছি, কাউকে বলা যাবে না।
কেনো, কি হয়েছে বলো না, বলো না তুমি।
শোন, আগে হ্যাপির কাছ থেকে দুটো খুব গোপন তথ্য আমাকে এনে দাও। তথ্য পেলেই সব মিলে যাবে। সব। তখন বলছি।
কি তথ্য?
একটু খারাপ লাগবে তোমার শুনতে। কিন্তু আমিই তো বলছি। নিশ্চই তুমি আমার উপর রাগ করবে না।
করবো নাতো। তুমি আস না। সামনা সামনি এসে বল।
না শোন। হ্যাপিকে জিজ্ঞেস কর, গত শুক্রবার, যেদিন আমি হারালাম ঐ দিন বিকেলে ও কার সাথে মিলের গেইট পর্যন্ত এসেছিল। ছেলেটি কি ওর ফিয়ান্সি? আর আর ঐ ছেলেটা কে, ওর সাথে শিপনের কি সম্পর্ক?
আমি তো কিছুই বুছতে পারছি না। এসব এর সাথে তোমার হারানো কি সম্পর্ক?
সব বুঝবে। আরেকটা কথা-এটা কিন্তু জানতেই হবে। ঐ ছেলেটার সাথে হ্যাপির কি …তুমি রাগ করো না আবার। ঐ ছেলেটার সাথে হ্যাপির কি কোন দৈহিক সম্পর্ক আছে কি না একটু জানতে চেষ্টা কর। প্লিজ। আমার কথা কাউকে বলো না। আমি কালই আসব। উত্তরগুলো জেনে আমাকে কল দাও এই নম্বরে।
বিশ মিনিট পরে লিপির ফোন এল। কান্না জড়ানো কণ্ঠ। বললো, অনেক কষ্টে সে কথা আদয় করেছে। বাধ্য হয়ে বলতেও হয়েছে তোমার জীবণ মরণ জড়িত এর সাথে। এতে কাজ হয়েছে। ছেলেটা লাভলু, শিপনের বেয়াই।..
ঐ বদটা, ওটাতো একটা হারামী। মাস্তান একটা। ওদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক আছে। ছিঃ আমার ছোট বোনটা। ছিঃ ছিঃ আমিতো ভাবতে পারি না। আমরা দু’জন এত কাছাকাছি, তবুও একবারও কখনও সাহস দেখালাম না। আর ও, আমার বোন হয়ে। তাও..
চুপ কর। ওসব ভেবে তো আর লাভ নেই। ও ছোট। ওকে ফুসলিয়েছে ওরা। ঐ লাভলু আর শিপন।
হুম আমি একটু বুঝতে পারছি মনে হয়। শিপন ভাইয়ের বাবা আমার বাবার কাছে তার সাথে আমার বিয়ের কথা তুলেছে। এখন সব ক্লিয়ার হচ্ছে।
শিপন এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারতে চেযেছিলো। আমার এত দিনের বন্ধু। তোমাকে বিয়ে করতে চায় একবারও আমাকে জানতে দেয়নি। ঘুনাক্ষরেও না। তুমি কিন্তু একদম চুপ থাকবে। হ্যাপিকেও আর কিছু বলো না। ওদের কাছে হ্যাপির অশোভন ভিডিও আছে। খুব সাবধান এগোতে হবে। ভেব না, আমি আটসাঁট বেধেই আসছি কাল। …
পরিশিষ্ট.
পরের দিন সকাল পেরেয়ি দুপুর গড়িয়ে গেলো। লিপির উৎকণ্ঠার ব্যারোমিটারে পারদ অনেক উপরে উঠছিলো। কারোও সাথে উৎকণ্ঠা ভাগাভাগি করবে সে উপায়ও নেই। হ্যাপিকেও বেশি কিছু বলতে পারছে না। পাছে সে না আবার লাভলু বদমায়েশটাকে বলে দেয়। উৎকণ্ঠা দিগন্ত সীমা ছাড়াতেই লিপি কেরামতের নম্বরে ফোন দিয়েই ফেলে। জানতে পারে সোহান সাতসকালেই বেরিয়েছে। কেরামত তাকে চিন্তা করতে মানা করে। চিন্তা কি কেউ স্বেচ্ছায় করে। ওতো সহাজত।
সন্ধ্যার পরেও কোন খবর এলো না। সে রাতও পেরিয়ে গেলো।
পরদিন দুপুরে টিভিতে ব্রেকিং নিউজ এলো- নদীতে ভেসে উঠেছে একটি মৃতদেহ।
সেই নদী, সেই প্রিয় নদী। যে নদীর কোলে শৈশবের মায়াকালগুলো লালিত হয়েছিল সোহানের। ওর বাবা- মা এবং লিপিরাও খবর দেখতেই ছুটে গিয়েছিল থানায়। সেখানে শিপনকেও দেখতে পেলো লিপি।
লাশটা সোহানেরই ছিলো।সহজেই সবাই সনাক্ত করতে পারল।
কাউকে কিছু বলতে পারছে না লিপি। তার কাছে কোন প্রমাণ নেই। খুনী শিপন উল্টো সান্তনা দিচ্ছে শিপলুর বাবা-মাকে। ওসব দেখার মতো দৃশ্য না। এক দৌড়ে থানা থেকে বাসায় ফিরে এসেছিল লিপি।হ্যাপিকে ডাকল। সবটুকু রাগ হাতের চেটোয় সঞ্চয় করে একটা কষে চড় দিলো হ্যাপির গালে। তারপর ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়।