প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী-কাম পিয়ন নিয়োগে রমরমা বাণিজ্য
সারা দেশের ৩৭ হাজার ৬৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী-কাম-পিয়ন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এরা রাজস্ব খাতেই নিয়োগ পাবেন। আগামী ৯ মে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) অধীনে একটি নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ পরীক্ষা নেয়া হবে শুধু জেলা বিভাগীয় শহর এবং রাজধানীতে অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রত্যাশীদের জন্য। এ ছাড়া দেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে সেখানে নিয়োগ দেয়া হবে স্থানীয়ভাবে। এক্ষেত্রে যে সব নিয়োগ দেয়া হবে বা হচ্ছে সেখানেই চলছে রমরমা বাণিজ্য। নিয়োগ প্রত্যাশীদের কাছ থেকে দর-কষাকষি করে নেয়া হচ্ছে টাকা। এ নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধও চলছে বলে জানা গেছে।
দেশের কয়েক জায়গায় নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ ও বঞ্চিতদের দাবির মুখে তদন্ত কমিটি করতে বাধ্য হয়েছে স্কুল কমিটি। কোথাও আবার স্থগিতও করা হয়েছে নিয়োগ কার্যক্রম। বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভুক্তভোগী ও সরকারি কর্মকর্তারা।এই নিয়োগের জন্য ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর একটি নীতিমালা জারি করার পর ক্ষমতাসীনরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এর সাথে যুক্ত রয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারাও। রাজধানী ও জেলা বিভাগীয় শহরের জন্য পৃথক নীতিমালা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে এখানে পরীক্ষার আগেই কোনো কোনো স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রার্থীদের কাছ থেকে আগাম অর্থ নিয়েছেন। এখন প্রতীক্ষা শুধু নিয়োগ পরীক্ষা শেষ হওয়ার জন্য। নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বাছাই ও নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, সদস্যসচিব এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসার মনোনীত একজন সদস্য থাকবেন কমিটিতে। প্রায় সবক’টি বিদ্যালয়েই নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে এলাকা ভেদে টাকার তারতম্য রয়েছে। কোথাও এর চেয়ে বেশি ও কম আদায় করা হচ্ছে এবং হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুহা: আ: আউয়াল তালুকদার এবং মহাসচিব ছালেহা আক্তার নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। আউয়াল তালুকদার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা যেভাবে এ নিয়োগে স্বচ্ছতা চেয়েছিলাম তা হচ্ছে না এবং হয়নি। পদগুলো গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছে। মহাসচিব বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আমাদের কাছেও আসছে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এমপিদের আত্মীয়দেরই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
এই নিয়োগের ব্যাপারে ডিপিইর মহাপরিচালকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে জানা গেছে, তিনি সরকারি সফরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আগামী ৭ মে তিনি দেশে ফিরবেন। পরে ডিপিইর পরিচালক প্রশাসনের সাথে কথা বলতে চাইলে অফিস থেকে জানানো হয়েছে, এ পদে বর্তমানে কোনো কর্মকর্তা নেই। সম্প্রতি একজনকে পদায়ন করা হলেও তিনি যোগ দেননি। ফলে অধিদফতরের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নরসিংদীর রায়পুড়া উপজেলার ৪৯টি স্কুলে দফতরি নিয়োগে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদ রানা এ বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন জাকির হোসেন ও আলমগীর হোসেন। এ ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। এ ঘটনায় এলাকায় ক্ষোভ বিরাজ করছে। এর আগে একই ধরনের অভিযোগে উপজেলা কর্মকর্তা আফতাবের বিরুদ্ধে ঝাড়– মিছিল করেন এলাকার লোকজন।
ওই উপজেলার একজন শিক্ষক নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা অসহায়। এখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজই হয় না। অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাসুদ রানা। তবে উপজেলার আটটি স্কুলে বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি। ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি-কাম নাইটগার্ড নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক বাণিজ্য হচ্ছে। প্রতিটি পদের বিপরীতে চার-পাঁচ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি-কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ দিয়ে স্কুল কমিটির সভাপতি, প্রধান শিক ও অন্যরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। দেয়া হচ্ছে পছন্দের ও দলীয় প্রার্থীকে। হরিণাকুণ্ডুর ভাদড়া স্কুলে চার লাখ টাকা নিয়ে সভাপতি লিটন মোল্লা এবং প্রধান শিক কামরুন্নাহার চার লাখ টাকা নিয়ে এক যুবকে চাকরি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গ্রামের লোকজন ঝিনাইদহ প্রেস কাবে ওই অভিযোগ করেন। একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি-কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। সৈয়দপুর উপজেলায় দ্বিতীয় দফায় ২০টি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে দফতরি-কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে আটটি শহরে এবং ১২টি গ্রামের স্কুল রয়েছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, প্রধান শিক ও শিা কর্মকর্তা মনোনীত সদস্য নিয়ে গঠিত নিয়োগ কমিটি প্রার্থী বাছাই করবে। কমিটির সুপারিশক্রমে নিয়োগ অনুমোদন দেবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। অপর দিকে চাকরি প্রার্থীদের হতে হবে স্কুল অবস্থিত ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। নিয়োগ পেতে চলছে লবিং-তদবির ও দরকষাকষি। যে বেশি টাকা দেবেন সেই নিয়োগ পাবেন এমন কথাও বলা হচ্ছে। