ঘাতকের চেয়ে রক্ষাকর্তা বেশি শক্তিশালী

হামিদ মীর পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
হামিদ মীর পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

ডাক্তার আমার শরীরের তস্থানে ড্রেসিং করতে এলে পেট, পা ও কাঁধে গুলির ছিদ্র দেখে আমি হেসে দিই। আপনারা ভাবছেন, আমি নিজের দেহে গুলির ছিদ্র দেখে কেন হাসি? আজ সকালে আমিও নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি। মনের কোনো এক প্রান্ত থেকে আওয়াজ এলো, তোমার এই দুর্বল প্রকৃতির হাসির আড়ালে মূলত আল্লাহর বড়ত্বের স্বীকারোক্তি রয়েছে। যে ঘাতকেরা ১৯ এপ্রিল করাচিতে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, তারা রাকর্তার সামনে বড়ই দুর্বল প্রমাণিত হয়েছে। তারা কত দুর্ভাগা যে, রীতিমতো নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি আমাকে বলেছেন, নিঃসন্দেহে আক্রমণকারীর চেয়ে রাকর্তা অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে তোমার সতর্ক থাকা জরুরি। তার আশঙ্কা, আমার ওপর আবারো হামলা হবে। আমি এর আগে কয়েকবার পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্টের আশঙ্কা হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন নিজের দেহে ছয়টি গুলির ছিদ্র দেখে তার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া কঠিন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান ও আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টির প্রধান ইসফান্দিয়ার ওলী পাকিস্তানের ওই রাজনীতিবিদদের অন্যতম, যারা আত্মঘাতী ও হত্যাচেষ্টার হামলায় কয়েকবার বেঁচে গেছেন, তারা উভয়েই আমাকে সতর্ক করেছেন, আমি পরবর্তী হামলার জন্য যেন সতর্ক থাকি। মাওলানা ফজলুর রহমান ও ইসফান্দিয়ার ওলীর সাথে আমার সম্পর্ক দুই দশকেরও বেশি পুরনো। আমার মতো নগণ্যের জন্য এটা কত সৌভাগ্যের বিষয় যে, লোকেরা আমার সুস্থতার জন্য কুরআন পাক তেলাওয়াত করে দোয়া করেছেন। আমি প্রার্থনাকারীদের যত কৃতজ্ঞতাই আদায় করি, তা কমই হবে। (পাকিস্তান) জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজুল হক বললেন, তিনি শূরার বৈঠকে আমার জন্য দোয়া করেছেন। মাওলানা সামিউল হক আকুড়াখটকের দারুল উলুম হক্কানিয়া মাদরাসায় বিশেষ দোয়ার ব্যবস্থা করেছেন। দোয়াকারীদের শুকরিয়া জানাই। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল, উর্দু মিডিয়াম স্কুল ও দ্বীনি মাদরাসার ছাত্রছাত্রীরা আমার জন্য দোয়া করেছেন, তাদেরকেও শুকরিয়া জানাই।

