আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৩তম জন্মবার্ষিকী
‘আজি হতে শতর্বষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতা খানি/ কৌতুহল ভরে/ আজি হতে শতর্বষ পরে… এখন করিছে গান সে কোন নূতন কবি/ তোমাদের ঘরে।’
একশ’ বছরেরও বেশি আগে বাঙালি পাঠকদের প্রতি এ জিজ্ঞাসা ছিল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এখনও তার সে জিজ্ঞাসা রয়েছে। একশ’ বছর পরেও পালিত হয়েছে তার সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। মাত্র কিছুদিন আগেও লাখো কন্ঠে গাওয়া হয়েছে তাঁর লেখা- ‘আমার সেনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। শুধু তাই নয়, খেলার মাঠেও বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা খেলা শুরুর আগে মাথা নুইয়েছেন তার সৃষ্টির সামনে। এসব কি প্রমাণ করে না- একশ’ বছর আগে কবি যে আশংকা করেছিলেন, তা এখন ভিন্নমাত্রায় তার সৃষ্টিরই জয়গান।
আমাদের নানা সংকট-আনন্দ-বেদনায়, আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্র সৃষ্টি আমাদের চেতনায় বরাবর স্পর্শ করছে। আরো শত বছর পরও বাঙালিকে আন্দোলিত করবে কবির বাণী- তা বলা অত্যুক্তি হবে না।
কবির আশংকার জবাবে বলা যায়, শত বছর পরে এখন অনেক নতুন কবি এসেছেন, নব নব সৃষ্টিতে প্রতিনিয়ত স্ফীত হচ্ছে আমাদের সাহিত্য এবং সংগীতের ভূবন। তারপরেও আমাদের রবীন্দ্রনাথ মাত্র একজনই। এখনও কবির সৃষ্টিশীলতা নবপ্রজন্মের লেখকদের সাহস যোগায়। এখনো বাঙালির সবকিছুতে রবীন্দ্রনাথই ভরসা হয়ে উঠেন। তাই কবির বসন্ত গান তার তিরোধানের দেড়শত বছর পরেও ধবনিত হয় নবীন কবি আর পাঠকের বসন্ত দিনে।
জন্মের দেড় শতাধিক বছর পেরিয়ে এবং মৃত্যুর প্রায় ৭৩ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ এখনও কেন প্রাসঙ্গিক- এ ব্যাপারে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বাঙালির এই কবি এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন রাষ্ট্র ছিল পরাধীন, চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর, বাংলাভাষা ছিল অপরিণত। তিনি একাধারে এই ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তা জগতে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। বাঙালির মানস গঠনে পালন করেছেন অগ্রদূতের ভূমিকা। সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে অভিসারী হয়ে ওঠার প্রেরণা যোগানোর মধ্যদিয়ে বাঙালি মননকে বিশ্বমানে উন্নীত করে জাতিকে আবদ্ধ করে গেছেন চিরকৃতজ্ঞতায়।’
তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য্য দান করেছেন, তাতে এই ভাষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, সকল ভাব-অনুভূতির প্রকাশ এবং নির্মল হাস্য-কৌতুকের বাহন হতে সমর্থ হয়েছে। দেড়শত বছর পেরিয়েও কবি আমাদের মাঝে চিরজাগরুক হয়ে আছেন।’
চিরজাগরুক, বাঙালির আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের অন্যতম নায়ক, কাব্যগীতির শ্রেষ্ঠ শ্রষ্টা, দ্রষ্টা ও ঋষিতুল্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৩ তম জন্মবার্ষিকী কাল বৃহস্পতিবার।
১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কবিগুরু। বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
জাতীয় পর্যায়ে কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। ঢাকাসহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিবসটি যথাযোগ্যভাবে উদযাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করবে। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনও বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে বাংলাদেশ ও রবীন্দ্রনাথ।
প্রতিবারের মতো এ বছরও জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। সকাল ১১টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন। স্বাগত ভাষণ দেবেন সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। রবীন্দ্র স্মারক বক্তা অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী উপস্থিত থাকবেন।
এদিন সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্ব ছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমীতে তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবির চিত্রশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে।
মূল অনুষ্ঠানের সাথে সঙ্গতি রেখে কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর ও খুলনার দক্ষিণডিহিতে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর ১৫৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে স্থানীয় প্রশাসন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযোগ্য মার্যাদায় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন করবে।
জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি চ্যানেলসমূহ ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করবে।
শুধু দুই বাংলার বাঙালিই নয়, পুরো ভারতবাসী এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষী কবির জন্মবার্ষিকীর দিবসটি পালন করবে হৃদয় উৎসারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায়। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করবে।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে তার গীতাঞ্জলী গ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কবির গান-কবিতা, বাণী এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত সাহস যোগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে শুধু নয়, চিরকালই কবির রচনাসমূহ প্রাণের সঞ্চার করে। আমাদের প্রতিটি সংগ্রামেই কবির চিরায়ত রচনাসমগ্র আজীবন স্মরণের র্র্শীষতায় আবিষ্ট হয়ে আছে।
তাঁর লেখা ‘আমার সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রেরণা যুগিয়েছিল তাঁর অনেক গান। তাঁর লেখা গান ভারত ও শ্রীলংকারও জাতীয় সংগীত।