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশ উপো করে ১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীার আগেই প্রার্থী চূড়ান্ত করে প্রায় কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের পাঁয়তারা চলছে। এ ঘটনায় বিুব্ধ হয়ে উঠেছেন প্রার্থীরাও। এ ঘটনায় উপজেলার রাজমালীর হাট, সুকদেব, জোড়সরেয়া, বৈদ্যের বাজার, চান্দামারী, নওদাবস, বালাকান্দি মুক্তারপাড়া, বোতলারপাড়, পাইকপাড়া, সাকোয়া, ঠাটমারী, ভীমসর্মা, খিতাবখাঁ ও গাবুর হেলান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেক স্থানে প্রার্থী ও অভিভাবকেরা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়োগ বন্ধের দাবিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অভিযোগ দাখিল করেন। উপজেলার বোতলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীা নিতে গিয়ে একজন উপজেলা সহকারী শিা কর্মকর্তা তোপের মুখে পড়েন। এ ছাড়া বিুব্ধ জনতা আটটি বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীা ভুণ্ডুল করে দেন। দুর্নীতি তদন্তে ইতোমধ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাবনা চাটমোহরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি-কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগে কোটি টাকার বাণিজ্যের পাঁয়তারা চলছে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চাটমোহর উপজেলার ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় কয়েক মাস আগে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরু থেকে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং স্কুলের প্রধান শিক নিয়োগের নামে প্রার্থীদের কাছ থেকে সর্বনি¤œ দুই লাখ থেকে শুরু করে চার লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে এই নিয়োগের প্রক্রিয়া করা হচ্ছে। এই বিশাল অঙ্কের ঘুষ স্কুলের সভাপতি, প্রধান শিক, সহকারী শিা অফিসার, উপজেলা প্রাথমিক শিা অফিসারকে প্রদান করে নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে চাটমোহর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এ কে এম সামসুদ্দিন বলেন, দফতরি নিয়োগে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য হচ্ছে এটা দিবালোকের মতো সত্য। আমার কাছেও অভিযোগ এসেছে। তিনি বলেন, আমি বিষয়টি জানার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাথমিক শিা অফিসার এবং সহকারী শিা অফিসারদের নিয়ে মিটিং করে সতর্ক করে দিয়েছি। সম্পূর্ণ মেধা যাচাই করে ওই পদে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছি। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া ইউপির এগারনলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি-কাম প্রহরী নিয়োগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় এলাকার অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মধ্যে ােভের সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া ইউপির এগারনলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিগত ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘দফতরি-কাম প্রহরী’ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পূর্ব থেকেই ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি আতিয়ার রহমান ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক তারা পদ বিশ্বাস নিকট আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করেন। ওই ঘটনায় এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে কাছে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর কর্তৃপরে নির্দেশে নিয়োগ কমিটিতে সভাপতিকে বাদ দিয়ে লাহুড়িয়া হাফেজ আব্দুল করিম অ্যাকাডেমির শিক লাবলু মোল্যাকে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু এর আগেই নিয়োগের নামে পাঁচজনের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার একটি স্কুলে দফতরি পদে নিয়োগে প্রার্থীর এক অভিভাবক বলেন, টাকা নিয়ে দর কষাকষি হচ্ছে। যে বেশি টাকা দেবে তাকেই নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি- কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার অর্ধশতাধিক সরকারি প্রাথমিক শিা প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় পর্যায়ে দফতরি-কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগের জন্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ উপজেলা পরিষদে মৌখিক পরীার নামে ডেকে নিয়ে এসে দর কষাকষি করে শিাপ্রতিষ্ঠানে এই নিয়োগ নিয়ে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। উপজেলার কাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুইপরে কাছ থেকে টাকা নিয়ে একজনকে নিয়োগের বিষয় চূড়ান্ত করায় প্রতিপরা বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়।