ভয়েস ফর বেলুচ মিসিং পারসনসের মামা আব্দুল কাদির বেলুচের অনুমান সবার থেকে আলাদা। তিনি আমাকে দেখতে হাসপাতালে আসেন। তার ডান হাতে একটি তসবির দানা ঘুরছিল। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেনÑ আফসোস, আমাদের পে সোচ্চার হওয়ায় আপনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তিনি ওই মামা আব্দুল কাদির বেলুচ, যিনি কিছু দিন আগে গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারের দাবিতে কোয়েটা থেকে করাচি এবং করাচি থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত লংমার্চ করেছেন। মামা আব্দুল কাদির বেলুচ যখন ইসলামাবাদ পৌঁছলেন, তখন তাকে যারা গাদ্দার মনে করেন, তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন মিডিয়া যেন তার লংমার্চকে এড়িয়ে যায়। এটা কিভাবে সম্ভব যে, আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে লংমার্চকারী ৭২ বছরের বৃদ্ধকে মিডিয়া এড়িয়ে যাবে? আমি মামা আব্দুল কাদির বেলুচ এবং তার লংমার্চের সঙ্গী নারী ও শিশুদের আমার টিভি শোতে উপস্থাপন করি। পরে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নিজে আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং মামা আব্দুল কাদিরের সাথে সাাতের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী তার রাজনৈতিক সচিব ড. আসিফ কেরমানিকে দায়িত্ব দেন, তিনি যেন মামা আব্দুল কাদিরের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাাতের সময় নির্ধারণ করেন। মামা আব্দুল কাদিরের অবস্থান একেবারে সাদামাটা। তিনি বললেন, আমি বেলুচিস্তানের গুম হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তির ভিা চাচ্ছি না। আমি শুধু বলছি, যে আইন দ্বারা পাকিস্তান চালানো হচ্ছে, ওই আইনের অধীনেই গুম হওয়া ব্যক্তিদের আদালতে পেশ করা হোক। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ গুম হওয়া ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করার শক্তি রাখেন না। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাাতের ব্যাপারে মামা আব্দুল কাদির বেলুচের খুব একটি আগ্রহ দেখা গেল না।
আমি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মানবতাবোধের খুব মূল্যায়ন করি। দুই বছর আগে তিনি পাকিস্তানের রাজপথে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পে দাবি উত্থাপনকারী আমেনা মাসউদ জানজুয়ার সাথে মিলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অসংখ্য অসহায় পরিবারের একটি তালিকা তৈরি করেন। অতঃপর ওই পরিবারগুলোকে ইসলামাবাদে পাঞ্জাব হাউজে ডেকে তাদের মাঝে ৫০ লাধিক রুপিয়ার চেক বিতরণ করেন। নওয়াজ শরিফ ওই সময় ওয়াদা করেন, যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবশ্যই উদ্ধার করবেন। নওয়াজ শরিফের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক বছর হতে চলেছে। এখন যখন আমেনা মাসউদ জানজুয়া তাকে তার ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পুনরায় রাজপথে নেমে আসেন, তখন ইসলামাবাদ পুলিশ তার ওপর লাঠিচার্জ করে তাকে গ্রেফতার করে। নওয়াজ শরিফ কি এ কথা স্বীকার করবেন যে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে তিনিও আগের সরকারের মতো দুর্বল এবং বিগত সরকারের বিরুদ্ধে তার সমালোচনা অন্যায় ছিল? আমি নওয়াজ শরিফের প্রতি কৃতজ্ঞ যে, আমার ওপর হামলার পরদিনই তিনি আগা খান হাসপাতালে আমার খোঁজখবর নিতে ছুটে এসেছেন। তিনি আমার ওপর প্রাণঘাতী হামলার তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টে চিঠিও দিয়েছেন। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে, তার শাসনামলে আমেনা মাসউদ জানজুয়াকে রাজপথে অপদস্থ করা হবে আর আমি চুপ থাকব? আমি জানি, নওয়াজ শরিফ ব্যক্তিগতভাবে মামা আব্দুল কাদির বেলুচ ও আমেনা মাসউদ জানজুয়ার বেশ মূল্যায়ন করেন। কেননা তারা দু’জনে রাজনীতিক সংগ্রামের পথ অবলম্বন করেছেন, অস্ত্র হাতে তুলে নেননি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, অস্ত্রধারীরা নিরস্ত্র গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের সাথে যা ইচ্ছা তাই করবে এবং প্রধানমন্ত্রীর মতা শুধু এতটুকু যে, তিনি তদন্তের নির্দেশ দেবেন।

আজ আমি রাজনীতি নিয়ে বেশি কথা বলতে চাচ্ছি না। এখন আমি জাতির ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমার সাংবাদিক সহকর্মীদের, যারা আমার ওপর হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। করাচি বার অ্যাসোসিয়েশনসহ দেশের সব বার অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতারও শুকরিয়া আদায় করছি। সুশীলসমাজের সংগঠনগুলোর শুকরিয়া আদায় করছি। খ্রিষ্টান, হিন্দু, শিখ ও পাকিস্তানের অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীর শুকরিয়া আদায় করছি, যারা আমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছেন। গোটা বিশ্ব জেনেছে যে, পাকিস্তানে গণমাধ্যম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তবে বিশ্ব এটাও দেখেছে, পাকিস্তানের বেশির ভাগ জনগণ গণমাধ্যমের পাশে রয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমি আমার আঘাত ও কষ্টকে এক নতুন শক্তিতে পরিণত করতে পারব। স্বস্তির কথা হলো, পিপিপির চেয়ারপারসন বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি আমাকে দেখতে এসে বলেছেন, লোডশেডিংয়ের মতো সমস্যা নিয়ে নওয়াজ শরিফ সরকারকে চূড়ান্ত সময় বেঁধে দেবো, তবে যদি গণতন্ত্রকে বিপন্ন হতে দেখি, তাহলে নওয়াজ শরিফের পাশে গিয়ে দাঁড়াব। কিছু মানুষ গণতন্ত্রের গাড়িকে খাদ থেকে উঠাতে তৎপর হয়েছেন। অন্তত আজ রাজনীতিক, সাংবাদিক ও আইনজীবী ভাইয়েরা গণতন্ত্র সুরার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন। আহত গণতন্ত্র ও আহত সাংবাদিকতা উভয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি আহত গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতার দেহে তচিহ্ন দেখে হাসছি। আমার বিশ্বাস, ঘাতকের চেয়ে রাকর্তা বেশি শক্তিশালী।

 

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং
১ মে ২০১৪ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend